Featured Posts

Wednesday, May 11, 2016

গহন অরণ্যে // সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

গহন অরণ্যে আর বারবার একা যেতে সাধ হয় না-
শুকনো পাতার ভাঙা নিশ্বাসের মতো শব্দ
তলতা বাঁশের ছায়া, শালের বল্লরী,
সরু পথ
কালভার্টে, টিলার জঙ্গলে একা বসে থাকা কী-করম নিঝুম বিষন্ন
বড় হিংস্র দুঃখময়।
অসংখ্য আত্মার মতো লুকোনো পাখী ও প্রাণী, অপার্থিব নির্জনতা
ফুলের সুবর্ণরেখা গন্ধ, সামনে ঢেউ উৎরাই-
অসহিষ্ণু জুতোর ভিতরে বালি, শিরদাঁড়া ব্যথা পেতে দ্ধিধা করে
কেননা কুকের মধ্যে চাপা হাওয়া, করতলে মুখ।
গহন অরণ্যে আর বারবার একা যেতে সাধ হয় না-
তবু যেতে হয়
বারবার ফিরে যেতে হয়।।

লোরকা ও বোর্হেস: অজানা অধ্যায় // মাসরুর আরেফিন

হোর্হে লুইস বোর্হেসের কথা ভাবতেই অসংখ্য শব্দের মধ্যে যেটি প্রথম মাথায় আসে, তা ‘ধাঁধা’। সারা পৃথিবীতে বোর্হেস যে এত পূজনীয় তার অন্যতম কারণ, মানুষ প্রজাতি হিসেবেই ধাঁধার ভক্ত; বুদ্ধিবৃত্তি এই প্রজাতি চায় ধাঁধার সামনে পড়তে ও ধাঁধার জট খুলে মজা পেতে। অনেকেই বলেন, বোর্হেসই সাহিত্যের শেষ কথা; তাঁর অপরিসীম জ্ঞান, কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা এমন এক জাদুর জগতে পাঠককে নিয়ে যায় যে বোর্হেস পড়ার তীক্ষ আনন্দের পরে পাঠকের আর অন্য কিছু পড়তে নীরস লাগে। বোর্হেসের সরল-সোজা-সীমিত আকারে কথা বলার ভানহীন যে শৈলী, সেন্টিমেন্টালিটি ও অলংকারসর্বস্ব গদ্য কি পদ্যের বিপরীতে তাঁর যে বুদ্ধিকে নাড়া দেওয়ার নান্দনিকতা—এসব কিছু মিলে বোর্হেস পড়ার পরে হাজারো লেখকের গল্প-কবিতা পড়ার চেয়ে মনে হয় স্রেফ সংবাদপত্র পড়াই বুঝি অনেক ভালো কিংবা খাবারের প্যাকেটের গায়ে লেখা পণ্যের বিবরণ। এ কথাটা আমার নয়। এটা বলেছিলেন জগদ্বিখ্যাত ‘পাঠক’ ও প্রাবন্ধিক আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েল। ম্যাঙ্গুয়েল বলেছিলেন, হায় রে, যা-ই পড়ি তা-ই দেখি ভানে ভরা, শুধু বোর্হেসেই কোনো ভান নেই; আর যে-দেশের যত বড় লেখকের লেখাই পড়ি না কেন, দেখি শুধু ‘লোকাল কালার’-এর ছড়াছড়ি; সবাই কোনো না কোনো জাতির বা দেশের লেখক, একমাত্র বোর্হেসই দেখছি ‘পৃথিবীর’ লেখক।

বোর্হেস ও লোরকা প্রসঙ্গে আসার আগে, ‘ভান’ ও ‘লোকাল কালার’ কথা দুটি মাথায় ঢুকিয়ে নিয়ে চট করে কবিতা বিষয়ে বোর্হেসেরই দু-একটি কথা জেনে নেওয়া যাক। কারণ, তাহলে লোরকা নিয়ে একটু পরেই যখন বলছি, তখন বোর্হেসের ‘সমস্যা’টা আসলে কোথায় ছিল তা বুঝতে সুবিধা হবে। বোর্হেস তাঁর প্রবন্ধসংগ্রহ ‘This Craft of verse’-এর প্রথম প্রবন্ধ ‘কবিতা ধাঁধা’য় বলছেন: ‘সত্য কথা হচ্ছে, (কবিতা বা কবিতার ধাঁধার জট খোলা বিষয়ে) আপনাদের কোনো দৈববাণী দিতে আমি অক্ষম। আমার জীবন কেটেছে পড়ে, বিশ্লেষণ করে, লিখে বা লেখার চেষ্টা করে এবং আনন্দ পেয়ে। এই শেষের ব্যাপারটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার “রস পান” করে করে আমি কবিতা নিয়ে একটা চূড়ান্ত উপসংহারে পৌঁছেছি। আপনাদের বিভ্রান্তি দেওয়া বা হতবুদ্ধি করা বাদে আমার আর করার কিছু নেই। আমার জীবনের সিংহভাগই আমি দিয়ে দিয়েছি সাহিত্যে এবং আপনাদের কেবল সংশয় প্রদান করতেই আমি সক্ষম। ...আপনাদের শুধু মানসিক দ্বিধা ও ধাঁধা সমর্থ আমি।’

আজ অনেক বছর যাবৎ বোর্হেস পড়ার পরে বলতে হচ্ছে, তিনি এ পর্যন্ত আমাকে যত মানসিক দ্বিধা, বিভ্রান্তি ও ধাঁধা উপহার দিয়েছেন, তার প্রধান একটি হলো আমার প্রিয় কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন। হিস্পানি কবিতায় অবিনশ্বর যুবরাজ লোরকা—র্যাঁবোর পাশাপাশি সাহিত্য নিয়ে থাকা আমাদের সবার কাছে জীবনের তারুণ্যপর্বের নাওয়া-খাওয়া ভুলিয়ে দেওয়া এক কবি। ‘তাঁর কবিতা ছুটেছিল বিচিত্র পথে—জিপসি-গানের গীতলতা থেকে ইশারাভরা চিত্রকাব্য, আরব শৈলীর বিধুরতা থেকে পরাবাস্তবের কুহেলি পর্যন্ত’—কথাটি আমার নয়, লোরকা অনুবাদক কবি সাজ্জাদ শরিফের। যথার্থই বলেছেন তিনি। আমরা কে পড়িনি আন্দালুসিয়ার জলপাই বাগানের এ-কবির বিখ্যাত বুলফাইট নিয়ে লেখা ট্র্যাজিক কবিতা: ‘বিকেল পাঁচটায়।/ বিকেলে একেবারে যখন বাজে পাঁচ।/ একটি খোকা আনে ধবল আবরণী/ বিকেল পাঁচটায়।/ চুন-বোঝাই ঝুড়ি রইল প্রস্তুত/ বিকেল পাঁচচায়।/ মৃত্যু সবই আর কেবল মৃত্যুই/ বিকেল পাঁচটায়।’?

সেই লোরকার সঙ্গে ১৯৩৪ সালে যে আর্জেন্টিনায় বোর্হেসের দেখা হয়েছিল সে কথা অনেকেরই জানা নেই। সে-বছর হিস্পানি ভুবনের দুই সর্বাধিক বিখ্যাত কবি, পাবলো নেরুদা ও গার্সিয়া লোরকা, দুজনেই বুয়েনস এইরেসে আসেন। লোরকার বয়স তখন পঁয়ত্রিশ, খ্যাতির তুঙ্গে তিনি। নিজেদের শহরে এই দুই বড় কবিকে একসঙ্গে পেয়ে আর্জেন্টাইন বুদ্ধিজীবী মহল অনেক মাতামাতি করল, আর এঁরা দুজনই ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হলেন আর্জেন্টিনার সাহিত্যজগতের সব নক্ষত্রের সঙ্গেই, বোর্হেসও আছেন সেই তালিকায়।

সেই স্মৃতি মাথায় রেখে, ১৯৬৯ সালে (লোরকা খুন হয়েছেন তাঁর ৩৩ বছর আগে আর বোর্হেস তখন বিশ্ববিখ্যাত বললেও কম বলা হয়) রিচার্ড বাগিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বোর্হেস বলছেন:

বোর্হেস: লোরকার নাটক আমার ভালো লাগে না। কখনোই লোরকাতে মজা পাইনি আমি।

বার্গিন: আর তাঁর কবিতা?

বোর্হেস: না। আমি তাঁর ‘ইয়েরমা’ দেখতে গিয়েছিলাম, এত বোকাটে (silly) লেগেছিল যে আমি বেরিয়ে আসি। সহ্যই করতে পারিনি।

বার্গিন: লোরকাকে তো, কোনো এক কারণে, তাঁর দেশে বীরপূজার মূর্তি বানিয়ে ফেলা হয়েছে।

বোর্হেস: আমার ধারণা, লোরকার সৌভাগ্য যে তাঁকে ওভাবে হত্যা করা হয়। বুয়েনস এইরেসে তাঁর সঙ্গে আমার এক ঘণ্টা আলাপ হয়েছিল। তাঁকে আমার মঞ্চাভিনেতা বলে মনে হয়েছে। কোনো একটা চরিত্র হয়ে যেন সে জীবন কাটাচ্ছে।

16বার্গিন: যেমনটা, আমি যেটুকু বুঝি, ককতোঁর হওয়ার কথা ছিল।

বোর্হেস: হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। তবে লোরকার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। কারণ, আমি নিজেও আন্দালুসিয়ায় থেকেছি, আন্দালুসিয়ানরা মোটেই ও-রকম নয়। তাঁরটা হচ্ছে মঞ্চের আন্দালুসিয়ান-জাতীয় কিছু। হতে পারে বুয়েন্স এইরেসে এসে তাঁর মনে হয়েছিল ও-রকম একটা চরিত্রের অভিনয় করে যেতে হবে, কিন্তু আন্দালুসিয়াতে মানুষ একেবারেই অমন নয়। সত্যি বলতে, আন্দালুসিয়ায় আপনি যদি কোনো শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে বুলফাইটের কথা বলেন, সে আপনাকে বলবে, ‘ও হ্যাঁ, মানুষ ওসবে মজা পায় বটে, কিন্তু বুলফাইটাররা আসলে কোনো বিপদের মধ্যে কাজ করে না, একদমই না।’ ওরা আসলে এসব দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে গেছে, আসলে প্রত্যেক লেখকই নিজের দেশের ‘লোকাল কালার’ লেখায় ফুটিয়ে তুলতে তুলতে হাঁপিয়ে উঠেছে।

লোরকার লেখায় আন্দালুসিয়ান ‘লোকাল কালার’ ব্যবহার করে মানুষকে মুগ্ধ করার প্রবণতা এবং একই সঙ্গে তাঁর কবিতার ‘নাটকীয় চরিত্র’ বোর্হেসের ভালো লাগেনি। বোর্হেস এবার বললেন সাংঘাতিক কথা:

বোর্হেস: লোরকা চাইতেন আমাদের চমকিত করতে। তিনি আমাকে বলেছিলেন সমকালীন পৃথিবীর অন্যতম এক প্রধান চরিত্র নিয়ে তিনি খুবই বিচলিত—এমন একক চরিত্র, যার মধ্যে নাকি আমেরিকান জীবনের ট্র্যাজেডির ছবি ধরা আছে। ...দেখা গেল তিনি মিকি মাউসের কথা বলছেন। ...এসব কথা বলা যায় বয়স কম থাকতে, যখন আপনি চাইবেন যে কাউকে অবাক করে দেব। কিন্তু তিনি তো ছিলেন বয়স্ক এক লোক, তাঁর কোনো দরকার ছিল না ওসবের, তিনি অন্যভাবেও কথা বললে পারতেন। তবে সব বাদ দিয়ে তিনি যখন মিকি মাউসকে আমেরিকার প্রতীক বলে বলা শুরু করলেন, আমরা হাঁটা দিলাম। কারণ, ওসব গেমের বয়স আমরা তত দিনে পেরিয়ে এসেছি (দ্রষ্টব্য যে, লোরকা বোর্হেসের চেয়ে বয়সে এক বছরের বড়)।

এবার কথা উঠল লোরকার দুষ্ট রসবোধ ও কৌতুকী ছদ্মবেশিতা নিয়ে। যেন গা গুলিয়ে উঠল। বার্গিন যখন বললেন, লোরকা যতটা না ‘চিন্তাশীল’ লেখক তার চেয়ে বেশি ‘শব্দের কারিগর’, তখন বোর্হেসের উত্তর:

বোর্হেস: কিন্তু আমার ধারণা, তাঁর ওই শব্দের পেছনে আসলে তেমন কিছুই নেই।

বার্গিন: শব্দ শোনার দারুণ একটা কান ছিল তাঁর।

বোর্হেস: ছিল বাচালতার। উদাহরণ হিসেবে বলছি, তিনি চমক লাগানো সব মেটাফর (রূপকালংকার) তৈরি করতে পারতেন, কিন্তু আমার মনে হয় ওই সব চোখধাঁধানো মেটাফর তিনি নিজের জন্যই বানাতেন, কারণ তাঁর পৃথিবী ছিল মূলত বকবকানির পৃথিবী। আমি মনে করি, তিনি একটা শব্দকে আরেকটার বিপরীতে খেলাতে পারতেন, শব্দের বৈপরীত্য বিষয়টা পছন্দ করতেন, কিন্তু আমার সন্দেহ হয় তিনি কি আদৌ জানতেন যে কী করছেন?

এমন এক সময় বোর্হেস ও লোরকার দেখা হয়েছিল যখন বোর্হেস সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা ছেড়ে দিয়েছেন, সাহিত্যে কোনো রকম চমক, ভান ও তাক লাগানো মেটাফর তৈরির প্রবণতা ছেড়ে বরং ধ্রুপদি সাহিত্যের লিরিকহীন স্বচ্ছতা ও সরলতার পথে যাচ্ছেন আর যখন লোরকা চলেছেন ঠিক উল্টো পথে—পরাবাস্তবতা ও মেটাফরের আকস্মিক ধাক্কার ঝংকারের দিকে। সময়টাই আসলে সঠিক ছিল না। এই দুই কবির মধ্যকার সংলাপের বিষয়টাই তখন অসম্ভব ছিল।

সুত্রঃ প্রথম আলো। 

Tuesday, June 30, 2015

কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি

এই বইয়ের নাম দিয়েছি ‘কবিতা ক্লাস’। এতে চমকাবার কিছু নেই। অনেকে মনে করেন যে, কবিতা একটি অপার্থিব দিব্য বস্তু, এবং তাকে আয়ত্ব করবার জন্যে, মুনিঋষিদের মতো, নির্জন পাহাড়ে-পর্বতে কিংবা বনে-জঙ্গলে গিয়ে তপস্যা করতে হয়। আমি তা মনে করি না। আমার বিশ্বাস, জাতে যদিও আলাদা, তবু কবিতা-ও সাংসারিক বিষয় ছাড়া আর-কিছুই নয়, আমাদের এই সাংসারিক জীবনের মধ্যেই তার বিস্তর উপাদান ছড়িয়ে পড়ে আছে, এবং ইস্কুল খুলে, ক্লাস নিয়ে, রুটিনমাফিক আমরা যেভাবে ইতিহাস কি ধারাপাত কি অঙ্ক শেখাই, ঠিক তেমনি করেই কবিতা লেখার কায়দাগুলো শিখিয়া দেওয়া যায়। ‘কায়দা’ না-বলে অনেকে বলবেন ‘কলাকৌশল’, তা বলুন, কথাটা তার ফলে আর-একটু সম্ভ্রান্ত শোনাবে ঠিকই, কিন্তু মূল বক্তব্যের কোন ইতরবিশেষ হবে না। বিশ্বাস করুন চাই না-করুন, কবিতা লেখা সত্যিই খুব কঠিন কাণ্ড নয়।
সেই তুলনায় পদ্য লেখা আরও সহজ। শুধু কায়দাগুলো রপ্ত করা চাই, ঘাঁতঘোঁত জেনে নেওয়া চাই। কবিতা আর পদ্যের তফাত কোথায়, এক্ষুনি সেই তর্কে ঢুকে ব্যাপারটালে ঘোরালো করে তুলতে চাই না। তার চাইতে বরং জিজ্ঞেস করি, আপনার বয়স যখন অল্প ছিল, তখন ছোটপিসি কি ন-মাসি কি সেজদির বিয়ের সময়ে কি আপনার একখানা উপহার লিখবার ইচ্ছে হয়নি? হয়তো হয়েছিল। হয়তো ভেবেছিলেন, “বাঃ কী মজা, বাঃ কী মজা, খাব লুচি মন্ডা গজা” ইত্যাদি সব উপাদেয় খাবারদাবারের কথা দিয়ে লাইন-কয় লিখে তারপর “বিভুপদে এ-মিনতি—“ জানবেন যে, নবদম্পতি যেন চিরকাল সুখে থাকে।
কিন্তু হায়, শেষ পর্যন্ত আর হয়তো লেখা হয়নি। হবে কী করে? ‘মজা’র সঙ্গে ‘গজা’র মিলটাই তখন মনে পড়েনি যে। আর তাই, কড়িকাঠের দিকে ঘণ্টাখানেক তাকিয়ে থেকে, এবং নতুন-কেনা মেড-ইন-ব্যাভেরিয়া পেনসিলের গোড়াটাকে চিবিয়ে ছাতু করে, শেষপর্যন্ত হয়তো ‘ধুত্তোর’ বলে আপনি উঠে পড়েছিলেন। মনে-মনে খুব সম্ভব বলেছিলেন, “ওসব উপহার-টুপহার লেখার চাইতে বরং মুদির দোকানের খাতা লেখা অনেক সহজ।”
মুদির দোকানের প্রসঙ্গে একটা পুরোনো কথা মনে পড়ল। বছর পঞ্চাশেক আগেকার ঘটনা। আমার বয়স তখন বছর-দশেক। সেইসময়ে আঁক কষতে-কষতে শেলেটের উপরে আমি একটা পদ্য লিখেছিলুম। তার আরম্ভটা এইরকম—

আজ বড়ো আনন্দ হইয়াছে।
দেখিয়াছি, রান্নাঘরে কই আছে।

অর্থাৎ আমি বলতে চেয়েছিলুম যে, মা যখন কইমাছ রান্না করছেন, তখন দুপুরের ভোজনপর্বটা বেশ জমাট হবে, সুতরাং আজ আমার বড়োই আনন্দের দিন। আনন্দ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হল না; এক জ্যাঠতুতো দাদা এসে চুলের মুঠি ধরে আমাকে শূন্যে তুলে ফেললেন, তারপর বাঁ হাতে আমাকে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখে ডান হাতে একটা চড় কষালেন, তারপর বললেন, “হতচ্ছাড়া, তোমাকে আঁক কষতে দেওয়া হয়েছে, আর তুমি কিনা বসে-বসে কাব্যি করছ? এই আমি বলে রাখলুম, পরে তোমাকে মুদির দোকানের খাতা লিখে পেট চালাতে হবে।”
বাজে কথা। যে-ছেলে আঁক কষতে ভয় পায়, তার পক্ষে মুদির দোকানের খাতা লেখা সম্ভব নয়। চাল-ডাল-গোলমরিচ-জিরে-হলুদ-পাঁচফোড়নের হিসেব রাখা কি চাট্টিখানি ব্যাপার? সে-কাজ সকলে পারে না। তার জন্যে সাফ মাথা চাই। সেই তুলনায় বরং কবিতা লেখা অনেক সহজ। কবিতা লেখবার জন্যে, আর যা-কিছুরই দরকার থাক, মাথাটাকে সাফ রাখবার কোনও দরকার নেই। বরং, সত্যি বলতে কী, মাথার মধ্যে একটু গোলমাল থাকলেই ভালো। কিন্তু না, মাথার প্রসঙ্গ এইখানেই ছেদ টানা যাক, কেন-না বিশুদ্ধ আগমার্কা কবিরা হয়তো এইটুকু শুনেই চোখ রাঙাতে শুরু করেছেন, বাকিটুকু শুনলে তাঁরা আমাকে আস্ত রাখবেন না। তার চাইতে বরং যে-কথা বলছিলুম, তা-ই বলি।
আমার বলবার কথাটা এই যে, অল্প একটু চেষ্টা করলে যে-কেউ কবিতা লিখতে পারে। আমার মাসতুতো ভাইয়ের ছোটছেলেটির কথাই ধরুন। গুণধর ছেলে। টুললিফাই করেছে, পরীক্ষার হলে বোমা ফাটিয়েছে, গার্ডকে ‘জান খেয়ে নেব’ বলে শাসিয়েছে, উপরন্তু চাঁদা তুলে, মাইক বাজিয়ে সরস্বতী পুজো করে বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে তুষ্ট করেছে, তবু—এতরকম কাণ্ড করেও—স্কুল-ফাইনালের পাঁচিলটা সে টপকাতে পারেনি, তিন বার পরীক্ষা দিয়েছিল। তিন বারই ফেল। এখন সে আমাদের হাটবাজার করে দেয়, হরিণঘাটার ডিপো থেকে দুধ আনে, পঞ্চাশ রকমের ফাইফরমাশ খাটে, এখানে-ওখানে ভুল-ইংরেজিতে চাকরির দরখাস্ত পাঠায়, এবং—
এবং কবিতা লেখে। তা সে-ও যদি কবি হতে পারে, তবে আপনি পারবেন না কেন?
আমার গিন্নির খুড়তুতো ভাই এক সওদাগরি আপিসের বড়োবাবু। আগে সে-ও কবিতা লিখত, কিন্তু আপিসে তাই নিয়ে হাসাহাসি হওয়ায় এবং বড়োসাহেব তাকে একদিন চোখ পাকিয়া “হোয়াট্‌’স দিস্‌ আয়া’ম্‌ হিয়ারিং অ্যাবাউট ইউ” বলায়, কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে সে এখন গোয়েন্দা-গল্পের ভক্ত হয়েছে। তার কাছে সেদিন একটা ইংরেজি বই দেখলুম। বইয়ের নামে বুচার্‌ বেকার্‌ মার্ডার মেকার্‌। অর্থ অতি পরিষ্কার। যে-কেউ খুন করতে পারে। নৃশংস কসাইও পারে, আবার নিরীহ রুটিওয়ালাও পারে। খুন করবার জন্যে যে একটা আলাদা রকমের লোক হওয়া চাই, তা নয়।
তুলনাটা হয়তো একটু অস্বস্তিকর হয়ে যাচ্ছে, তবু বলি কবিতার ব্যাপারেও তা-ই। কবিতা লিখবার জন্যে আলাদা রকমের মানুষ হবার দরকার নেই। রামা শ্যামা যদু মধু প্রত্যেকেই (ইচ্ছে করলে এবং কায়দাগুলোকে একটু খেটেখুটে রপ্ত করে নিলে) ছন্দ ঠিক রেখে, লাইনের পর লাইন মিলিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে।
তা জন্যে, বলাই বাহুল্য, কিছু জিনিস চাই, এবং কিছু জিনিস চাই না।
আগে বলি কী কী চাই না—
১) কবি হবার জন্যে লম্বা-লম্বা চুল রাখবার দরকার নেই। ওটা হিপি হবার শর্ত হতে পারে, কিন্তু কবি হবার শর্ত নয়। পরীক্ষা করে দেখে গেছে, চুল খুব ছোটো করে ছেঁটেও কিংবা মাথা একেবারে ন্যাড়া করে ফেলেও কবিতা লেখা যায়। চুলের সঙ্গে বিদ্যুতের সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে, কবিতার নেই।
২) সর্বক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মাটির দিকে তাকিয়েও কবিতা লেখা যায়। সবচাইতে ভালো হয়, যদি অন্য কোনও দিকে না তাকিয়ে শুধু খাতার দিকে চোখ রাখেন।
৩) কখন চাঁদ উঠবে, কিংবা মলয় সমীর বইবে, তার প্রতীক্ষায় থাকবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, অমাবস্যার রাত্রেও কবিতা লেখা যায়, এবং মলয় সমীরের বদলে ফ্যানের হাওয়ায় কবিতা লিখলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না।
৪) ঢোলা-হাতা পাঞ্জাবি পরবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, স্যানডো গেঞ্জি গায়ে দিয়েও, কিংবা একেবারে আদুর গায়েও, কবিতা লেখা সম্ভব।
এইবার বলি, কবিতা লিখতে হলে কী কী চাই।
বিশেষ-কিছু চাই না। দরকার শুধু—
১) কিছু কাগজ (লাইন-টানা হলেও চলে, না-হলেও চলে)।
২) একটি কলম (যে-কোনও শস্তা কলম হলেও চলবে) অথবা একটি পেনসিল এবং–
৩) কিছু সময়।
কিন্তু এতসব কথা আমি বলছি কেন? কবিতার কৌশলগুলিকে সর্বজনের হাতের মুঠোয় এনে না-দিয়ে কি আমার তৃপ্তি নেই? সত্যিই নেই। ইংরেজিতে ‘পোয়্‌ট্রি ফর দি কমন ম্যান’ বলে একটা কথা আছে। আমার ইচ্ছে, কমন ম্যানদেরও আমি পোয়্‌ট বানিয়ে ছাড়ব। পরশুরামের কথা মনে পড়ছে। তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল, পৃথিবীকে একেবারে নিঃক্ষত্রিয় করে ছাড়বেন। কিন্ত, না-পারবার হেতুটা যা-ই হোক, কাজটা তিনি পারতে-পারতেও পারেননি। বিশ্বসংসারকে যাঁরা নিষ্কবি করে ছাড়তে চান (অনেকেই চান), তাঁরাও সম্ভবত শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবেন না।
আমার প্রতিজ্ঞাটা অন্য রকমের। আমি ঠিক করেছি, বাংলা দেশে সব্বাইকে আমি কবি বানাব। দেখি পারি কি না।
কবিতা লিখবার জন্যে কী কী চাই, তা তো একটু আগেই বলেছি। চাই কাগজ, চাই কলম (কিংবা পেনসিল), চাই সময়। তা আশা করি কাগজ-কলম আপনারা জোগাড় করতে পেরেছেন। বাকি রইল সময়। তা-ও নিশ্চয়ই আপনাদের আছে। রেশনের দোকানে লাইন না-লাগিয়ে, এই যে আপনারা গুটিগুটি ‘কবিতার ক্লাস’-এ এসে হাজির হয়েছেন, এতেই বুঝতে পারছি যে, সময়ের বিশেষ অভাব আপনাদের নেই।
সুতরাং ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে শুরু করা যাক। অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু।
আগেই বলি, কবিতার মধ্যে তিনটি জিনিস থাকা চাই। কাব্যগুণ, ছন্দ, মিল।
বিনা ডিমে যেমন ওমলেট হয় না, তেমনই কাব্যগুণ না থাকলে কবিতা হয় না। তার প্রমাণ হিসেবে আসুন, আমার সেই মাসতুতো ভাইয়ের ছোটোছেলের লেখা চারটে লাইন শোনাই:

সূর্য ব্যাটা বুর্জোয়া যে,
দুর্যোধনের ভাই।
গর্জনে তার তুর্য বাজে,
তর্জনে ভয় পাই।

 বলা বাহুল্য, এটা কবিতা হয়নি। তার কারণ, ছন্দ আর মিলের দিকটা ঠিকঠাক আছে বটে, কিন্তু কাব্যগুণ এখানে আদপেই নেই। এবং কাব্যগুণ না-থাকায় দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা নেহাতই বাক্যের ব্যায়াম হয়ে উঠেছে।
এবারে মিলের কথায় আসা যাক। মিল না-রেখে যে কবিতা লেখা যায় না, তা অবশ্য নয়, তবু যে আমি মিলের উপর এত জোর দিচ্ছি তার কারণ:
১) প্রথমেই যদি আপনি মিল-ছাড়া কবিতা লিখতে শুরু করেন, তাহলে অনেকেই সন্দেহ করবে যে, মিল-এ সুবিধে হয়নি বলেই আপনি অ-মিলের লাইনে এসেছেন। সেটা খুব অপমানের ব্যাপার।
২) মিল জিনিসটাকে প্রথম অবস্থায় বেশ ভালো করে দখল করা চাই। তবেই সেটাকে ছেড়ে দিয়েও পরে ভালো কবিতা লেখা সম্ভব হবে। যেমন বড়ো-বড়ো লিখিয়েদের মধ্যে অনেকেই অনেকসময়ে ব্যাকরণের গণ্ডির বাইরে পা বাড়িয়ে চমৎকার লেখেন, এ-ও ঠিক তেমনই। ব্যাকরণ বস্তুটাকে প্রথমে বেশ ভালো করে মান্য করা চাই, তবেই পরে সেটাকে দরকারমতো অমান্য করা যায়। ঠিক তেমনি, পরে যাতে মিলের বেড়া ভাঙা সহজ হয়, তারই জন্যে প্রথম দিকে মিলটাকে বেশ আচ্ছা করে রপ্ত করতে হবে।
ছন্দ কিন্তু সবসময়ই চাই। আগেও চাই, পরেও চাই। আসলে আমার ক্লাসে আমি ছন্দের কথাই বলব। সেই বিচারে ‘কবিতার ক্লাস’ না-বলে একে ‘ছন্দের ক্লাস’ও বলা যেতে পারত। তাতে কিছু ক্ষতি ছিল না।

Saturday, June 13, 2015

দুঃখী রবীন্দ্রনাথ

ইংরাজী ১৮৬১ সালের ৭ইং মে তারিখে রবীন্দ্রনাথঠাকুরের জন্ম হয়। বাংলায় ঠিকুজী করতে গেলে তা দাঁড়ায় ১২৬৮ সালের পঁচিশে বৈশাখ, ভোর তিনটে নাগাত। আঁতুড়ঘর ঠাকুর পরিবারের জমিদারবাড়ী, মুলতঃ বাঙ্গালী অধ্যুষিত উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলের, ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের দালানকোঠা। দালান কোঠা হলেও সে সময় এলাকাটা তেমন “ভাল” ছিল না। পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরহিন্দু ব্রাম্ভণ ছিলেন, আদত পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়। ইংরেজরা কলকাতাকে “ক্যালকাটা”, যমুনাকে “জাম্‌না” করার মত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যানার্জি বানিয়েছিল। তবু ভাল। আমেরিকানদের পাল্লায় পড়লে এটাকে “ব্যান্ডোপেডায়ে” বানিয়ে ছাড়ত। ব্রাম্ভণদের লোকে “ঠাকুর মশায়” বলে সম্বোধন করতো। মশায়ের লেজ ছেড়ে সেই ঠাকুরটাই ক্রমশঃ স্থায়ীহয়ে গেল। ইংরেজরা আবার একে মডিফাই করে টেগোর বানিয়ে দেয়। তাও সই। জাপানীরা হলে আবার “তাগোরে” বানিয়ে ছাড়ত। রবীন্দ্রনাথের পিতামাতা ছিলেন যথাক্রমে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদা দেবী। মানুষটা ভাল এবং হীত কাজের জন্য তিনি “মহর্ষি” খেতাব পেয়েছিলেন। এই ঠাকুর পরিবারের আদত বসত ছিল আবার যশোর খুলনা অঞ্চলে। জমিদারীও। দেবেন্দ্রনাথ বাবুখুলনার বাগেরহাটের শাষক ও সুফি সাধক খান জাহান আলী দ্বারা প্রভাবান্বিত হন।অনেকের মতে তিনি ভাবশিষ্য ছিলেন। সেজন্য তাঁদেরকে “পিরালী ব্রাম্ভণ” বলা হতো।উদার মনের দেবেন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মের সংস্কারক ও ব্রাম্ভধর্মের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়ের মতবাদে আকৃষ্ট হোন ও তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে পড়েন। রাম মোহনের হাত ধরেই তিনি ব্রাম্ভ ধর্মে দীক্ষা নেন এবং এই ধর্মের প্রচার ও প্রসারে সম্পুর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন। মৃত্যুর আগ পর্য্যন্ত তিনি “আদি ব্রাম্ভ সমাজ”এর প্রধানপৃষ্ঠপোষক ছিলেন।রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ একজন কবি ও দার্শনিক ছিলেন। তাঁর আর একভাই সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রথম ভারতীয় আই,সি,এস - যিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের মেম্বার হিসাবে একান্ত সাদা চামড়া সর্বস্বলীগে যোগ দেবার পারদর্শিতা দেখাতে পেরেছিলেন। আর এক ভাই, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একজন প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার ও নাট্যকার ছিলেন। বোনদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী দেবী একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ সুসাহিত্যিক হয়েছিলেন।রবি যখন জন্মান, তখন বাবা দেবেন্দ্রনাথের বয়স ৪৫। বড় চার ভাইয়ের বয়সের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রনাথের ২১, সত্যেন্দ্রনাথের ১৯, হেমেন্দ্রনাথের ১৭ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ১৩ বছর।


রবীন্দ্রনাথ শুধু যে বয়ষে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তাই নয়, তফাৎটা এত বেশী ছিল যে,পিঠোপিঠি ভাইবোনদের সঙ্গে খেলাধুলা, গালগল্প, হাসিকান্না, মারপিট, ধাক্কাধাক্কি করে ছেলেবেলার যে মধুর দিনগুলি কাটে, যেটা প্রায় সবার ভাগ্যেই জোটে এবং যা আপাতদৃষ্টিতে অতি স্বাভাবিক, তা রবীন্দ্রনাথের ভাগ্যে জোটেনি।তারা যেন ভাইবোনের বদলে এক একটা গার্জেন, অভিভাবক। এই মরুভুমির মধ্যে একমাত্র মরূদ্যান ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী, কাদম্বরী দেবী। তিনিরবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে অল্প একটু বড় ছিলেন। প্রায় সমবয়সী বলে তিনি খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনে অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।সেইবৌদির অকস্মাৎ আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ রবীন্দ্রনাথের নিঃসংগ জীবনটা পুনরায় মরুময় করে তুলেছিল এবং তাঁর মানসিকতা ও ভবিষ্যত সাহিত্যকর্মের উপর গভীর দাগ ফেলেছিল।জীবনের প্রথম দশ বছরের বেশী নিঃসংগতা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের ঐ সময়টা বেশ খারাপ ভাবেও কাটে। প্রথমতঃ বাড়িতে প্রচুর লোকজন, অতিথিদের হরহামেশ আনাগোণা, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে দৈনিক লোকসংখ্যা ১০০ থেকে ২০০ জন হয়ে যেত। সংসার ও অতিথি সামলাতে মা হিমশিম খেয়ে যেতেন।সব সময় এত ব্যস্ত থাকতেন যে ছেলে মেয়েদের পিছনে কোন সময় দিতে পারতেন না। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথেরমায়ের আদরযত্ন পাবার তেমন সৌভাগ্য হয়নি। উপরন্তু বাবা অনেকটা সন্যাস গ্রহণের মতো কাজে অকাজে প্রায় সময় বাইরে বাইরে থাকতেন – উত্তর ভারত, ইংল্যান্ড বা অন্য কোথাও। অগত্যা রবিকে বাধ্য হয়ে চাকর বাকরদের হাতে মানুষ হতে হয়েছিল। গার্জেনদের কড়া নজর না থাকলে চাকর বাকরদের যা হয়। চাকররা এক একজন মাস্তান হয়ে শাসন করত। রামায়ণের সীতার মতো রবীন্দ্রনাথের চতুর্দিকে একটা গন্ডী কেটে দিয়ে বলত, “খবরদার, কেবল স্কুলে যাওয়া ছাড়া এই গন্ডীর বাইরে বেরিয়েছ কি আর রক্ষা নেই”। গোলমাল করলে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ভাইবোনদের হরেক কিসিমের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। ভয় দেখানোর জন্য তারা রক্ত খেকো রাক্ষস, কন্ঠকাটা ভুত, ভয়াবহ দস্যু, ডাকাত আরও কত কিছুর গল্প করত।অনেক সময় বাচ্ছাদের খাবার দাবার তারা নিজেরাই খেয়ে ফেলত। চাকরদের খুশি করার জন্য খাবারে রুচী নেই বলে রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় না খেয়ে থাকতেন।সব মিলিয়ে এই বদ্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের মন সদাই ছটফট করত। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথকে শারিরীক ও মানসিক দিক থেকে তৈরী করানোর জন্য বেশ আঁটসাট একটা নীতিমালা তৈরী হয় ও তার প্রয়োগ প্রণালীরও একটা তালিকা প্রস্তুত করা হয়। তাঁর গৃহশিক্ষা শুরু হয় দাদা হেমেন্দ্রনাথের কাছে। শারিরীক দিক ঠিক করতে সাঁতার, উঁচু এলাকায় হাঁটা, জুডো ও কুস্তি এবং মানসিক দিকের উন্নতির জন্য শরীরবিদ্যা, ছবি আঁকা, ইংরেজী, ভুগোল, ইতিহাস, অঙ্ক, সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যের উপর পড়াশুনো শুরু হয়। এগুলো হতো স্কুলে যাবার আগেও পরে।এত চাপের মধ্যে তখন থেকেই রুটিন মাফিক স্কুলের শিক্ষাপ্রণালীর ঊপর তাঁর বিতৃষ্ণা শুরু হতে থাকে।


পিরালী ব্রাম্ভণরা ছিল গোত্র হিসেবে বেশ ছোট এবং রক্ষণশীল। বাংলার অন্যান্য ব্রাম্ভণদের সঙ্গে সামাজিকভাবে ওঠাবসা অনেকটা সীমিত ছিল। কিন্তু বিয়ে সাদীর ব্যাপারটা ছিল একেবারে নো নো। অনেকটা বৃহত্তর খ্রীষ্টান সমাজের সঙ্গে “জেহোভাস উইটনেস” অনুসরণকারী খ্রীষ্টানদের মত। তাই পিরালী ব্রাম্ভণরা সাধারণতঃ বিয়ে শাদীগুলো তাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতেন। কিন্তু গোত্রটি ছোট হওয়ায় উপযুক্ত বয়সের পাত্র পাত্রী মেলানো প্রায়শই দূরুহ হয়ে পড়ত। তাইরবীন্দ্রনাথের যখন বিয়ে হয়, তাঁর বয়স ২২ বছর ৭ মাস হোলেও তাঁর স্ত্রী ফুলি ওরফে ভবতারিনী দেবীর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর ৯ মাস। ভবতারিনীর জন্ম ১৮৭৩ সালে খুলনার দক্ষিণ ডিহির ফুলতলি নামে এক গন্ডগ্রামে। ভবতারিনী দেবীর বাবা, বেণীমাধব রায়চৌধুরী ঠাকুরদেরজমিদারীতে সামান্য বেতনের চাকুরী করতেন। ভবতারিনী নামটা অনেকটা সেকেলে শোনায় বলে রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা নামটা পাল্টিয়ে মৃণলিনী দেবী নাম দেন। আর বিয়েটা কন্যার দুঃস্থ পিতার গ্রামের বাড়ীতে না হয়ে সংঘটিত হয়েছিলজোড়াসাঁকোর বিশাল ঠাকুর বাড়ীতে৯ ইং ডিসেম্বর, ১৮৮৩ সালে। কিন্তু বিয়ের দিন রবীন্দ্রনাথের পিতা, মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ও বড়বোন সৌদামিনি দেবী বিয়ে বাড়িতে ছিলেন না। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, সৌদামিনি দেবীর ঘরজামাই স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় এই বিয়ের দিনেইজোড়াসাঁকোয় নিজের শ্বশুরবাড়ীতে মারা যান।শহুরে জমিদার, সম্ভ্রান্ত ঠাকুর বাড়ীর উজ্জ্বলতম সদস্য, এক সৌম্যকান্তি, বিলেত ফেরত, ২২ বছরের এক আকর্ষণীয় যুবক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায় কপর্দকহীন, অজ পাড়াগাঁয়ের এক পরিবারের প্রায় নাবালিকা, প্রায় অশিক্ষিতা ১৩ বছরের ছোট এক কিশোরীকে কেন বিয়ে করতে হয়েছিল কে জানে? সেটা কি কেবল পিরালী ব্রাম্ভণদের সঙ্গে কলকাতার তথাকথিত “ভদ্র সমাজের” অমিলের ফসল? এই নিরাড়ম্বর আয়োজন ও খোদ বিয়েটা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বেশ আক্ষেপ ছিল বলে শোনা যায়। বিয়ের কার্ডের খামের এককোণে ছাপিয়েছিলেন মধুসূদন দত্তের কবিতার এক লাইন,”আশার ছলনে ভুলি, কি ফল লভিনু হায়”।


বিয়ের ব্যাপারে ভবতারিনী দেবীর শুধু নামটাই পালটানো হয়নি বা বিয়েটা মানানসই জায়গায় সম্পন্ন হবার ব্যবস্থা করেই শেষ হয়নি, ঠাকুরবাড়ীরবধু হিসেবে পরিগণিত হবার জন্য তাঁকে রীতিমত লেখাপড়াশেখাবার ব্যবস্থা হয়েছিল। এর প্রধান উদ্দ্যোক্তা ছিলেন আই,সি,এসসত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী,জ্ঞানদা নন্দিনী দেবী। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কাশ্মিরের পাহাড়ে অবস্থানরত অবস্থায় বৌমাকে যেন লরেটো স্কুলে ভর্তি করা হয়, মাইনে এবং পোশাক আশাকের খরচ বাবদ জমিদারী থেকে মাসিক ১৫ টাকা ভাতা বরাদ্দ করে ছেলেকে চিঠি পাঠালেন। রবীন্দ্রনাথ নিজের উদ্দোগেও স্ত্রীর ইংরেজী শিক্ষার জন্য একজন মেম সাহেব ও সংস্কৃত শিক্ষার জন্য পন্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নকে নিয়োগ করেছিলেন। পাঠশালা শেষ করা মৃণালীনি দেবী এই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশুনা করে তিনি একজন সংবেদনশীল মানুষ ও সংস্কৃতিমনা লেখিকা হয়ে উঠেছিলেন। মুল সংস্কৃত থেকে তিনি প্রায় সমগ্র রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করে এনেছিলেন। মহাভারতের শান্তি পর্বের অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ করার সুযোগ পাননি। বয়সের অধিক তারতম্য, সামাজিক নিদারুণ অসমতা এবং অন্যান্য অলিখিত গভীর ব্যবধানের জন্য মৃণালিণী দেবী রবীন্দ্রনাথের কেবল “ওয়াইফ”ই হতে পেরেছিলেন। কবি নিজের মনের কষ্টে তাঁকে কখনো প্রকৃত “স্ত্রী”র মর্য্যাদা দিয়ে মনের মধ্যে বসাতে পারেন নি। এর উপর বিয়ের মাত্র ৪ মাসের মাথায় কবির প্রেরণাদায়িনী বৌঠান কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করে বসেন। কবির তখন দিগবিদিকজ্ঞ্যানশূন্য অবস্থা।


বিয়ের পর মাত্র ৮ বছরের মধ্যে মৃণালিনী দেবী পর পর পাঁচ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি প্রথম সন্তান পেটে ধারণ করেন। এক সন্তানের পর শরীর ঠিক হয়ে ওঠার আগে বার বার সন্তান ধারণের জন্য মৃণালিনী দেবী শারিরীক ও মানসিক দিক থেকে পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন না। ১৯০১ সালে মাত্র ৫ জন ছাত্র নিয়ে রবীন্দ্রানাথ শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের সূচনা করেন। এই ৫ জনের ২ জন হল তাঁর নিজের দুই পুত্র, রথীন্দ্রনাথ ও শমীন্দ্রনাথ। বয়সে তারা নিতান্তই শিশু। জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বসবাসের পূর্বে ১৯০১ সালের ১৫ইং জুন ও ৫ইং আগষ্টকবি তাঁর দুই কিশোরী কন্যা, ১৪ বছরের মাধুরীলতা ও ১০ বছরের রেণুকাকে বিয়ে দিয়ে দেন। নিজের অল্পবয়সে বিবাহ ও তার ফলের কথা চিন্তা করে মৃণালিনী দেবী বিয়েতে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা রবীন্দ্রনাথের সে কথায় কান দেবার সময় ছিল না। শান্তিনিকেতন চালানোর প্রথম দিকে কবিকে নিরারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে পড়তে হয়। মৃণালিনী দেবী নিজের হাতের বালা খুলে দিয়েছিলেন এবং ঐ অসুস্থ শরীর নিয়ে তাঁকে শান্তনিকেতনের সব রান্না করতে হত। এভাবে তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভালোমত চিকিৎসা করানোর পয়সাও ছিল না। শেষে ১৯০২ সালে অসুস্থ মৃণালিনী দেবীকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আনা হয়। কিন্তু ডাক্তাররা নাকি প্রকৃত রোগ ধরতে ব্যর্থ হয়।  দিনে দিনে তাঁর শরীর খারাপের দিকে যেতে থাকে। তিনমাস ভোগান্তির পর শেষ পর্য্যন্ত ১৯০২ সালের ২৩ শে নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ২৯ বছর।  আর রবীন্দ্রনাথের তখন চলছিল ৪১ বছর ৬ মাস।পুত্র রথীন্দ্রনাথের অনুমান তার মা অ্যাপেন্ডাসাইটস-এ মারা গেছেন।কিন্তু অন্য খবর অনুযায়ী তিনি ষষ্ঠ্য সন্তান নিয়ে অন্তঃস্বত্তা ছিলেন এবং ঐ অবস্থায় এক বাড়ীতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যান। যাই হোক মৃণালিনী দেবীর তিল তিল করে মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি অবহেলা করার জন্য মনে মনে খুবই অনুতপ্ত হোনএবং স্ত্রীর অভাব দারুণভাবে অনুভব করতে থাকেন, অনেকটা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্য্যাদা না বোঝার মতো। তাই তিনি লিখেছেন, “আমি না হয় অন্ধ ছিলুম, তুমি কেন জোর করে কেড়ে নিলে না যা তোমার সত্যিকারের প্রাপ্য ছিল। সময় হলে কেন রাজার মত জানিয়ে দাওনি তোমার প্রবলতম সেই দাবী। ভেঙ্গে ফেললে না কেন ঘরের চাবি। আজ যে সেই মিথ্যার বোঝা আমার সার্থকতার পথ বন্ধ করে দিল”।


মৃনালিনী দেবীদের মোট পাঁচটি সন্তানের মধ্যে ছিল তিন কন্যা ও দুই পুত্র। এদের মধ্যে তিনজন রবীন্দ্রনাথের ৫৭ বছর পার হবার আগেই মারা যায়। বড়মেয়ে মাধুরীলতার ডাকনাম ছিল বেলা বাবেলী। বিয়ে হয়েছিল কবি বিহারীলাল চক্রবর্তির তৃতীয় পুত্র, পেশায় উকিল, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তির সঙ্গে। তিনি স্বামীর কলকাতার বাড়িতেমাত্র ৩১ বছর বয়সে যক্ষারোগে মারা যান ১৬ মে, ১৯১৮ ইং ।


পরেরটি ছিল পুত্রসন্তান- বড়ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রথীর জন্ম হয় ১৮৮৮ সালের ২৭ শে নভেম্বর এবং ২১ বছর বয়সে বিয়ে হয় ১৭ বছরের প্রতিমা দেবীর সঙ্গে , ১৯১০ সালের ২৭ শে জানু্যারীতে। প্রতিমা দেবী গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের ভাগ্নী, বোন বিনয়ীনি দেবীর কন্যা। তার আগে একটা বিয়ে হয়েছিলকিন্তু স্বামী নীলনাথ মুখ্যোপাধ্যায় মারা যাওয়ায় বিধবা হয়ে পড়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথ ও প্রতীমা দেবীর বিয়েটাই ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিবাহ।এঁদের কোন সন্তানাদি হচ্ছিল না। তাই নন্দিনী নামে এক কন্যাকে তাঁরা দত্তক নেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর একসময় তাঁরা আলাদা হয়ে যান। রথীন্দ্রনাথ ১৯৫১ সালের ১৪ ইং মে থেকে ১৯৫৩ সালের ২২ শে আগষ্ট পর্য্যন্ত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য ছিলেন। ১৯৬১ সালের ৩ রা জুন দেরাদুনে ৭২ বছর ৬ মাস বয়সে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। প্রতীমা দেবী আরো কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে প্রায় ৭৬ বছর বয়সে মারা যান।


রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় সন্তান ( দ্বিতীয় মেয়ে) , রেনুকা দেবী বা রাণী-র জন্ম হয় ১৮৯১ সালের ২৩ শে জানুয়ারী। বড়বোন মাধুরীলতার বিয়েরদেড় মাসের মধ্যেই ১৯০১ সালে রাণীর বিয়ে হয় সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্যের সাথে। তার বয়স ছিল তখন মাত্র১০ বছর ৬ মাস। তিনিও মাত্র ১২ বছর ৭ মাস বয়সে যক্ষারোগে মারা যান। রেনুকাও কোন সন্তান সন্ততি রেখে যেতে পারেন নি।


চতুর্থ সন্তান (ছোটমেয়ে)মীরা দেবী, ডাকনাম অতসী-র জন্ম হয় ১৮৯৪ সালের ১২ ইং জানুয়ারী। অতসীর যখন নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৯০৭ সালের ৬ ইং জুনে, তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর ৪ মাস। আরও তের বছর ঘর সংসার করার পর ১৯২০ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়। মীরা দেবী অনেক পরে ১৯৬৯ সালে যখন শান্তিনিকেতনে মারা যান, তখন তার বয়স প্রায় ৭৫ বছর। মীরা দেবীদের দুজন সন্তান ছিল। ছেলে নীতিন্দ্রনাথ ডাক নাম নীতু ও মেয়ে নন্দিতা, ডাকনাম বুড়ি। এই নীতুর জন্ম হয় ১৯১২ সালে। উচ্চশিখ্যার্থে জার্মাণীতে থাকা কালীন যক্ষারোগে ১৯৩২ সালের ৭ইং আগষ্ট,মাত্র ২০ বছর বয়সে মারা যান। তখনও তাঁর বিয়ে শাদী হয়নি। এদিকে রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৭১ বছর চলছে। মীরা দেবীদের একমাত্র কন্যা, নন্দিতা দেবী, বুড়ির জন্ম হয় ১৯১৬ সালে ও বিয়ে হয়কৃষ্ণ কৃপালনির সঙ্গে। তিনি কৃপালনি সাহেবের আগেই ১৯৬৭ সালে ৫১ বছর বয়েসে মৃত্যুবরণ করেন। নন্দিতাদেরও কোন সন্তানাদি হয়নি।


পঞ্চম সন্তান ( দ্বিতীয় পুত্র) সমীন্দ্রনাথ, ডাকনাম সমী-র জন্ম হয় ১৮৯৬ সালের ১২ ইং ডিসেম্বর।মীরা দেবীর বিয়ের মাত্র ছ’মাসের মধ্যেই, যখন তিনি বিহার প্রদেশের মুঙ্গেরে এক বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে যান, সেখানে হঠাৎকলেরায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ১০ বছর এগার মাসের মাথায় মারা পড়েন। তারিখটা ছিল ১৯০৭ সালের ২৩ শে নভেম্বর। পাঁচ বছর আগে ঠিক এই দিনটীতে তিনি মা মৃণালিনী দেবীকে হারিয়েছিলেন।


দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকা অবস্থায় তাঁর সবচেয়ে প্রিয়জনদের ইহজগত থেকে একে একে বিদায় নেবার পালা গুলো নিজের চোখে দেখে যেতে হয়েছে। তাঁর এত বড় বিরাট সংসারের রক্তের সম্পর্কের উত্তরাধীকারি বলতে আর কেউ বেঁচে নেই। বাকী থাকছে ঠাকুর বাড়ীর সঙ্গে আলগা সম্পর্কের, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতীমা দেবীর দত্তক নেওয়া সেই মেয়েটি, যার নাম নন্দিনী ঠাকুর। নন্দিনীর জন্ম হয়েছিল ১৯২২ সালে এবং তাঁর বিয়ে হয় ১৯৩৯সালের ৩০শে জানুয়ারী, গুজরাট থেকে আগত শান্তিনিকেতন হাসপাতালের ডেন্টিস্ট ডাঃ গিরিধারী লালার সঙ্গে। তাঁদের সন্তানের জন্ম হয় কলকাতায়, ১৯৫৩ সালে, নাম সুনন্দন লালা। সুনন্দন এখন “প্র্যাক্সএয়ার” নামে এক বিখ্যাত এক গ্যাস কোম্পানীতে কাজ করছেন ব্যাঙ্গালোরে। তাঁর স্ত্রী শমিতা রবীন্দ্রসঙ্গীত গান।  সুনন্দনদের দুই ছেলে। বড়টী বৌ নিয়ে এখন আমেরিকার আটলান্টায় থাকে। ছোটটী আইনজীবি, থাকে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে।  

Thursday, June 11, 2015

আধুনিক বাঙলা কবিতা // মাহবুব মুহম্মদ

এক বাঙলা কবিতায় আধুনিকতা বিষয়টি কী তা নিয়ে অনেকদিন থেকে আলোচনা চলছে। সঙ্গে চলছে এর অন্তর্নিহিত ভাব কিংবা নির্যাস বের করার নানান চেষ্টা। যে দীর্ঘ কাল-পরিক্রমা নিয়ে আধুনিকতাকে নির্ণয় করতে হয়, বলতে গেলে সাহিত্যে সেই আধুনিকতা হঠাৎ করেই হাজির হয় নি। আর সাহিত্যের ধারাবাহিক গতি-প্রকৃতি একে বিস্তৃতি ঘটিয়েছে কবিতায়ও। ফরাসি বিপ্লব থেকে যে ইউরোপীয় আধুনিকতার জন্ম; সাহিত্যের প্রবাহিত ধারাবাহিকতায় সেটি প্রভাব বিস্তার করেছে ধীরগতিতেই। এর সঙ্গে কাজ করেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ নানান পরিবর্তন। তবে বাঙলা সাহিত্যে আধুনিকতা নামক ধারণা’র হাওয়া লেগেছে অনেক পরে; ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। আর কবিতায় এসেছে আরও পরে, বলতে গেলে বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে। কিন্তু বাঙালির আধুনিকতার রুদ্ধ ধারাটি মুক্ত করার প্রথম মানস-প্রতিভা ধারণ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝিতেই। আর রবীন্দ্রনাথ এসে সে মুক্ত প্রতিভাকে দিয়েছিলেন তীব্র স্রোত। তবে মাইকেল কিংবা রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় সেই আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছিলেন ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের ক্ষুদ্র বলয় থেকে বেরিয়ে বাঙলা কবিতা তখনও আধুনিকতাকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করেনি। আর তাই মাইকেল থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কবিতা ছিল পরবর্তী তিরিশের দশক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শব্দগঠন, ভাষার শৈলী-বৈচিত্র্য, চিত্রকল্পের অনুভূতি প্রকাশের বিষয়ও ছিল আলাদা। বলতে গেলে মাইকেল থেকে রবীন্দ্র(রবীন্দ্রনাথের পুরো কাল নয়; ১৮৬১-১৯০০ খৃষ্টাব্দ) সময় পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্যের জন্য ছিল আধুনিকতার প্রস্তুতিকাল। এই সময়েই আধুনিকতা প্রস্তুত হচ্ছিল তিরিশের জন্য। তিরিশের দশকের কবিদের হাতেই বাঙলা কবিতা ইউরোপীয় আধুনিকতাকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে। এর পূর্বের কবিরা আধুনিকতাকে ধারণ করেছিলেন বিচ্ছিন্নভাবে। বিচিত্র প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমও ছিল প্রায় সম্পর্কশূন্য। কিন্তু তিরিশের দশকের কবিরাই প্রথম আধুনিকতাকে ব্যক্তির উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। কবিতায় গ্রহণ করেছিলেন সমগ্রতাকে। কোন এক নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তাদের ভাব-উপলব্ধি আবদ্ধ থাকেনি। সবকিছুকে ধারণ করেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিন্তু প্রকাশ করেছিলেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। আর প্রত্যহ-জীবনের নানান উপলব্ধিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করারই ছিল বিংশ শতকের আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে প্রকাশ-রীতির মধ্যেই যে আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছিল পরিপূর্ণরূপে তা নয়, বরং এর অন্তনিহিত ভাবও ছিল কবির একান্ত নিজস্ব বিষয়। উদাহরণ তিরিশের কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকেই দেই- আমি সব দেবতারে ছেড়ে/ আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি/বলি আমি এই হৃদয়েরে;/সে কেন জলের মত ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়।......পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ/ চায় না সে?-করেছে শপথ/ দেখিবে সে মানুষের মুখ?/ দেখিবে সে মানুষীর মুখ?/দেখিবে সে শিশুদের মুখ?/চোখে কালোশিরার অসুখ/কানে যেই বধিরতা আছে? (বোধ; জীবনানন্দ দাশ) ব্যক্তি যে নিজের মধ্যেও স্বতন্ত্র, সেই পৃথক নিজস্ব ভাবনা ও সত্ত্বাকে খোঁজে বেড়ানোই হলো আধুনিকতা। আর এই আধুনিকতায় দেবতা থেকে যেন ব্যক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। দুই প্রাচীন কিংবা মধ্যযুগের সাহিত্যে বেদনাবিদ্ধ উপলব্ধির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটলেও চিত্রকল্প অনুভূতির প্রকাশ এতোটা জোরালো ছিল না যতোটা আধুনিক কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। বলতে গেলে, উপলব্ধিকে নিজস্ব ভঙ্গিমায় প্রকাশ বা চিত্রকল্পের অনুভূতিই আধুনিক কবিতাকে আলাদা করেছে প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যের সীমারেখা থেকে। তবে মধ্য বা প্রাচীন সাহিত্যে চিত্রকল্পের অনুভূতি বা অভিজ্ঞতার জোরালো প্রকাশ যে একেবারেই ঘটে নি মোটাভাবে তা বলা যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই এটি প্রকাশ পেয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে; অনেকটা আধুনিকতার মতো। তবে শৈল্পিকতার স্বতঃস্ফুর্ততা আর একজন কবি মনের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনার প্রকাশ কিন্তু এক নয়। দুটি ভিন্ন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এর অভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ হিশেবে বৈষ্ণব পদাবলীর কথা বলা যেতে পারে। ধর্মকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগের এই পদাবলী রচিত হলেও ভাষার শৈলী-বৈচিত্র্য, অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশই এটাকে আধুনিকতায় নিয়ে গেছে। উদাহরণ দেই- সখি কেমনে ভুলিব হিয়া/ আমারই বধূআ আন বাড়ি যায়/ আমারই আঙিনা দিয়া। (বিদ্যাপতি) আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য যদি হয়ে থাকে শৈল্পিক ভাবনা আর চিত্রকল্প অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, তবে বৈষ্ণব পদাবলীর অনেক পদেই আধুনিকতার প্রভাব লক্ষণীয়। কিন্তু মধ্যযুগের সাহিত্য বলেই কি কেবল পদাবলীকে আধুনিক হওয়া থেকে অস্বীকার করছি আমরা? অবশ্যই না! প্রথমেই বলেছি, আধুনিকতা কখনও কোন কিছুকে বিচ্ছিন্নভাবে গ্রহণ করে না। সমগ্রকে নিয়েই তার অবস্থান। বৈষ্ণব পদাবলীতে একদিকে যেমন প্রকাশ পেয়েছে জীবন-উপলব্ধির একচ্ছত্র ভাবনা-চিত্রের স্বতঃস্ফূর্ততা, অন্যদিকে পেয়েছে এর ধর্মীয় তত্ত্বকথা। অর্থাৎ বৈষ্ণব পদাবলীতে শৈল্পিকতার স্বতঃস্ফূর্ততা ঘটলেও কবির মানস-প্রকৃতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে ছিল ধর্ম-চেতনা। ধর্মকে উদ্দেশ্য করেই বৈষ্ণব পদাবলী রচিত। তাই বৈষ্ণব পদাবলীর আঙ্গিকগত দিক আধুনিক হলেও এর বিষয়বস্তু ছিল সম্পূর্ণ ধর্মাশ্রিত। তিন আধুনিক কবিতা বলতে অনেকেই গদ্যছন্দকে বুঝে থাকেন। আবার অনেকে মনে করেন, আধুনিকতা নামক নির্মম ধারা কবিতাকে তার মৌলিক আদর্শ থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে গেছে। কিন্তু এ ধারণা অনেকাংশেই ঠিক নয়। আধুনিক কবিতা সময়ের ব্যবধানে আর সাহিত্যের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একটি নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করে নিলেও তার মৌলিকতার বিচ্যুতি হয়েছে; এমন ধারণা মনে করার কোন কারণ নেই। বিশেষ করে, কবিতার অনুভূতি বা চিন্তাস্পর্শের কোন মৌলিকতাই আধুনিক কবিতার কোন মৌলিক বিষয়কে ম্লান করেনি। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক যুগের কবিতাই যেমন একটি ধারা সৃষ্টি করে নেয়, সে দৃষ্টি আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই বাঙলা কবিতা-সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্র সময় পর্যন্ত যে-কবিতা ছিল প্রতিনিধিত্বমূলক; তিরিশের আধুনিক কবিদের হাতে এসে হয়ে গেল সেটি সম্পূর্ণ ব্যক্তি চিত্তের অনুভূতি প্রকাশ। যার ফলে আধুনিক কবিতা হয়ে উঠলো আধুনিক কবিদের ব্যক্তি উপলব্ধির লীলা-চৈতন্যের সহচর। তবে এটাও ঠিক যে আধুনিক কবিতা সকল মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না, একটি নির্জন একান্ত উপলব্ধি-প্রতীক হয়ে ওঠে আধুনিক কবিতা। চার ব্যক্তি হৃদয়ের ভাবের দ্যোতনা, চিন্তা বা অন্তর-অনুভূতির কথাগুলো যখন একটি নির্দিষ্ট শৈল্পিকতার মধ্যদিয়ে প্রকাশিত হয় তখনই তা হয়ে ওঠে আধুনিক কবিতা। তবে বিশেষ করে, কবিতা বা গদ্য সাহিত্যের বেলায় আধুনিকতা বিষয়টি তার পূর্ববর্তী রচনার ওপর কিছুটা হলেও নির্ভর করে। এক্ষেত্রে, সাহিত্যের যে দীর্ঘ ইতিহাস কালের স্রোতে প্রবাহিত, সে বহমান ধারায় কবিতা কতটুকু আধুনিক তার একটি তুলনামূলক প্রশ্ন রয়েই যায়। তাই সময়ের ব্যবধানে আধুনিকতার বিষয়টি তার সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে। একে রুখা যায় না। সম্ভবও নয়। তার আপন ধারায় মধ্যদিয়ে সে প্রবাহিত হয়। একমাত্র আধুনিক কবিতায় একজন কবি পারেন তার মনের চিরচেনা সাধারণ কথাগুলোকে এক উচ্চমার্গীয় শৈল্পিক প্রতিভার দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ ঘটাতে। আর 'শৈল্পিকতার স্বতঃস্ফূর্ত' প্রকাশই আধুনিক কবিতাকে মধ্য বা প্রাচীন যুগের কবিতা থেকে করেছে ভিন্ন। যার ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি তার ধারাবাহিক শিল্প-উপলব্ধি’র বিকাশ ঘটিয়েছে কবিতায়, বীজ বপন করেছে সংস্কৃতি মননের। তবে জ্ঞান,বুদ্ধি বা চিন্তার আশ্রয়ই কেবল শিল্পের প্রকাশ নয় বরং শিল্পের স্পর্শে এসেই জ্ঞানের স্ফুরণ আর বুদ্ধির তীক্ষ্ণ প্রকাশ ঘটেছে আধুনিক কবিতায়। এই উপলব্ধিবোধ থেকে হয়তো জীবনানন্দ দাশ বলেছেন-‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি।’ তাই কবি হৃদয়ের চিত্রকল্পের অভিজ্ঞতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশই ব্যক্তির কথাকে কবিতায় রূপান্তরিত করে। তবে কথা হলো- শিল্পের প্রকাশই কবিতা নয়; বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাব-অভিজ্ঞতা আর দৃশ্য কল্পনার এক অদৃশ্য ধারাবাহিক বন্ধন। এই বন্ধনের ক্ষমতা খুব অল্প সংখ্যক কবির মধ্যে বিরাজ করে যার ফলশ্রুতিতে তদের কবিতা হয়ে উঠে মহৎ। যদি এভাবে বলা যায়-একজন কবি যখন তাঁর পৃথিবীর সর্বময় অন্তর্নিহিত কথাকে -যা তিনি বুঝাতে চান তা- যখন একটি নির্দিষ্ট শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করেন তখনই তা কেবল কবিতা হয়ে ওঠে। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে- শিল্পের মূল্য যদি হয় ব্যক্তি-বিশেষের কাছে ভিন্ন, তবে শিল্প কি আপেক্ষিকতার পরিচয় দেয়? উত্তরে বলা যায়- আপেক্ষিকতার প্যাঁচে না জড়িয়ে শিল্পকে সর্বজনীনভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। তবে তার ব্যবহার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে ভিন্ন আবেদন আনতে পারে। সৃষ্টি করতে পারে আঙ্গিক বৈচিত্র্যের স্বতন্ত্র ধারাবাহিকতা। আর এ উপলব্ধিবোধ থেকে হয়তো কবিকে জ্ঞানস্রষ্টা না হলেও চলে, তবে তাকে শিল্পস্রষ্টা অবশ্যই হতে হয়। কেননা শিল্পের মধ্যে সবকে প্রকাশই হল একজন যথার্থ আধুনিক কবির কাজ।

কবিতায় চিত্রকল্প

ইমেজ বা চিত্রকল্প কবিতার অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ ও উপাদেয় উপাদান বটে, কিন্তু তা কোনো অর্থেই কবিতার বহিরঙের বিষয় নয়৷ ইমেজ হচ্ছে কবিতার অনত্মর্গত বিষয়ক, যা যুবতী নারীর বুকে বেড়ে ওঠা সত্মনযুগলের মতোই সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত৷ হেলাল আহমেদ

কবিতায় কবির উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতাকে কখনো সংহতি, কখনো ব্যপ্তি ও বৈচিত্র্য দানের প্রয়োজনেই চিত্রকল্পের জন্ম৷ এখানে মনে রাখা প্রয়োজন ‘চিত্রকল্প’ বিচ্ছিন্নভাবে কবিতা নয় বটে, কিন্তু কবিতার উপাদেয় উপকরণ৷ ইংরেজি ভাষার ‘ইমেজ’ এবং বাংলা ভাষার ‘বাক-প্রতিমা’ কথাটিও চিত্রকল্পের সমার্থক শব্দ৷ প্রকৃত অর্থে ‘চিত্রোপমা’ বলতে যা বোঝায় তা-ই হচ্ছে মূলত ইমেজ৷ এ ইমেজ হচ্ছে কবি আত্মার গূঢ় সঙ্কেতনির্ভর৷ ইমেজে থাকে ইন্দ্রীয়বেদ্য অনুভূতির প্রকাশ৷
তবে ইমেজ কেবল সাধারণ চিত্র বা ছবি নয়৷ ইমেজ হচ্ছে আমাদের ইন্দ্রীয় চেতনার দৃষ্টি, শ্রম্নতি, স্পর্শ, ঘ্রাণ, স্বাদ ইত্যাদির উদ্বোধক৷ ইমেজ এক ধরনের ‘চিত্রোপমা’ সম্ভবত এ কারণেই চিত্রোপমা প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘উপমাই কবিত্ব’৷ ইমেজ চিত্রোপমা বটে, কিন্তু ইমেজে অন্যান্য অলঙ্কারও পরস্পরিত হয়ে থাকে৷ স্মর্তব্য, রবীন্দ্রনাথের উপমার বিশেস্নষণ প্রসঙ্গে কবি সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর উক্তি : উপমা, উত্‍প্রেৰা, চিত্রকল্প এমনকি প্রতীকের সবগুলোই উপমার অভিজ্ঞানের মধ্যে ধরে নিতে হবে৷ শুধু ‘মতো’ থাকলেই উপমা হলো তা নয়, ভাব যেখানে ছবি হয়ে উঠেছে, চিনত্মা যেখানে স্পর্শসহ রূপ নিল, সেখানেই কোনো না কোনো, সূক্ষ্ম, চতুর, লুক্কায়িত উপায়ে উপমার ব্যবহার অনিবার্য৷ কবিতায় কবির শ্রবণগ্রাহ্য অভিজ্ঞতাকে ও বক্তব্যকে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপদানের প্রয়োজনে চিত্রোপমা বা ইমেজের ব্যবহার অপরিহার্য৷ ইমেজের ফলেই কবিতার শ্রম্নতিগ্রাহ্য অনুভূতি গুচ্ছ ভিজু্যয়াল সামগ্রীর উপাদেয় উপকরণ হয়ে ওঠে৷ সে কারণেই বাংলা কাব্যে ইমেজের ব্যবহার এমন পৌনঃপুনিক৷ কয়েকটি দৃষ্টানত্ম :
হায়রে যেমতি/স্বর্ণচূড় শস্যৰত কৃষিদল বলে,/পড়ে ৰেত্রে, পড়িয়াছে রাৰসনিকর/রবিকুল রবি শূর রাঘবের শরে৷ (মেঘনাদবধ কাব্য, প্রথম সর্গ; মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
বসিলা যুবতী/পদতলে, আহা মরি, সুবর্ণ দেউটি তুলসীর মূলে যেন জ্বলিল৷
(ওই, চতুর্থ সর্গ, ওই)
ঘুমের মতো মেয়েগুলি/চোখের কাছে দুলি দুলি/বেড়ায় শুধু নূপুর রণরণি (মাতাল: ছবি ও গান; রবীন্দ্রনাথ)
কুহেলী গেল, আকাশে আলো দিল যে পরকাশি/ধূর্জটির মুখের পানে পার্বতীর হাসি৷ (সাগরিকা : মহুয়া, ওই)
বক্র শীর্ণ পথখানি দূর গ্রাম হতে/শস্যৰেত পার হয়ে নামিয়াছে স্রোতে৷ তৃষ্ণার্ত জিহ্বার মতো৷ (সুখ: চিত্রা; ওই)
সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা/অাঁধারে মলিন হলো, যেন খাপে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার৷ (বলাকা : বলাকা; ওই)
হাওয়ার মুখে ছুটলো ভাঙা কুঁড়ের চাল/শিকল ছেঁড়া কয়েদী ডাকাতের মতো৷ (পৃথিবী: পত্রপুট, ওই)
অাঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে/অাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি;/পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা/অনাঘ্রাতা পূজার ফুল দুটি৷ (নিদ্রিতা: সোনার তরী; ওই)
ছায়াখানি রক্তপদতলে/চু্যত বসনের মতো রহিল পড়িয়া;/অরণ্য রহিল সত্মব্ধ, বিস্ময়ে মরিয়া\\ (বিজয়িনী : চিত্রা; ওই)
নিকপিক করে ৰীণ কাঁকাল/পেশোয়াজ কাঁপে ঢালমাটাল/গুরম্ন উরম্নভাবে তণু নাকাল,/টলমল অাঁখি জল বোঝাই৷ (নওরোজ : জিঞ্জির, নজরম্নল) নজরম্নলের আরেকটি চিত্রকল্পে পাচ্ছি : ‘কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে৷ আকাশের নীল গাঙে/ হাবুডুবু খায় তারা বুদ্বুদ্’৷
কি আশ্চর্য দীপাবলী জ্বেলেছো চারদিকে/বাহুমূলে চিবুকে গ্রীবায়/এমনকি ভ্রমরকৃষ্ণ খোঁপায় রেখেছো জ্বেলে/আলোর উত্‍সব৷/দু’চোখ নামালেই দেখি/বুকের দু’পাশে জ্বলে উজ্জ্বল আলোক সত্মম্ভ (ডুবে যাচ্ছি : প্রেমের কবিতা, আহসান হাবীব)
নীলপদ্ম যেমন করে দল মেলে/তেমনি করে তোমার চিঠির নীল খাম/ আমার হাতের মধ্যে খুলে গেল৷ (নীল খাম : ওই, ওই)
চৈতন্যের আলো পড়ে ঘুম-পাওয়া সত্তার পাপড়িত্বে/সূর্যের চুমোয় লাল পা-ুগাল৷ টেবিলের দু’টি/তরম্নণ কমলালেবু চেয়ে আছে দূরের আকাশে,/ চিকন সোনালি রম্নলি ম্রিয়মান শঙ্খ সাদা হাতে/যেন বেদনায় স্থির_ মনে হলো সেই দু’টি হাত৷ মায়াবী নদীর ভেজা সোনালি বালিতে আছে পড়ে৷ (তার শয্যার পাশে : প্রেমের কবিতা, শামসুর রাহমান)
দুর্লভ মনির মতো সত্মন/ ঘন হলো বাসনার তাপে, যেমন গ্রীষ্মের ফল/ গাঢ় হয় সূর্যের চুম্বনে৷ (সুন্দরের গাথা : প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে; ওই)
তোমার ভালোবাসায় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ যেমন নিঃঝুম দুপুরে৷ সুন্দরীর গায়ের কাছে বেড়াল : সমর্পিত, দ্বিধাহীন ও তৃপ্ত৷ (জাগরণ : যেহেতু জন্মান্ধ; আবু হেনা মোসত্মফা কামাল)
হলদ বলে না কথা, সে থাকে এ্যাম্বুশ করে চুপ/অতর্কিত ছুটে এসে পাতার শরীরে৷ নিজের স্বাৰর এঁকে যায়৷ (যুদ্ধ : কেউ কিছুই জানে না, অরম্নণাভ সরকার)
সন্ধ্যা স্নানসিক্ত তোমার চুল বেয়ে নেমে আসতো/পাতা বাহারের ঝোপের ওপর৷ (চোখের ভেতর অলিম্পন : বদ্ধমাতাল রোদে, জাহাঙ্গীর ফিরোজ)
একজনের দুই উরম্নর ফাঁকে মাংসল সঙ্গীন/অন্যের বিপরীত দেশে হরতন/ হরতনের বুকে সঙ্গীনের খোঁচা৷ সঙ্গীন থেকে বেরোল টোটা৷ টোটায় টোটায় পস্নাবিত হলো নদী/নদী হয়ে উঠলো নগ্ন নধর কানত্মি৷ ওম শানত্মি৷ ওম শানত্মি৷ ওম শানত্মি৷ (নগ্ন নধর কানত্মি আমরা তামাটে জাতি; মুহম্মদ নূরম্নল হুদা)
গহীন জঙ্গল থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা নাচের আদলে/ তোমার দেহের প্রতিটি ভাঁজ পাপড়ি মেলে দেয়৷ (রাত্রিবাস : বদ্ধ মাতাল রোদে, জাহাঙ্গীর ফিরোজ)
তুমি যে ল্যাবের ব্যাঙ/আলপিনে গাঁথা/ক্লোরোফরম মুখে নিয়ে বেদনা রহিত/অনিবার্য ঘুমে৷ (ধুলো : চিত্রল প্রতিবেদন, রনজু রাইম)
কবি রবীন্দ্রনাথ কবি জীবনানন্দ দাশের চিত্রকল্পসমৃদ্ধ কবিতা পাঠ করে তার ভেতর তাকিয়ে দেখার আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন৷ জীবনানন্দ দাশের কবিতা পূর্বাপর চিত্রকল্পসমৃদ্ধ৷ কয়েকটি দৃষ্টানত্ম:
হেমনত্মের মাঠে-মাঠে ঝরে/শুধু শিশিরের জল;/অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে৷ হিম হয়ে আসে/বাঁশপাতা_ মরা ঘাস_ আকাশের তারা;/বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা; (পেঁচা: ধূসর পা-ুলিপি) শ্যামার নরম গান শুনেছিল_ একদিন অমরায় গিয়ে/ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়/বাংলার নদী মাঠ ঘাসফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়৷ (বাংলার মুখ আমি : রূপসী বাংলা) চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,/মুখ তার শ্রাবসত্মীর কারম্নকার্য৷ (বনলতাসেন : বনলতা সেন) এই কথা বলেছিল তারে_/চাঁদ ডুবে চলে গেলে_ অদ্ভুত অাঁধারে/ যেন তার জানালার ধারে/উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিসত্মব্ধতা এসে৷ (আট বছর আগের একদিন : মহাপৃথিবী)
হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্টরোগী চেটে নেয় জল;/অথবা সে হাইড্র্যান্ট হয়তোবা গিয়েছিল ফেঁসে৷/এখন দুপুর রাত-নগরীতে দল বেঁধে নামে৷/ একটি মোটর কার, গাড়লের মতো গেল কেশে/অস্থির (পেট্রোল ঝেড়ে, (রাত্রি : সাতটি তারার তিমির)
ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলা,_/ডালিম ফুলের মত ঠোঁট যার, রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,/চুল যার শাঙনের মেঘ, আর অাঁখি গোধূলীর মতো গোলাপী রঙিন৷ (ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল : ঝরা পালক)
ইমেজ বা চিত্রকল্প কবিতার অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ ও উপাদেয় উপাদান বটে, কিন্তু তা কোনো অর্থেই কবিতার বহিরঙের বিষয় নয়৷ ইমেজ হচ্ছে কবিতার অনত্মর্গত বিষয়ক, যা যুবতী নারীর বুকে বেড়ে ওঠা সত্মনযুগলের মতোই সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত৷

চিত্রকল্পের জানালায়ঃ সূচনা পর্ব // কে এম রাকিব

ভূমিকা পর্বের ভূমিকা :

যদি বলা হয় বকধার্মিক, তাহলে ভাষা সচেতন ব্যক্তির মনে কি সেই একপায়ে দাঁড়ানো বকটির ছবিই ভেসে ওঠে না? -যার ধ্যানী সুলভ মূর্তি, ভাবখানা এমন দুনিয়ার কিছুতেই আগ্রহ নাই, কিন্তু মওকা পেলেই যে ২-১টি মাছ ছো মেরে নিয়ে যাবে জলাশয় থেকে? কিংবা গড্ডলিকা প্রবাহ বলা মাত্র কি মনে পড়ে না গড্ডলের (ভেড়ার) সেই নির্বোধ অনুকরণ প্রবাহের দৃশ্য?
আমরা সংবেদী অঙ্গের (sensory organ) ব্যবহার করে বাগধারা কিংবা যেকোন শব্দবন্ধের অর্থ আরো সম্যক ভাবে উপলব্ধি করি। কারন তা আমাদের কল্পনাকে উসকে দেয়। তাই বকধার্মিক বলতে শুধু ভন্ডই বুঝি না, কিংবা গড্ডলিকা প্রবাহ বলতে অনেকের বিবেচনাহীন জোয়ারে গা ভাসানোই বুঝি না, আরো বেশি কিছু অনুভব করি।

এই যে শব্দের চিত্রধর্মিতার মাধম্যে অন্যের সাথে যোগাযোগ এটা আধুনিক কবিদের এক বড় হাতিয়ার। তাই চিত্রকল্প আধুনিক কবিতার এক অনিবার্য উপাদান। এ যুগে চিত্রকল্প ছাড়া কবিতা কল্পনা করাও কঠিন। সব কবিই এ যুগে চিত্রকল্প ব্যবহার করে থাকেন, কেউ সচেতনভাবে, কেউবা অসচেতনভাবে। কারন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান বলছে, ভাষা যত আধুনিক হচ্ছে তত এর প্রতীকধর্মীতা ও চিত্রধর্মীতা বাড়ছে। তাই কবিতায় এর প্রভাব পড়বে বই কি! চিত্রকল্পের সাথে পরিচিত থাকাটা তাই জরুরী হয়ে পড়ে। ‘চিত্রকল্পের জানালায়’ লেখায় চিত্রকল্পের জানালা দিয়ে কবিতার আকাশে উঁকি দিতে চেষ্টা করা হবে। আশা করা যায়, ৪/৫ টি পর্বের মধ্যে আলোচনা শেষ করতে পারব। প্রথম পর্বে ভূমিকা থাকল। এর পর, কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যবহার, চিত্রকল্পের বিবর্তন, মূর্ত, বিমূর্ত ও উত্তরাধুনিক চিত্রকল্প, চিত্রকল্পের মানসিক অভিঘাত, চিত্রকল্প ব্যবহারের কৌশল ও নানা দিক প্রভৃতি আলোচনার ইচ্ছা থাকল। ক্রমবর্ধমান পড়াশোনার চাপ ও নিজের কিংবদন্তি-পর্যায়ের আলস্যের কথা মনে রেখেও শুরু করলাম! দেখা যাক।

চিত্রকল্পঃ There are pictures in poems and poems in pictures [Chinese Proverb]

চিত্রকল্প শব্দটি বাংলায় সাধারণত Image এর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাহিত্য সমালোচকদের কেউ কেউ image-এর অন্য বাংলা প্রতিশব্দ প্রস্তাব করেছেন, যেমনঃ সুশীলকুমার গুপ্ত ‘ভাবরূপচিত্র’ সত্যেন্দ্রনাথ রায় ‘মানস প্রতিবিম্ব’ অমলেন্দু বসু ‘বাকপ্রতিমার এছাড়া ‘বানী শিল্প’ ‘রূপকল্প’ ‘শব্দকল্প’ ইত্যাদি নামও পাওয়া গেছে। তবে চিত্রকল্প নামটিই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বেশি।

উইন্ডহ্যাম লুইস চিত্রকল্পকে কবিতার ‘Primary pigment‘ অর্থাৎ প্রাথমিক রঞ্জক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার চিত্রকল্পকে কবিতার প্রাণ বলে অভিহিত করেছেন স্টিফেন জে. ব্রাউনঃ This must surely be obvious as regards poetry: imagery is its very life.

কবিরা খুবই সংবেদনশীল হয়ে থাকেন। কবির সংবেদনের গভীরে লুকিয়ে থাকে অভিজ্ঞতার নির্যাস ও সৃষ্টিশীল আকাঙ্ক্ষা। এই অভিজ্ঞতা যখন অসাধারণ শব্দচিত্রের মাধ্যমে কবিতায় বহুমাত্রিক বোধ উৎপন্ন করতে সক্ষম হয় তখনই তাকে চিত্রকল্প বলে অভিহিত করা যায়।
চিত্রকল্প নিয়ে আলোচনার আগে এর ইতিহাস আগে দেখে নেয়া যেতে পারে।

চিত্রকল্পের ধারনাঃ
চিত্রকল্পের ধারনাটি এসেছে আধুনিক সময়ে। প্রাচীন আলংকারিক ভাষার চিত্রধর্মিতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, বর্নাঢ্য চিত্রকল্পের জন্মও দিয়েছেন। কিন্তু তারা চিত্রকল্পের চরিত্র নিয়ে ভেবেছেন বা ব্যাপক নিরীক্ষা করেছেন বলে মনে হয় না। চিত্র সৃষ্টির প্রবণতা বহু প্রাচীন। প্রাচীন কবি বক্তব্যের বিষয়টিকে অলংকারপূর্ণ মাহাত্ম্যে পরিবেশন করার জন্য শব্দচিত্র সৃষ্টি করেছেন। একটি প্রাচীন কবিতায় আছেঃ

স্তন যুগমশ্রুস্নাত সমীপতরবর্ত্তি হৃদয়শোকাগ্নে।
চরতি বিমুক্তাহারাং ব্রতমিব ভবতো রিপুস্ত্রীনাম।।
অর্থাৎ হৃদয়ে যে শোকের আগুন জলছে তার খুব নিকটবর্তী ও হারবিমুক্ত এবং অশ্রু স্নাত স্তন যুগল যেন নিজের শত্রু-স্ত্রীদের বৈধব্য ব্রত পালন করছে।

প্রাচীন কবিতায় কাহিনীর প্রয়োজনে প্রচুর শব্দ চিত্র আকতে হয়েছে কবিদের। কিন্তু চিত্রকল্পকে কেন্দ্র করে প্রথম কাব্য-আন্দোলনের সূত্রপাত হয় পাশ্চাত্যে ১৯০৮ সালে। বিশ শতকের শুরুরর দিকে ইল্যান্ডে এজরা পাউন্ডের নেতৃত্বে আন্দোলন ঘটে তাকে সমালোচকেরা ইমেজিসম বা চিত্রকল্পবাদ বলে থাকেন। টি. ই হিউম ছিলেন পাউন্ডের প্রধান সহযোগী। এছাড়া উইন্ডহাম লুইস, এমি লোয়েল, হ্যারিয়েট মনরো এর সহ অনেকে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।

ইমেজিস্ট কাব্য আন্দোলনের সাথে জড়িতরা কবিতার বিষয় ও আঙ্গিক সম্পর্কে নির্দিষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। সাহিত্যের একটি বিশ্বকোষ চিত্রকল্পের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এজরা পাউন্ডের বক্তব্য তুলে ধরেছেঃ
1. Direct treatment of the ‘thing’ whether subjective or objective
2. To use absolutely no word that does not contribute to the presentation
3. As regarding rhythm: to compose in the sequence of the musical phrase, not in the sequence of a metronome.
(ইশতেহার দিয়ে সাহিত্য বা কবিতা হয় কিনা,সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। আমাদের আলোচনা যেহেতু, ইমেজ বা চিত্রকল্প কেন্দ্রিক তাই ইমেজিস্ট মুভমেন্ট সম্পর্কে উল্লেখ করা)
১৯১৩ সালের মার্চে এফ. এম. ফ্লিন্ট এবং এজরা পাউন্ড মার্কিন পত্রিকা ‘পোয়েট্রি’র পাতায় উপর্যুক্ত আন্দোলনের মূলনীতি প্রকাশ করেন। তারা কবিতায় বস্তুগত বা ভাবগত যেকোন বিষয়ে শব্দের প্রত্যক্ষ ও শব্দের সঠিক ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন।

ইমেজিস্টদের প্রতিনিধিত্বমূলক দুটি কবিতা দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রায়শই উল্লেখ করা হয়ঃ
A touch of cold in the autumn night
I walked abroad,
And saw the ruddy moon lean over a hedge
like a red faced farmer.
I didn’t not stop to speak, but nodded;
and round about were the wishful stars
with white faces like town children.
[T. E. Hulme, Autumn]
শীতের আলতো ছোঁয়া হেমন্তের রাতে
বাইরে হাঁটছিলাম আমি
দেখলাম টুকটুকে চাঁদ
লালমুখো চাষীর মতো,
আমি তাকে থামতে বলিনি কথা বলতে
তবে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম শুভরাত্রি
শহরের শিশুদের মত শুভ্র মুখ
চারদিকে তৃষ্ণার্ত নক্ষত্র।
(হুমায়ুন কবির-এর অনুবাদ অনুসরণে সরকার আমিনের অনুবাদ)

ইমেজিস্ট আন্দোলনের সদস্য এডোয়ার্ড স্টোরার কবিতাঃ

Forsaken Lovers,
Burning to a chase white moon,
Upon storage pyres of loneliness and drought.
পরিত্যক্ত প্রেমিকেরা
সহজ শুভ্র চাঁদের নিচে
একাকিত্ব ও শুষ্কতার আধার চিতার ওপর জ্বলছে।
(হুমায়ুন কবির-এর অনুবাদ অনুসরণে পোস্ট দাতার অনুবাদ)

উপর্যুক্ত দুটি কবিতাই ইমেজিস্টদের মানসিকতাকে প্রকাশ করে। আরো প্রকাশ করে চিত্রকল্পের অনেক বৈশিষ্ট্য যেমনঃ কবিতায় শব্দে আঁকা চিত্রমাত্রই চিত্রকল্প নয়। ‘চিত্রশিল্প যেমন শুধু চোখকে তৃপ্ত করে না, উদ্বুদ্ধ করে কল্পনাকেও, জন্ম দেয় তৃতীয় মাত্রার- চিত্রকল্পও তেমনি তৃতীয় মাত্রার জনয়িতা’ তার মানে চিত্রকল্পের চিত্রাতীত নান্দনিকতা ও চিত্রাতীত বাস্তবতা থাকে। সেনসিবিলিটি, সময় চেতনা, চিন্তার নরম আলো থাকে উৎকৃষ্ট চিত্রকল্পের মধ্যে।

চিত্রকল্প ও প্রতীকঃ
চিত্রকল্প ও প্রতীকের মধ্য মিল থাকলেও এরা আলাদা। যে কোন শব্দই সংকেতের কাজ করে। প্রতীকের করে, আরো ফোকাসড হয়ে। কিন্তু প্রতীকের মধ্যে গতিশীলতা নাই, যা আবার চিত্রকল্পের প্রাণ। এছাড়া চিত্রকল্পের উদ্বুদ্ধকরণ শক্তি অনেক বেশি। চিত্রকল্পের সাংকেতিক ক্ষমতাও বেশি কেননা এর রয়েছে দৃশ্য নির্মাণের প্রশস্ত ভূমি।
চিত্রকল্প আলাদা কোন অলংকার নয়ঃ
অনেকে চিত্রকল্পকে আলাদা একটি অলংকার বিবেচনা করলেও চিত্রকল্প আলাদা কোন অলংকার নয়। বরং এটি একাধিক অলংকারের নির্যাস। চিত্রকল্পে থাকতে পারে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক ইত্যাদি অর্থালংকার থাকতে পারে থাকতে পারে যেকোন শব্দালংকারও। তবে কবিদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় একটি সাদৃশ্য মূলক অলংকার উপমা, কারন এই অলংকারের রয়েছে চিত্রময়তা ও অন্তর্গত ভাবকে মূর্ত করার অনুপম ক্ষমতা। তাই চিত্রকল্পকেও উপমার ব্যবহার বেশি।

চিত্রকল্পকে সবসময় দৃশ্যমান হতে হবে এমন কোন কথা নেইঃ
দৃশ্যমানতা চিত্রকল্পের সবচেয়ে বড় গুন হলেও চিত্রকল্পকে সবসময় প্রকটভাবে দৃশ্যমান হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। শুধু চোখ নয়, কান, জিভ ও স্পর্শ ইন্দ্রিয় ও অনুপ্রেরণা পারে জাগাতে। এমনকি মানুষের বিশ্বাস ও যাপন থেকেও অস্পষ্ট, বিমূর্ত অবয়ব কিন্তু যা বোধ ও চেতনাকে স্পর্শ করে যায় এমন চিত্রকল্প সৃষ্টি হতে পারে। এমন কি একই সাথে একাধিক সংবেদী অঙ্গকে ছুঁয়ে যেতে পারে কবির বোধ। (ইংরেজিতে একে বলে Synesthesia, বাংলায় কি বলে জানি না, জানলে জানান প্লিজ) যখন কেউ বলে, তোমার ‘গলাটা ভারী শোনায়’ কিংবা কারো ‘শীতলকণ্ঠ’ এর কথা বলে তখন কিন্তু একাধিক সংবেদী অঙ্গের অনুভূতিই আমরা পাই। এমিলি ডিকিনসনের’ ‘Light laughs the breeze in her castle of sunshine’ লাইনটি অথবা এডিথ সিটওয়েলের ‘dull blunt wooden stalactite / Of rain creaks, hardened by the light. পড়লে আমরা টের পাই সিনেস্থিসিয়ার ব্যবহার। জীবনানন্দ যখন চিলের ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ’ মুছে ফেলার কথা শোনান, কিংবা বলেন, ‘…নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার’ কিংবা ‘ধূসর চালের গন্ধে তরঙ্গেরা ঝরেছে দুবেলা’ তখনও একই ভাবে সিনেস্থিসিয়ার ব্যবহার উপলব্ধি হয়।

এটা ঠিক যে শুধুমাত্র চিত্রকল্প তৈরির উৎকর্ষই কবিতাকে উৎকৃষ্ট কবিতা বানায় না কিন্তু বেশির ভাগ আধুনিক কবিতায় চিত্রকল্পের নৈপুণ্য দেখা যায় কোন না কোন ভাবে। কবিতার অন্যান্য উপাদানের সাথে
চিত্রকল্পের ব্যবহার তাই গুরুত্ব বহন করে।

কবিতাকে মনে করি শিল্পের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। কবিতা কী? কবিতা কাকে বলে ? এখন আর এসব প্রশ্ন ভাবার অর্থ আছে বলে মনে হয় না। তবে কবিতায় নিজের কৌতূহলের কারনে কবিতার যাবতীয় উপাদান, কাজকারবার, পাঠকের মানসিক অভিঘাত, ছন্দ ও অলঙ্কারের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে পড়তে, জানতে, শিখতে, বুঝে নিতে আগ্রহী। ব্লগে এ আলোচনার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, যা বুঝতে চেয়েছি শুধু তা শেয়ার করা, বরং ধারনা গুলোকে যাচাই করে নেয়া, সহ ব্লগারদের থেকে নতুন কিছু জানা.

তথ্যসূত্রঃ
The world of imagery ,Stephen J. Brown
The poetic image, C. Day Lewis
বাংলাদেশের কবিতায় চিত্রকল্প, বাংলা একাডেমী প্রকাশিত।
The struggle of the modern, Stephen Spender
Discovering poetry, Elizabeth Drew
নির্বাচিত প্রবন্ধ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ।

[এই তথ্যসূত্র খুব একটা ভ্যালিড না, কারন লেখার সময় দু'একটা ক্ষেত্র ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্মৃতি থেকে টুকটাক তথ্য নেয়া হয়েছে, বিভিন্ন উৎস ঠিক ঠাক মনে থাকার কথা না। তবে বইগুলো প্রাসঙ্গিক এবং ভাল বই সেই হিসেবে নাম করা যায়]