হোর্হে লুইস বোর্হেসের কথা ভাবতেই অসংখ্য শব্দের মধ্যে যেটি প্রথম মাথায় আসে, তা ‘ধাঁধা’। সারা পৃথিবীতে বোর্হেস যে এত পূজনীয় তার অন্যতম কারণ, মানুষ প্রজাতি হিসেবেই ধাঁধার ভক্ত; বুদ্ধিবৃত্তি এই প্রজাতি চায় ধাঁধার সামনে পড়তে ও ধাঁধার জট খুলে মজা পেতে। অনেকেই বলেন, বোর্হেসই সাহিত্যের শেষ কথা; তাঁর অপরিসীম জ্ঞান, কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা এমন এক জাদুর জগতে পাঠককে নিয়ে যায় যে বোর্হেস পড়ার তীক্ষ আনন্দের পরে পাঠকের আর অন্য কিছু পড়তে নীরস লাগে। বোর্হেসের সরল-সোজা-সীমিত আকারে কথা বলার ভানহীন যে শৈলী, সেন্টিমেন্টালিটি ও অলংকারসর্বস্ব গদ্য কি পদ্যের বিপরীতে তাঁর যে বুদ্ধিকে নাড়া দেওয়ার নান্দনিকতা—এসব কিছু মিলে বোর্হেস পড়ার পরে হাজারো লেখকের গল্প-কবিতা পড়ার চেয়ে মনে হয় স্রেফ সংবাদপত্র পড়াই বুঝি অনেক ভালো কিংবা খাবারের প্যাকেটের গায়ে লেখা পণ্যের বিবরণ। এ কথাটা আমার নয়। এটা বলেছিলেন জগদ্বিখ্যাত ‘পাঠক’ ও প্রাবন্ধিক আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েল। ম্যাঙ্গুয়েল বলেছিলেন, হায় রে, যা-ই পড়ি তা-ই দেখি ভানে ভরা, শুধু বোর্হেসেই কোনো ভান নেই; আর যে-দেশের যত বড় লেখকের লেখাই পড়ি না কেন, দেখি শুধু ‘লোকাল কালার’-এর ছড়াছড়ি; সবাই কোনো না কোনো জাতির বা দেশের লেখক, একমাত্র বোর্হেসই দেখছি ‘পৃথিবীর’ লেখক।
বোর্হেস ও লোরকা প্রসঙ্গে আসার আগে, ‘ভান’ ও ‘লোকাল কালার’ কথা দুটি মাথায় ঢুকিয়ে নিয়ে চট করে কবিতা বিষয়ে বোর্হেসেরই দু-একটি কথা জেনে নেওয়া যাক। কারণ, তাহলে লোরকা নিয়ে একটু পরেই যখন বলছি, তখন বোর্হেসের ‘সমস্যা’টা আসলে কোথায় ছিল তা বুঝতে সুবিধা হবে। বোর্হেস তাঁর প্রবন্ধসংগ্রহ ‘This Craft of verse’-এর প্রথম প্রবন্ধ ‘কবিতা ধাঁধা’য় বলছেন: ‘সত্য কথা হচ্ছে, (কবিতা বা কবিতার ধাঁধার জট খোলা বিষয়ে) আপনাদের কোনো দৈববাণী দিতে আমি অক্ষম। আমার জীবন কেটেছে পড়ে, বিশ্লেষণ করে, লিখে বা লেখার চেষ্টা করে এবং আনন্দ পেয়ে। এই শেষের ব্যাপারটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার “রস পান” করে করে আমি কবিতা নিয়ে একটা চূড়ান্ত উপসংহারে পৌঁছেছি। আপনাদের বিভ্রান্তি দেওয়া বা হতবুদ্ধি করা বাদে আমার আর করার কিছু নেই। আমার জীবনের সিংহভাগই আমি দিয়ে দিয়েছি সাহিত্যে এবং আপনাদের কেবল সংশয় প্রদান করতেই আমি সক্ষম। ...আপনাদের শুধু মানসিক দ্বিধা ও ধাঁধা সমর্থ আমি।’
আজ অনেক বছর যাবৎ বোর্হেস পড়ার পরে বলতে হচ্ছে, তিনি এ পর্যন্ত আমাকে যত মানসিক দ্বিধা, বিভ্রান্তি ও ধাঁধা উপহার দিয়েছেন, তার প্রধান একটি হলো আমার প্রিয় কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন। হিস্পানি কবিতায় অবিনশ্বর যুবরাজ লোরকা—র্যাঁবোর পাশাপাশি সাহিত্য নিয়ে থাকা আমাদের সবার কাছে জীবনের তারুণ্যপর্বের নাওয়া-খাওয়া ভুলিয়ে দেওয়া এক কবি। ‘তাঁর কবিতা ছুটেছিল বিচিত্র পথে—জিপসি-গানের গীতলতা থেকে ইশারাভরা চিত্রকাব্য, আরব শৈলীর বিধুরতা থেকে পরাবাস্তবের কুহেলি পর্যন্ত’—কথাটি আমার নয়, লোরকা অনুবাদক কবি সাজ্জাদ শরিফের। যথার্থই বলেছেন তিনি। আমরা কে পড়িনি আন্দালুসিয়ার জলপাই বাগানের এ-কবির বিখ্যাত বুলফাইট নিয়ে লেখা ট্র্যাজিক কবিতা: ‘বিকেল পাঁচটায়।/ বিকেলে একেবারে যখন বাজে পাঁচ।/ একটি খোকা আনে ধবল আবরণী/ বিকেল পাঁচটায়।/ চুন-বোঝাই ঝুড়ি রইল প্রস্তুত/ বিকেল পাঁচচায়।/ মৃত্যু সবই আর কেবল মৃত্যুই/ বিকেল পাঁচটায়।’?
সেই লোরকার সঙ্গে ১৯৩৪ সালে যে আর্জেন্টিনায় বোর্হেসের দেখা হয়েছিল সে কথা অনেকেরই জানা নেই। সে-বছর হিস্পানি ভুবনের দুই সর্বাধিক বিখ্যাত কবি, পাবলো নেরুদা ও গার্সিয়া লোরকা, দুজনেই বুয়েনস এইরেসে আসেন। লোরকার বয়স তখন পঁয়ত্রিশ, খ্যাতির তুঙ্গে তিনি। নিজেদের শহরে এই দুই বড় কবিকে একসঙ্গে পেয়ে আর্জেন্টাইন বুদ্ধিজীবী মহল অনেক মাতামাতি করল, আর এঁরা দুজনই ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হলেন আর্জেন্টিনার সাহিত্যজগতের সব নক্ষত্রের সঙ্গেই, বোর্হেসও আছেন সেই তালিকায়।
সেই স্মৃতি মাথায় রেখে, ১৯৬৯ সালে (লোরকা খুন হয়েছেন তাঁর ৩৩ বছর আগে আর বোর্হেস তখন বিশ্ববিখ্যাত বললেও কম বলা হয়) রিচার্ড বাগিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বোর্হেস বলছেন:
বোর্হেস: লোরকার নাটক আমার ভালো লাগে না। কখনোই লোরকাতে মজা পাইনি আমি।
বার্গিন: আর তাঁর কবিতা?
বোর্হেস: না। আমি তাঁর ‘ইয়েরমা’ দেখতে গিয়েছিলাম, এত বোকাটে (silly) লেগেছিল যে আমি বেরিয়ে আসি। সহ্যই করতে পারিনি।
বার্গিন: লোরকাকে তো, কোনো এক কারণে, তাঁর দেশে বীরপূজার মূর্তি বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
বোর্হেস: আমার ধারণা, লোরকার সৌভাগ্য যে তাঁকে ওভাবে হত্যা করা হয়। বুয়েনস এইরেসে তাঁর সঙ্গে আমার এক ঘণ্টা আলাপ হয়েছিল। তাঁকে আমার মঞ্চাভিনেতা বলে মনে হয়েছে। কোনো একটা চরিত্র হয়ে যেন সে জীবন কাটাচ্ছে।
16বার্গিন: যেমনটা, আমি যেটুকু বুঝি, ককতোঁর হওয়ার কথা ছিল।
বোর্হেস: হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। তবে লোরকার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। কারণ, আমি নিজেও আন্দালুসিয়ায় থেকেছি, আন্দালুসিয়ানরা মোটেই ও-রকম নয়। তাঁরটা হচ্ছে মঞ্চের আন্দালুসিয়ান-জাতীয় কিছু। হতে পারে বুয়েন্স এইরেসে এসে তাঁর মনে হয়েছিল ও-রকম একটা চরিত্রের অভিনয় করে যেতে হবে, কিন্তু আন্দালুসিয়াতে মানুষ একেবারেই অমন নয়। সত্যি বলতে, আন্দালুসিয়ায় আপনি যদি কোনো শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে বুলফাইটের কথা বলেন, সে আপনাকে বলবে, ‘ও হ্যাঁ, মানুষ ওসবে মজা পায় বটে, কিন্তু বুলফাইটাররা আসলে কোনো বিপদের মধ্যে কাজ করে না, একদমই না।’ ওরা আসলে এসব দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে গেছে, আসলে প্রত্যেক লেখকই নিজের দেশের ‘লোকাল কালার’ লেখায় ফুটিয়ে তুলতে তুলতে হাঁপিয়ে উঠেছে।
লোরকার লেখায় আন্দালুসিয়ান ‘লোকাল কালার’ ব্যবহার করে মানুষকে মুগ্ধ করার প্রবণতা এবং একই সঙ্গে তাঁর কবিতার ‘নাটকীয় চরিত্র’ বোর্হেসের ভালো লাগেনি। বোর্হেস এবার বললেন সাংঘাতিক কথা:
বোর্হেস: লোরকা চাইতেন আমাদের চমকিত করতে। তিনি আমাকে বলেছিলেন সমকালীন পৃথিবীর অন্যতম এক প্রধান চরিত্র নিয়ে তিনি খুবই বিচলিত—এমন একক চরিত্র, যার মধ্যে নাকি আমেরিকান জীবনের ট্র্যাজেডির ছবি ধরা আছে। ...দেখা গেল তিনি মিকি মাউসের কথা বলছেন। ...এসব কথা বলা যায় বয়স কম থাকতে, যখন আপনি চাইবেন যে কাউকে অবাক করে দেব। কিন্তু তিনি তো ছিলেন বয়স্ক এক লোক, তাঁর কোনো দরকার ছিল না ওসবের, তিনি অন্যভাবেও কথা বললে পারতেন। তবে সব বাদ দিয়ে তিনি যখন মিকি মাউসকে আমেরিকার প্রতীক বলে বলা শুরু করলেন, আমরা হাঁটা দিলাম। কারণ, ওসব গেমের বয়স আমরা তত দিনে পেরিয়ে এসেছি (দ্রষ্টব্য যে, লোরকা বোর্হেসের চেয়ে বয়সে এক বছরের বড়)।
এবার কথা উঠল লোরকার দুষ্ট রসবোধ ও কৌতুকী ছদ্মবেশিতা নিয়ে। যেন গা গুলিয়ে উঠল। বার্গিন যখন বললেন, লোরকা যতটা না ‘চিন্তাশীল’ লেখক তার চেয়ে বেশি ‘শব্দের কারিগর’, তখন বোর্হেসের উত্তর:
বোর্হেস: কিন্তু আমার ধারণা, তাঁর ওই শব্দের পেছনে আসলে তেমন কিছুই নেই।
বার্গিন: শব্দ শোনার দারুণ একটা কান ছিল তাঁর।
বোর্হেস: ছিল বাচালতার। উদাহরণ হিসেবে বলছি, তিনি চমক লাগানো সব মেটাফর (রূপকালংকার) তৈরি করতে পারতেন, কিন্তু আমার মনে হয় ওই সব চোখধাঁধানো মেটাফর তিনি নিজের জন্যই বানাতেন, কারণ তাঁর পৃথিবী ছিল মূলত বকবকানির পৃথিবী। আমি মনে করি, তিনি একটা শব্দকে আরেকটার বিপরীতে খেলাতে পারতেন, শব্দের বৈপরীত্য বিষয়টা পছন্দ করতেন, কিন্তু আমার সন্দেহ হয় তিনি কি আদৌ জানতেন যে কী করছেন?
এমন এক সময় বোর্হেস ও লোরকার দেখা হয়েছিল যখন বোর্হেস সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা ছেড়ে দিয়েছেন, সাহিত্যে কোনো রকম চমক, ভান ও তাক লাগানো মেটাফর তৈরির প্রবণতা ছেড়ে বরং ধ্রুপদি সাহিত্যের লিরিকহীন স্বচ্ছতা ও সরলতার পথে যাচ্ছেন আর যখন লোরকা চলেছেন ঠিক উল্টো পথে—পরাবাস্তবতা ও মেটাফরের আকস্মিক ধাক্কার ঝংকারের দিকে। সময়টাই আসলে সঠিক ছিল না। এই দুই কবির মধ্যকার সংলাপের বিষয়টাই তখন অসম্ভব ছিল।
সুত্রঃ প্রথম আলো।