Featured Posts

Tuesday, June 9, 2015

বাংলা সাহিত্যে অলঙ্কার: একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ ০১ (শব্দালঙ্কার) // সুমন আহমেদ

মানুষ স্বভাব বশত: সুন্দরের পূজারি। যে কোন সৌন্দর্যই আমাদের হৃদয়কে আন্দোলিত করে, বিমোহিত করে, হোক তা কিছু সময়ের জন্য। প্রকৃতিতে ছড়ানো ছিটানো নানা সৌন্দর্য যেমনি আমাদের মুগ্ধ করে, আমরাও যেভাবে নিজেদের রূপ সৌন্দর্য অন্যের কাছে তুলে ধরতে প্রসাধনীর আশ্রয় নেই বিশেষ করে নারীরা নানা অলঙ্কারে তার রূপ যেভাবে প্রকাশ করে থাকেন তেমনি সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতায় সে সৌন্দর্যকে তুলে ধরতে হলে অলঙ্কারের ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয়; যার মাধ্যমে একটি কবিতা অলঙ্কারের আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত হয়ে তার শিল্পিত রূপ এবং নান্দনিকতাকে ফুটিয়ে তুলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে।
আমরা যারা বাংলা সাহিত্যের পাঠক তাদের এ অলঙ্কার গুলো মোটামুটি ভাবে জানা থাকলে সাহিত্যের প্রকৃত সৌন্দর্য, শিল্প, নান্দনিকতা খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না। বরং এগুলো জানা থাকলে গল্প, কবিতা, উপন্যাসের প্রকৃত মর্ম উদ্ধার করতে পারবো আমাদের পাঠক মানসে।
বাংলা প্রধান দুই অলঙ্কারের প্রধান প্রধান অলঙ্কার গুলো নিয়ে আমার ব্যক্তিগত পাঠ বা অনুশীলন সবার সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করলাম। আশা করি কেউ কেউ এর থেকে উপকৃত হবেন।
বাংলা অলঙ্কার প্রধানত দুই প্রকার। শব্দালঙ্কার এবং অর্থালঙ্কার। এছাড়া আরও কিছু অপ্রধান অলঙ্কার রয়েছে যেমন: বিরোধমূলক অলঙ্কার, শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার, ন্যায়মূলক অলঙ্কার, গূঢ়ার্থমূলক অলঙ্কার ইত্যাদি।
শব্দালঙ্কার: শব্দের ধ্বনিরূপকে আশ্রয় করে যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় শব্দালঙ্কার। অর্থাৎ শব্দকে ঘিরে এ অলঙ্কারের সৃষ্টি। এর মূল সৌন্দর্য টুকু ফুটে উঠে শব্দের ধ্বনিরূপে। মনে রাখতে হবে শব্দালঙ্কারের অলঙ্কার নির্ভর করে শব্দের ওপর। তাই ইচ্ছে মতো তাকে বদলে দেয়া যায় না।
প্রধান কয়েকটি শব্দালঙ্কার: শব্দালঙ্কারের সংখ্যা কম নয়, তবে বাংলায় ব্যবহার উপযোগিতার দিক দিয়ে প্রধান হচ্ছে চারটি।
অনুপ্রাস
যমক
শ্লেষ
বক্রোক্তি

অনুপ্রাস:

অনু শব্দের অর্থ পরে বা পিছনে আর প্রাস শব্দের অর্থ বিন্যাস, প্রয়োগ বা নিক্ষেপ। একই ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছের একাধিক বার ব্যবহারের ফলে যে সুন্দর ধ্বনিসাম্যের সৃষ্টি হয় তার নাম অনুপ্রাস। এর মূল বৈশিষ্ট্য গুলো হল:
এতে একই ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছ একাধিক বার ব্যবহৃত হবে।
একাধিক বার ব্যবহৃত ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছ যুক্ত শব্দগুলো যথাসম্ভব পরপর বা কাছাকাছি বসবে।
এর ফলে সৃষ্টি হবে একটি সুন্দর ধ্বনি সৌন্দর্যের।
উদাহরণ:
কুশল কামনা কর কুসঙ্গ করিয়া (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
- এখানে ‘ক’ ধ্বনি পাঁচবার এসেছে যা অলঙ্কার অনুপ্রাস।
কুলায় কাপিছে কাতর কপোত দাদুরি ডাকিছে সঘনে
গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে …রবীন্দ্রনাথ
অনুপ্রাস প্রধানত তিন প্রকার। অন্ত্যানুপ্রাস, বৃত্ত্যনুপ্রাস এবং ছেকানুপ্রাস।
অন্ত্যানুপ্রাস: কবিতার এক চরণের শেষে যে শব্দধ্বনি থাকে অন্য চরণের শেষে তারই পুনরাবৃ্ত্তিতে যে অনুপ্রাস অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম অন্ত্যানুপ্রাস। অর্থাৎ কবিতার দু’টি চরণের শেষে যে শব্দধ্বনির মিল থাকে তাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে। একে অন্ত্যমিলও বলা হয়ে থাকে।
যেমন:
দিনের আলো নিভে এলো সূর্যি ডোবে ডোবে,
আকাশ ঘিরে মেঘ টুটেছে ছাঁদের লোভে লোভে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
- এখানে ‘ডোবে’ আর ‘লোভে’র অন্ত্যমিল তাই এটি অলঙ্কার অন্ত্যানুপ্রাস।
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা
‘আম্মা গো, পানি দাও, ফেটে গেল ছাতি মা’ …নজরুল
উচ্চ কন্ঠে উঠিল হাসিয়া
তুচ্ছ ছলনা গেল সে ভাসিয়া
চকিতে সরিয়া নিকটে আসিয়া
…রবীন্দ্রনাথ

বৃত্ত্যনুপ্রাস:
একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে, বর্ণগুচ্ছ স্বরূপ অথবা ক্রম অনুসারে যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে বহুবার ধ্বনিত হলে যে অনুপ্রাসের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় বৃত্ত্যনুপ্রাস।
যেমন:
সাগর জলে সিনান করি সজল এলোচুলে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
- এখানে একক ব্যঞ্জন ‘স’ পরপর তিনবার ও ‘ল’ পরপর চারবার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় এটি অলঙ্কার বৃত্ত্যনুপ্রাস।
মানুষের মনীষার মঞ্জুষার, মুগ্ধতার মহিমার-
মৌনতাবাহক
(আবুল হাসান (‘ম’ ৭ বার আবৃত্ত)
হবে সে সূর্যের সেবাদাসী (শামসুর রাহমান)
বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী (আল মাহমুদ)
ছেকানুপ্রাস: দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে একইক্রমে মাত্র দু’বার ধ্বনিত হলে যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম ছেকানুপ্রাস। একে শ্রুত্যনুপ্রাস, লাটানুপ্রাস, মালানুপ্রাস, গুচ্ছানুপ্রাস, আদ্যানুপ্রাস বা সর্বানুপ্রাস হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। মনে রাখা দরকার যে একক ব্যঞ্জনে কোন ক্রমেই ছেকানুপ্রাস হয় না। উল্লেখ্য যে, এ ধরণের অনুপ্রাসের বাস্তব ব্যবহার বাংলায় খুব বেশি দেখা যায় না।
যেমন:
করিয়াছ পান চুম্বন ভরা সরস বিম্বাধরে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
- এখানে যুক্ত ব্যঞ্জন ‘ম্ব’ একের অধিকবার ক্রমানুসারে ধ্বনিত হয়েছে চুম্বন ও বিম্বাধরে এর মধ্যে, তাই এটি অলংকার ছেকানুপ্রাস।
আরও কিছু উদাহরণ:
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? (সুধীনদত্ত)
একমাত্র গোধূলীবেলায় সবকিছু বারাঙ্গনার মত রাঙ্গা হয়ে যায় (শহীদ কাদরী)
নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে ভেবেছিলাম গাইব না গান (নজরুল)
সাপের অঙ্গের মতো ভঙ্গি ধরে টান মারে মিছিলে রাস্তায় (আলা মাহমুদ)
যমক:

একই শব্দ একই স্বরধ্বনিসমেত একই ক্রমে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে একাধিক বার ব্যবহারের ফলে যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম যমক। যমক শব্দের অর্থ হল যুগ্ম বা দুই। লক্ষনীয় যে, একই শব্দ দুই বা ততোধিক বার ব্যবহৃত হওয়া এবং ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করা এর বৈশিষ্ট্য। আরও কিছু বৈশিষ্ট্য হল:
একই স্বরধ্বনি সমেত একই শব্দ বা প্রায় একই ধরনের উচ্চারিত শব্দের একাধিক বার ব্যবহার।
শব্দে স্বরধ্বনির ঈষৎ বদল ঘটলে অলঙ্কার আর যমক থাকে না, তা অনুপ্রাস হয়ে যাবে।
যেমন:
মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
দিবসরাতি রহিলে আমি বন্ধ।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
- এখানে ‘মাটি’ একটি শব্দ যা দুইবার ব্যবহৃত কিন্তু অর্থ ভিন্ন। প্রথম মাটি ধূলা অর্থে এবং দ্বিতীয় মাটি বিনষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
আরও কিছু উদাহরণ:
ওরে ও তরুন ঈশান
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদি।
(নজরুল)
তোমার এ বিধি, বিধি, কে পারে বুঝিতে (মধুসূদন)
তখন একতি কবিতা তো নয়
রক্তে তার আকুল বিনয়
(সৈয়দ আলী আহসান)
Not on thy sole, but on thy soul,
…সেকশপিয়ারিয়ান একটি যমক, মার্চেন্ট অফ ভেনিস
যমক তিন প্রকার। আদ্য যমক, মধ্য যমক এবং অন্ত্য যমক। চরণের শুরুতে যমক থাকলে তা আদ্য যমক, মাঝে থাকলে তা মধ্য যমক এবং শেষে থাকলে তা অন্ত্য যমক হয়। যেমন:
আদ্য যমক: ঘন ঘনাকারে ধূলা উঠিল আকাশে। (মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
মধ্য যমক: নামজাদা লেখকদেরও বই বাজারে কাটে, কাটে বেশি পোকায়। (প্রমথ চৌধুরী)
অন্ত্য যমক: দুহিতা আনিয়া যদি না দেহ/নিশ্চয় আমি ত্যাজিব দেহ। (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
শ্লেষ:

একটি শব্দ একাধিক অর্থে একবার মাত্র ব্যবহারের ফলে যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম শ্লেষ। শ্লেষ শব্দের অর্থ শ্লিষ্ট-মিলিত বা আলিঙ্গিত। এতে একবার মাত্রই শব্দটি ব্যবহৃত হয় কিন্তু তাতে ভিন্ন অর্থের ব্যঞ্জনা থাকে। এই শ্লেষ শব্দকেন্দ্রিক বলে কেউ কেউ একে শব্দ-শ্লেষ বলেন।
যেমন:
আছিলাম একাকিনী বসিয়া কাননে
আনিলা তোমার স্বামী বান্ধি নিজ গুণে।
(মুকুন্দরাম)
- এখানে ‘গুণে’ শব্দে শ্লেষ অলঙ্কার ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটি অর্থ ধনুকের ছিলায় আর অন্য অর্থ সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা গুণ।
আরও কিছু উদাহরণ:
মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে (নজরুল)
এখানে কবি ‘রবি’ বলতে সূর্য ও রবীন্দ্রনাথকে বুঝিয়েছেন।
ডাল না থাকে তো ঐটেই দাও, ডাল না থাকে তো ঐটেই দাও।
এখানে ‘ডাল না’ থাকে অর্থাৎ ‘ডাল’ যদি না থাকে। অথচ শব্দটা না ভাঙলে হয় ডালনা
শ্রীচরণেষু
‘শ্রীচরণেষু’ একটা জুতোর দোকানের নাম। ক্রেতার ‘শ্রীচরণ ভরসা করে জুতোর দোকানদারকে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে হয়, তাই শ্রীচরণ শব্দের শেষে সপ্তমীর বহুচবন যুক্ত করে ‘শ্রীচরণেষু’ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু শব্দটা ভাঙলে আরো গভীর তাৎপর্য উদ্ঘাটিত হয়- অর্থাৎ ‘শ্রীচরণে ‘ষু’(shoe বা জুতো পরার আহ্ববান), যা শব্দ ভাঙায় পাওয়া গেল।
শ্লেষ অলঙ্কারকে কেউ কেউ দুই ভাগে ভাগ করে থাকেন। যেমন: অভঙ্গ ও সভঙ্গ।
অভঙ্গ শ্লেষ: শব্দকে না ভেঙ্গে অখণ্ড অবস্থায় রেখেই যে শ্লেষ প্রকাশ পায় তা-ই অভঙ্গ শ্লেষ। যেমন: মধুহীন করো না গো তব মনঃ-কোকনদে।
সভঙ্গ শ্লেষ: অখণ্ড অবস্থায় শব্দের শ্লেষ প্রকাশ না পেয়ে শব্দকে ভাঙ্গলে যে শ্লেষ প্রকাশ পায় তার নাম সভঙ্গ শ্লেষ। যেমন: অর্ধেক বয়স রাজা এক পাটরানী/ পাঁচ নৃপতির সবে যুবাজানি।

বক্রোক্তি:


সোজাসুজি কোন কথা না বলে প্রশ্ন বা স্বরবিকৃতির দ্বারা বাঁকা ভাবে বলায় যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম বক্রোক্তি। এর অর্থ – বাঁকা কথা। বক্তা তাঁর বক্তব্যে কি কথা কি ভাবে বলতে চান তা সঠিক ভাবে জেনেও শ্রোতা অনেক সময় ইচ্ছে করে তাকে একটু বাঁকিয়ে ও ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করলে তা বক্রোক্তি অলঙ্কার হয়।
যেমন:
আপনার কি পানাভ্যাস আছে?
জ্বী না, পকেটের পজিশন খারাপ কিনা- তাই এখনও রপ্ত করে উঠতে পারি নাই।

- এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বক্তার জিজ্ঞাসার জবাবে শ্রোতা একটু ঘুরিয়ে বাঁকা ভাবে তার উত্তর দিয়েছেন, তাই অলঙ্কার এখানে বক্রোক্তি।
আরও কিছু উদাহরণ:
দেখি, দে-তো, এই কথাটার উত্তর দে দেখি
– তোরা দক্ষিনের লোক,উত্তরের কি জানিস?

বক্তা বুঝিয়েছে প্রশ্নের উত্তর, আরর শ্রোতা বুঝিয়েছেন উত্তর দিকের কথা।
অশ্বত্থের শাখা করে নি কি প্রতিবাদ? (জীবনানন্দ)
‘কে বলে কাব্যের ফুকে এ-পৃথিবী নিরাময় হয়, হতে পারে’ (শামসুর রাহমান)
বক্রোক্তি দুই প্রকারের। শ্লেষবক্রোক্তি ও কাকু-বক্রোক্তি। উদাহরণের প্রথমটি শ্লেষবক্রোক্তি এবং দ্বিতীয়টি কাকু-বক্রোক্তি।
নোট: কৃতজ্ঞতা প্রিয় কে এম রাকিবকে। পোস্টে তার মন্তব্য থেকে কিছু উদাহরণ যোগ করা হয়েছে।
সহায়ক গ্রন্থ: বাঙলা অলঙ্কার

0 comments:

Post a Comment