Featured Posts

Tuesday, June 9, 2015

কবি আবুল হাসানের কবিতা-৪


জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন – আবুল হাসান


মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা,

আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই,
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন
কী লাভ যুদ্ধ কোরে ? শত্রুতায় কী লাভ বলুন ?
আধিপত্যে এত লোভ ? পত্রিকা তো কেবলি আপনাদের
ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর…

মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলোনা !

পৃথিবীতে তবু আমার মতোন কেউ রাত জেগে
নুলো ভিখিরীর গান, দারিদ্রের এত অভিমান দেখলোনা !

আমাদের জীবনের অর্ধেক সময় তো আমরা
সঙ্গমে আর সন্তান উৎপাদনে শেষ কোরে দিলাম,
সুধীবৃন্দ, তবু জীবনে কয়বার বলুন তো
আমরা আমাদের কাছে বোলতে পেরেছি,

ভালো আছি, খুব ভালো আছি ?


মাতৃভাষা – আবুল হাসান

আমি জানিনা দুঃখের কী মাতৃভাষা
ভালোবাসার কী মাতৃভাষা
বেদনার কী মাতৃভাষা
যুদ্ধের কী মাতৃভাষা।

আমি জানিনা নদীর কী মাতৃভাষা
নগ্নতার কী মাতৃভাষা
একটা নিবিড় বৃক্ষ কোন ভাষায় কথা বলে এখনো জানিনা।

শুধু আমি কোথাও ঘরের দরোজায় দাঁড়ালেই আজো
সভ্যতার শেষ মানুষের পদশব্দ শুনি আর
কোথাও করুণ জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে,
আর সেই জলপতনের শব্দে সিক্ত হতে থাকে
সর্বাঙ্গে সবুজ হতে থাকে আমার শরীর।

সর্বাঙ্গে সবুজ আমি কোথাও ঘরের দরোজায় দাঁড়ালেই আজো
পোষা পাখিদের কিচিরমিচির শুনি
শিশুদের কলরব শুনি
সুবর্ণ কঙ্কন পরা কামনার হাস্যধ্বনি শুনি !

ঐযে নষ্ট গলি, নিশ্চুপ দরোজা
ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, গণিকারা-
মধ্যরাতে উলঙ্গ শয্যায় ওরা কীসের ভাষায় কথা বলে ?

ঐযে কমলা রং কিশোরীরা যাচ্ছে ইশকুলে
আজো ঐ কিশোরীর প্রথম কম্পনে দুটি হাত রাখলে
রক্তে স্রোত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে, শব্দ হয়, শুনি

কিন্তু আমি রক্তের কী মাতৃভাষা এখনও জানিনা !

বেদনার কী মাতৃভাষা এখনো জানিনা !

শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ,
আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা !


বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা – আবুল হাসান


মনে আছে একবার বৃষ্টি নেমেছিল ?

একবার ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে থেমেছিল
আমাদের ইস্টিশনে সারাদিন জল ডাকাতের মতো
উৎপাত শুরু করে দিয়েছিল তারা;
ছোট-খাটো রাজনীতিকের মতো পাড়ায়-পাড়ায়
জুড়ে দিয়েছিল অথই শ্লোগান।

তবু কেউ আমাদের কাদা ভেঙে যাইনি মিটিং-এ
থিয়েটার পণ্ড হলো, এ বৃষ্টিতে সভা আর
তাসের আড্ডার লোক ফিরে এলো ঘরে;
ব্যবসার হলো ক্ষতি দারুণ দুর্দশা,

সারাদিন অমুক নিপাত যাক, অমুক জিন্দাবাদ
অমুকের ধ্বংস চাই বলে আর হাবিজাবি হলোনা পাড়াটা।

ভদ্রশান্ত কেবল কয়েকটি গাছ বেফাঁস নারীর মতো
চুল ঝাড়ানো আঙ্গিনায় হঠাৎ বাতাসে আর
পাশের বাড়ীতে কোনো হারমোনিয়ামে শুধু উঠতি এক আগ্রহী গায়িকা
স্বরচিত মেঘমালা গাইলো তিনবার !

আর ক’টি চা’খোর মানুষ এলো
রেনকোট গায়ে চেপে চায়ের দোকানে;
তাদের স্বভাবসিদ্ধ গলা থেকে শোনা গেল :
কী করি বলুন দেখি, দাঁত পড়ে যাচ্ছে তবু মাইনেটা বাড়ছেনা,
ডাক্তারের কাছে যাই তবু শুধু বাড়ছেই ক্রমাগত বাড়ছেই
হৃদরোগ, চোখের অসুখ !

একজন বেরসিক রোগী গলা কাশলো :
ওহে ছোকরা, নুন চায়ে এক টুকরো বেশী লেবু দিও।

তাদের বিভিন্ন সব জীবনের খুঁটিনাটি দুঃখবোধ সমস্যায় তবু
সেদিন বৃষ্টিতে কিছু আসে যায়নি আমাদের
কেননা সেদিন সারাদিন বৃষ্টি পড়েছিল,
সারাদিন আকাশের অন্ধকার বর্ষণের সানুনয় অনুরোধে
আমাদের পাশাপাশি শুয়ে থাকতে হয়েছিল সারাদিন

আমাদের হৃদয়ে অক্ষরভরা উপন্যাস পড়তে হয়েছিল !


স্মৃতিকথা – আবুল হাসান


(হেলাল, কাঞ্চন, ওয়ালী, বাচ্চু ও রাব্বীকে)

যে বন্ধুরা কৈশোরে নারকেল বনের পাশে বসে
আত্মহত্যার মতো বিষণ্ন উপায়ে উষ্ণ মেয়েদের গল্প কোরতো
শীতকালে চাঁদের মতোন গোল বোতামের কোট পড়ে
ঘুরতো পাড়ায়,
যে বন্ধুরা থিয়েটারে পার্ট কোরতো,
কেউ সাজতো মীরজাফর, কেউবা সিরাজ
তারা আজ, এখন কোথায় ?

রোমেনা যে পড়াতো ইশকুলে ছোট মনিদের বিদ্যালয়ে
রোমেনা যে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস পড়ে তার
নায়িকার মতো জ্বরে ভুগতো,
আর মিহি শরীরের সাথে মিল রেখে
কপালে পরতো টিপ,
শাদা কোমরের কাছে দীর্ঘচুল ঝুলিয়ে রাখতো
ব্লু কালারের ব্যাগ,

দু’বৎসর আগে শুনেছি বিবাহ হ’য়ে গেছে তার,
এখন কোথায় ?

রুনী তার মাতাল স্বামীর কাছে না গিয়ে নিজেই একরাতে
একে একে শূন্যতায় সলজ্জ কাপড়গুলি খুলে ফেলে কুয়াশায়
উন্মাদিনী কোথায় পালালো !
নিজস্ব ভ্রুণের হত্যা গেঁথে দিয়েছিল তাকে মানসিক হাসপাতালের এক কোণে !
কোথায় সে ? এখন কোথায় ?

অনেকেই চলে গেছে, অনেক নারকেল গাছ হয়ে গেছে বুড়ো
অনেক প্রাঙ্গণ থেকে উঠে গেছে
গোলাপ চারার মতো সুন্দর বয়সমাখা প্রসিদ্ধা তরুণী,

মধ্যরাতে নারকেল বনের কাছে ভেঙে যায় আমারও গল্পগুলি
স্মৃতিকথা সেখানে নিশ্চুপ !


সেই সুখ – আবুল হাসান


অক্টোবর 25, 2012 in আবুল হাসান | মন্তব্য দিন  

সেই সুখ মাছের ভিতরে ছিল,
সেই সুখ মাংসের ভিতরে ছিল,
রাতের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যেতো ছেলেবেলা
সেই সুখ চাঁদের ভিতরে ছিল,
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল !

নারী কোন রমণীকে বলে ?
যার চোখ মুখ স্তন ফুটেছে সেই রমণী কি নারী ?
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল,
যখন আমরা খুব গলাগলি শুয়ে
অনু অপলাদের স্তন শরীর মুখ উরু থেকে
অকস্মাৎ ঝিনুকের মতো যোনি,
অর্থাৎ নারীকে আমরা যখোন খুঁজেছি
হরিণের মতো হুররে দাঁত দিয়ে ছিঁড়েছি তাদের নখ, অন্ধকারে
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল।

যখন আমরা শীতে গলাবন্ধে পশমী চাদর জড়িয়েছি
কিশোরীর কামরাঙা কেড়ে নিয়ে দাঁত বসিয়েছি
সেই সুখ পশমী চাদরে ছিল, কামরাঙা কিশোরীতে ছিল !

রঙীন বুদ্বুদ মাছ, তাজা মাংস, সুপেয় মশলার ঘ্রাণ;
চিংড়ি মাছের ঝোল যখোন খেতাম শীতল পাটিতে বসে
সেই সুখ শীতল পাটিতে ছিল।

প্রথম যে কার ঠোঁটে চুমু খাই মনে নেই
প্রথম কোনদিন আমি স্নান করি মনে নেই
কবে কাঁচা আম নুন লঙ্কা দিয়ে খেতে খেতে
দাঁত টক হয়েছিল মনে নেই
মনে নেই কবে যৌবনের প্রথম মিথুন আমি ঘটিয়েছিলাম
মনে নেই…
যা কিছু আমার মনে নেই তাই হলো সুখ !
আহ ! সে সুখ…


প্রতিক্ষার শোকগাথা – আবুল হাসান



তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে
আর আমার হাত ঘড়ি
নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে !

টুরিস্টের মতো লাগছে দেখতে আমাকে
সাংবাদিকের মতো ভীষণ উৎসাহী

এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে
শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো এ্যাসট্রেতে !

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আজ স্বাতী ?

তোমার কথার মতো নরম সবুজ
কেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচে

তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ !

তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়

আর একটি অস্থির নীল প্রজাপতি পর্দার বুনট থেকে উড়ে এসে
ঢুকে গেছে আমার মাথায় !

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসছোনা আজ স্বাতী ?

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আর স্বাতী ?

0 comments:

Post a Comment