Featured Posts

Tuesday, June 9, 2015

র‌্যাঁবো : কবিতার ফিনিক্স পাখি // ড. সফিউদ্দিন আহমদ

র‌্যাঁবো ও র‌্যাঁবোর কাব্য-দর্শন আমি ভালো করে বুঝেছি, এমন বলার সাহস আমার নেই- তবে এতোটুকু বলতে পারি যে, মননে ও দর্শনে এবং কাব্য চর্চায় র‌্যাঁবো পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাঁদনের সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত হবার জন্য দুরন্ত ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছে। এমনকি তার নিজের কবিতার অধিনায়কত্বেও সে বশ মানেনি। শেষ জীবনে সার্ত্রে যেমন মার্কসিজমে আস্থা হারিয়ে বলেছিলেন- ‘এখানে স্বাধীনতা নেই- আমি চাই স্বেচ্ছা, একবারে স্বেচ্ছা ও স্বতঃস্ফূর্ততা’।

র‌্যাঁবো বারবারই বলেছে যে, পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের বাঁধনে বন্দি মানুষের জানাটা অতীব সীমিত এবং অজ্ঞ ও অন্ধের জানা। এই বৃত্ত থেকে একবার মুক্ত হতে পারলে তবেই মানুষ পঞ্চ-ইন্দ্রিয় বহির্ভূত অজানা, অচেনা, অসীম, অনন্ত আরো একটি জগৎকে জানতে পারবে এবং তখন সে নিজেই উপলব্ধি করবে যে, সে অসীম, অনন্ত ও প্রচণ্ড অলৌকিক সত্ত্বায় শক্তিমান আর তখনই সে ছুতে পারবে, অসীম-অনন্ত, বিশাল ও ব্যাপক অন্য আরো একটি জগৎ ও সত্ত্বাকে।

আমার ধারণা র‌্যাঁবো শুধু ফরাসি সাহিত্যে নয়- কাব্যে প্রতীকীয় নান্দনিকতায় র‌্যাঁবো সমগ্র বিশ্বেই কবিতার ফিনিক্স পাখি। সমকালে র‌্যাঁবো ছিল আলোড়িত, ধিকৃত, নিন্দিত ও সমাজচ্যুত কবি। শুধু তাই নয়, সেদিনকার নিন্দা ও কুৎসার পঙ্কে নিমজ্জিত র‌্যাঁবো আজ সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে নন্দিত, বন্দিত, প্রশংসার উজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত এবং নব মূল্যায়নের মুখর আলোচনায় উচ্ছ্বসিত। সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে র্যাঁবোর তুলনা নেই- এবং র‌্যাঁবোই একমাত্র র‌্যাঁবোর তুলনা। র‌্যাঁবো আজ কবিতার দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত এবং কবিতার ফিনিক্স। আরো বলা যায়, সে আজ কবিতার এক আলোক দূত। র‌্যাঁবোর কাব্য সাধনা মাত্র চার বছর (১৬ থেকে ১৯ বছর)। সে সময়ের বিখ্যাত ও আলোচিত কবি হলেন প্রতীকীবাদের উদ্গাতা জাঁ মারিয়া এবং এছাড়াও বোদলেয়ার, মালার্মে, ভর্লেন ও লাফর্গ। মালার্মে র‌্যাঁবোর চেয়ে বারো বছরের এবং ভর্লেন দশ বছরের বড়ো আর লাফর্গ ছোট দু’বছরের।

সেদিনকার প্যারির বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও বিদ্বৎজন অবাক বিস্ময়ে চকিত হয়ে ভাবতো যে, এই প্রাপ্ত বয়স্কও কিশোর-ছোকরা মাত্র চার বছরে এমন কী লিখেছে যে, একে ও তার লেখা নিয়ে এতো তোলপাড় হতে পারে! বিস্ময়ের বিষয় এই অপ্রাপ্ত বয়সের কিশোর শুধু প্যারিতেই নয়- সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আজ শুধু বোদলেয়ার, মালার্মে, ভর্লেন ও লাফর্গ নয়- যে কোনো বড়ো কবির চেয়েও শতগুণ বেশি আলোচনা হচ্ছে র‌্যাঁবোকে নিয়ে এবং আমার তো ধারণা, কিশোর র‌্যাঁবোর জীবন জিজ্ঞাসা ও জীবন পিপাসা এবং আকাশস্পর্শী কাব্য চৈতন্য ছায়ালোকের ভেতর প্রচ্ছাদিত প্রতীকী প্রহেলিকার পর্দা কোনো দিনই কেউ উন্মোচন করতে পারবে না। যেমন পারে না মোনালিসার হাসির রহস্য উন্মোচন করতে।

র‌্যাঁবো যেমন তার আঙ্গুল দিয়ে প্রতীকীর সেঁতু বেয়ে Absolute কে (অসীম ও অনন্ত) ছুতে চেয়েছে, তেমনি তাবৎ বিশ্বেও নন্দনতত্ত্ববিদ ও গবেষক এবং আলোচকেরাও র‌্যাঁবোর প্রতীকীয়তার প্রহেলিকার সমাধান করতে চেয়েছেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না, কী ছুতে চেয়েছে, কী ধরতে চেয়েছে র‌্যাঁবো। তীক্ষ্ণ টানা দু’টি জিজ্ঞাসু চোখ দিয়ে এবং তার হৃদয় ও মন দিয়ে ইন্দ্রিয়ের প্রাকার ভেঙে সমগ্র বিশ্বকে, মহাকাশকে, নক্ষত্রলোককে, অনন্ত অসীমকে ছেকে নিতে চেয়েছে র‌্যাঁবো। এ বিষয়ে র‌্যাঁবো আজ পর্যন্তও অজেয়, অনতিক্রম্য ও অধরা। আর এ নিয়ে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে কেউ কুল কিনারাও পাচ্ছে না। এ জন্যই র‌্যাঁবো ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের উর্ধ্বে। র্যাঁবো সমস্ত দুনিয়াটাকে ছেঁকে এনে নান্দনিক বিভার ঐশ্বর্যে কালোত্তীর্ণ, মনোত্তীর্ণ ও শিল্পোত্তীর্ণ আবেদনে কবিতাকে প্রতীকীয়তায় বাণীরূপ দিয়েছে। এজন্যই র্যাঁবো শুধু অনুভবে ও উপলব্ধিতে। অনেকেই হয়তো আঙ্গুল দিয়ে আকাশ ছোঁয়ার কল্পনা করতে পারে কিন্তু র্যাঁবোর প্রতীকীয়তা ও কবিতার বাণীকে ছোঁয়া কল্পনাও করতে পারে না।

অনেকেই হয়তো বলবে র্যাঁবো কী চায়? তবে র‌্যাঁবো নিজেই বলেছে- ‘আমি ভালোবাসি মরুভূমি, শুকিয়ে যাওয়া ফলের বাগিচা, বিবর্ণ ম্লান দোকান, ঠাণ্ডা হয়ে আসা পানীয়। নিজেকে টেনে নিয়ে যাবো পচা দুর্গন্ধের অলিগলি দিয়ে বন্ধ আঁখির কাছে, উৎসর্গ করবো সূর্যের চরণে, আগুনের যিনি দেবতা’। র‌্যাঁবোর কারো কাছে কোনো চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্খা ছিল না। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা-এমনও কিছু সে চায় নি। বলতে গেলে বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব, প্রেম-ভালোবাসা কোনো কিছুই তার প্রত্যাশা ছিল না। থাকা-খাওয়া পোশাক সব কিছুতেই ছিল নিস্পৃহ ও নির্লিপ্ত মানসিকতা। আভিজাত্য ও সামাজিক মর্যাদা বা প্রতিষ্ঠার কোনো মোহও তার ছিল না।

কুলি, জেলে, মেথর-মুচি, চাষা-ভূষা বা পতিতজন কোনো কিছুতেই তার আপত্তি নেই। কিন্তু সে শুধু চেয়েছে তার লম্বা লক লকে আঙুল দিয়ে অসীম- অনন্তকে ছুঁতে। ধরতে চেয়েছে অধরাকে। তার যাত্রা ছিল অশ্রান্ত ও অনন্ত যাত্রা। হাজার বছর ধরে হেঁটেছে, বিরামহীন এ যাত্রা- এ পথ না ফুরোলেও তার আপত্তি নেই। বংশ গৌরব বা রক্তের অভিজাত্য নিয়েও তার কোনো গর্ব বা অহংকার ছিল না।

‘দূষিত রক্তে’ র্যাঁবো নিজেই বলেছে, পূর্বপুরুষ ছিল গল...। আমার পোশাক পরিচ্ছদেও একই বর্বরতা। ...তাদের কাছে থেকেই পেয়েছি পৌত্তলিকা, মহানকে অসম্মান করার মতো প্রবৃত্তির মত্ততা- শাসকই হোক, শ্রমিকই হোক, সবাই চাষা, সবাই নীচ, হীনকুলোদ্ভব। লাঙ্গল ধরে যে হাত তার থেকে কম নয় যে হাত লেখনী ছোঁয়। সকল কৌলিন্য বর্জিত কুল আমার, স্পষ্ট সে-কথা। পৌত্তালিক সেই রক্ত আবার সেই ফিরে এলো- আত্মা হাতের কাছে: কেন খ্রিস্ট আমায় টেনে তুলবেন না। দেবেন না আমার মনকে সেই নম্রতা, স্বাধীনতা, ধর্মশাস্ত্রেও যুগ চলে গেছে- হায় ধর্ম, হায়রে ধর্মশাস্ত্র! ভগবানের জন্য ক্ষুধিত আমার প্রতীক্ষা, সকল অনন্তকাল ধরে নীচকুলোদ্ভব আমি।

দাঁড়িয়ে আছি আমরিকার সমুদ্র তীরে। ....ফুটন্ত ধাতুর মতো তীব্র তিক্ত সুরাপান করবো। যেমন করতাম প্রিয় প্রপিতামহরা আগুনের ধারে বসে।

যখন আসাটা ফিরে আসবো লোহার মতো শরীর নিয়ে কৃষ্ণ চর্ম নিয়ে, চোখ জ্বলবে উন্মত্তের মতো। চোখ দেখেই লোকে বলবে বলিষ্ঠ হাত। ভয়ানক তৃষ্ণা পাবে আমার, হবো পাশবিক। আমি আজ অভিশপ্ত, স্বদেশকে ভয় করি বাঘের মতো। সবচেয়ে সুন্দর হলো যা, তা হচ্ছে মাতাল ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়া বিস্তীর্ণ বালুকা তটে। ধরি পথ নতুন করে, যে পথ আমার পাপের বঞ্চনায় ভারাতুর। বোঝবার বয়স হতেই সেই পাপের পীড়ন মুখর শিকড়গুলো বুক পর্যন্ত ঠেলে উঠেছে, উঠেই চলেছে আকাশের দিকে আমাকে ধাক্কা মেরে, উল্টে ফেলে, কখনো বা হিঁচড়ে হিঁচড়ে টেনে।

যখন খুব ছোটো, ভালো লাগতো এক দুর্ধর্ষ কয়েদীর কল্পনা- কারাগারের দ্বার যাকে উন্মুক্ত করে দিলো না কোনোদিন। ঘুরে বেড়িয়েছি সেই সব নাম না জানা সরাই আর পান্থশালায় তার ক্ষণ্ন অবস্থিতিতে একদিন যা ধন্য হয়েছে- তার দৃষ্টি দেখেছি আকাশের নীল প্রান্তরে, মুকুলিত শ্রমের বিস্তার, তার নিয়তির গন্ধ পেয়েছি শহরে-শহরে। তার যতো শক্তি ছিল, তা কোনো তপস্বীরও নেই, তার মতো সুবুদ্ধি কোনো ভ্রাম্যমাণের- সে, শুধু সে-ই একমাত্র তুলনা তার মহিমার, তার অবৈকল্যের। শীতের রাত্রির পথ, তার উপর দিয়ে গৃহহীন, বস্ত্রহীন, অন্নহীন করে স্বর আমার তুহিন শীতল হৃদয়কে আঁকড়ে ধরে চেচিয়ে ওঠে’।

র্যাঁবোর কবিতা পড়লেই বুঝা যায়- এ বড় সহজ বিষয় নয়। তার কবিতার ভাব বিষয় এবং অর্থ মনে হয় যেন আকাশেরও অনেক উপরে, নক্ষত্রলোক আর মিল্কওয়ে থেকে মিল্কওয়ে, এক কথায় মহাবৈশ্বিক চেতনায় প্রসারিত ও বিস্তারিত। তাই র‌্যাঁবোর কবিতার অর্থ খুঁজে বের করা সহজ বিষয় নয়।

বিস্ময়ের বিষয় মানুষ যদিও জেনেছে এবং দেখেছে মানবাত্মা ও মানবহৃদয় এক ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত এবং আরো অবলোকন করছে যে, বিদীর্ণ আত্মার এ জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে মৃত্যুও প্রত্যক্ষতা। কিন্তু অস্তিত্ববাদী ও সৃজনশীল মানুষ এই ভয়াবহ অন্ধকার ও নানা যন্ত্রনা এবং হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ও অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত আত্মার আর্তনাদ শুনেই থেমে যাবে কেন? তাই নিজের অস্তিত্ব, সৃজনশীলতা, প্রাণ প্রবাহের গতি ও অস্তিত্বকে প্রমাণ করার জন্য এই অগ্নি গহ্বরেই নেমেছেন জাঁ রাসেন, বোদলেয়ার, মালার্মে ও ভর্লেন এবং কবিতার মহান দেবতা জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো।

তারা দেখেছেন আঘাতে আঘাতে জেগে ওঠবে জীবন, অরুনিমার আভা নিয়ে ফুটবে জীবনের ফুল। পাঁক, অন্ধকার ও বীভৎস কদর্যতায়ই ফুটবে সৌন্দর্যেও ঐশ্বর্য।

প্রতীক চর্চায় বোদলেয়ার, মালার্মে, ভর্লেন এদের মধ্যে র্যাঁবো ছিল তীক্ষ্ণ ও প্রখর। পথে পথে ঘুরেছে মুক্ত পথের পথিক হয়ে। যেমনি জীবনে, তেমনি সাহিত্যে, শিল্পে ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও মাতাল হয়ে ঘুরেছে র‌্যাঁবো। তার ‘মাতাল তরণী’ পড়লেই র‌্যাঁবোর এ মানসিকতার সাথে পরিচিত হওয়া যাবে।

র‌্যাঁবো ছিল সর্বক্ষেত্রেই বিদ্রোহী। বিশেষত প্রতীকের বিদ্রোহী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও সূক্ষ্ণ চিন্তার প্রয়াসী। র্যাঁবো খোলা রাস্তায় মহাঝড়ের ন্যায় ছুটাছুটি করে দেখেছে এ জগতকে।

র‌্যাঁবো সিম্বলিস্ট বা প্রতীকবাদী কবি। এই সিম্বল বা প্রতীকের কথা ভাবতে গেলেই আমাদের স্মরণে আসবে জাঁ রাসেন, বোদলেয়ার, মালার্মে ও ভর্লেন। এর আগে অবশ্যি আরো দু’জনের ক্ষীণ আভাস আসবে তারা হলেন সুলিপ্রুধোম ও মিস্ত্রাল। তবে আমাদের এর প্রথম পথিকৃৎ জাঁ মারিয়াকেও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতে হবে।

র‌্যাবোর জন্ম ফ্রান্সের এক প্রান্তিক শহরে। এই ছোট্ট শহরটির নাম শার্লভিল। জন্ম তারিখ ২০ অক্টোবর, ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর পুরো নাম জাঁ নিকোলাস আর্তু র‌্যাঁবো। বাবা ফ্রেডেরিক র‌্যাঁবো ছিলেন ফরাসি সেনাদলের ক্যাপ্টেন। বাবার সাথে মা’র সম্পর্ক ছিল খুবই অস্বস্তিকর। র‌্যাঁবোর বয়স তখন দু’বছর- মা ও বাবার মধ্যে চিরতরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়- এবং মা’র কাছেই র‌্যাঁবো বড়ো হয়েছে। এক বিচিত্র জীবন র‌্যাঁবোর। ছোট্ট শহর শার্লভিলে তাদের বাড়ির নিচেই বিরাট এক লাইব্রেরি। দুনিয়ার যতোসব বই এখানে। দিনরাত এখানেই বসে বসে হরেক রকমের বই পড়তো র‌্যাঁবো। তার দুটি মহাদূরবীক্ষণের ন্যায় চোখ দিয়ে যা দেখতো তাই হৃদয়ে এবং মস্তিষ্কে ধারণ করতো। ধারণ করার ক্ষমতা ছিল আলৌকিক। বইয়ের পাতায় চোখ ফেললেই তার পড়া হয়ে যেতো- গেঁথে যেতো হৃদয় ও মস্তিষ্কে- ভুলতো না কখনো, দ্বিতীয়বার পড়ার প্রয়োজনও হতো না। র্যাঁবো ছিল এক আগ্রাসী পড়–য়া- যা পেতো গোগ্রাসে পড়তো আর এই পড়াকে আত্মীকরণ করে ফেলতো সহজে। বিস্ময়ের বিষয় স্কুলজীবনেই র্যাঁবো পড়েছে ফেনিমোর কুপার, গুস্তাব আইমোর, জুলেভার্নে, পড়েছেন অসংখ্য ভ্রমণ কাহিনী এবং পড়েছেন হেগেল ও সোয়েডনবর্গের দর্শন। সুলি প্রুধোম আর মিন্ত্রাল পড়েছে ফ্রান্সের লোককাহিনী এবং ইতিহাস ও সাহিত্য গভীর জীবন জিজ্ঞাসা ও আত্মজিজ্ঞাসা নিয়ে। প্রাচ্য বিশ্লেষণ করে ভারতীয় ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ, দর্শন, ধর্ম প্রচারক এবং দেব-দেবী ও দেবালয় সম্বন্ধে র্যাঁবো অনবহিত ছিল এমন বলা যায় না কারণ তার লেখাতেই এ সবের উল্লেখ আছে এবং পড়াশুনার ছাপও আছে। পড়াশুনায় এই গভীর আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা এবং জীবন জিজ্ঞাসা ও আত্মা জিজ্ঞাসার তাড়ানায়ই র‌্যাঁবো হয়ে ওঠেছে বিদ্রোহী, তার চোখে ধরা পড়েছে সমাজের ভণ্ডামি, অসংগতি ও ক্লোদ ক্লিন্নতা এবং মেকিত্ব। তাই র‌্যাঁবোর তীক্ষ্ম উচ্চারণ- ‘আমি যে দেখেছি সমুদ্র বহ্নিমান, ধোঁয়া ছুটেছে আকাশে, ডাইনে-বাঁয়ে রত্মাভান্ডারে জ্বলজ্বল করে কোটি কোটি বজ্রাগ্নিতে। সুরাপান নিষিদ্ধ আমার- মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বও চলবে না। এমন কি স্ঙ্গীও হতে পারবে না কেউ।

পুরুত মশাই, শুরু মশাই, প্রভু মশাই, কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আমায় কী ভুলই করলে তোমরা। এ দলের আমি নইগো, নইগো নই- কোনোদিন খ্রিস্টানও ছিলাম না আমি, থাকবোও না কোনোদিন- যে কুলে জন্ম আমার সে গান গেয়ে ওঠে যখনই দুঃখ পায়। আইন বুঝি না, নীতিজ্ঞান শূন্য আমি এক পশু। ভুল করেছো তোমরা।

প্রচলিত সমাজ ও দর্শন আইন ও শাসন ধর্মবোধ ও নীতিশান্ত্র এবং যৌনাচার- যাজকের ভণ্ডামি, প্রথাবদ্ধতার গোড়ামি এবং অন্ধবিশ্বাস ও উপদেশ এ সবের প্রতি ছিল তার বিবমিষা ও বিদ্রোহ। তাই র‌্যাঁবো নিজেই বলেছে। ‘নিজকে সইয়ে নিয়েছি সরল মতিভ্রমে- সত্যি দেখেছি আমি কারখানার জায়গায় মসজিদ, দেবদূতের পরিচালনায় যন্ত্র-সংগীতের বিদ্যালয়, আকাশপথে শকটের মিছিল, হৃদয়ের গভীরে বৈঠকখানা, কত যে দৈত্য, কতো রহস্য! কী এক প্রহসনের নাম চোখে বিভীষিকা ঘনিয়ে তুলেছে। এছাড়া শব্দের ছায়াবাজিতে বুঝিয়েছি যতো কূটতর্ক। অবশেষে আমার চেতনায় এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে খুঁজে পেলাম পবিত্রকে। তৃষ্ণায় ছটফট করেছি, আক্রান্ত হয়েছি প্রবল জ্বরে- ঈর্ষা করেছি পশুর সুখ, শুয়োপোকার নিরাপরাধ বিস্মৃতিলোক, গন্ধমূষিকের কৌমার্যময় তন্দ্রা। তিক্ততায় ছেয়ে গেলো আমার চরিত্র কয়েকটা গাঁথার মতো কবিতায় পৃথিবীকে বিদায় জানালাম’। এই বিদ্রোহের প্রতিম্বিকতায়ই সে হতে চেয়েছে প্রচলিত বৃত্ত ভাঙার দার্শনিক, তাকে হতে হবে দৈহিক যন্ত্রনার এক নরককুণ্ড, জীবনে থাকবে অভিশপ্ত আত্মার অগ্নিদহন আর এ সবকে প্রকাশ করার জন্য তাকে হতে হবে নান্দনিক ঐশ্বর্যের বিভায় উজ্জ্বল আলোকিত এক কবি। প্রারম্ভিক কৈশোরেই গুরুমশায়ের সাথে ক্লাসে লেগে যেত ঠুকাঠুকি। দুনিয়ার তাবৎ বই পড়ে তখনেই র্যাঁবো হয়ে ওঠেছিল এক চলন্ত অভিধান, গুরুমশায়ের ছাঁচে গড়া কথায় তার মন পুরতো না- তাই রক্ত চক্ষুর অগ্নিবাণ নিক্ষেপ হতো তার ওপর। পড়াশুনায় এই তীক্ষ্ণতার জন্যই শুধু গুরুমশায় নয় বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের চেয়েও এগিয়ে গিয়েছিল র‌্যাঁবো- এবং দেখলো সবই ফাঁকি, প্রহেলিকা, মিথ্যে ও ভণ্ডামি কৃত্রিমতার মুখোশ পরে সেজেছে জ্ঞানী, গুণী ও পণ্ডিত। এ সব দেখে শৈশবেই র‌্যাঁবো হয়ে ওঠলো প্রতিবাদী দার্শনিক, নন্দন-লোকের নতুন নান্দনিক, শিল্পকলার প্রচলিত বৃত্ত ভেঙে হাঁটলো খোলা উন্মুক্ত উদার প্রান্তরে। তছনছ করে দিয়েছে কাঠামোগত বিশেষ নান্দনিক জগতের প্রাচীর।

তাই র‌্যাঁবো বলেছে- ‘মন থেকে মানুষী আশার সমস্ত মুকুল নির্মূল করে দিলাম। হিংস্র পশুর মতো চতুর উল্লম্ফনে গলা টিপে ধরলাম প্রতিটি আনন্দের। ডাকলাম জল্লাদদের, মরবার আগে তাদের খাঁড়ার বাঁট কামড়ে ধরবো বলে- জড়ো করলাম জাঁতার কল, তারা যেন দলে পিষে গুড়িয়ে দিতে পারে আমায় বালুর সঙ্গে, রক্তের সঙ্গে। দুঃখই হলো ভগবান। কাদার মধ্যে বিছিয়ে দিলাম নিজেকে- পাপের হাওয়ায় হাওয়ায় শুকনো হলাম, পাগলামির পাকে- পাকে চক্কর খেলাম চমৎকার।

আর বসন্ত এনে দিলো আমার নির্বোধের বীভৎস এক হাসি’।

শার্লভিলে প্রথম জীবনে মায়ের কাছেই তার পাঠ। মা ছিলেন কাব্য পিপাসু। মায়ের কাছেই কাব্য চর্চার ও অনুপ্রেরণা। এ সময় তার জীবনে ঘটে গেছে একটি অনন্য ঘটনা। র্যাঁবো তখন মাত্র তেরো বছরের এক দুরন্ত কিশোর। ছোট্ট ও প্রান্তিক শহর শার্লভিতে ফ্রান্সের যুবরাজের আগমন উপলক্ষে তাকে অভিনন্দন জানালো লাতিন ভাষায় রচিত ষাট লাইনের এক কবিতায়। এই কবিতার মাধ্যমে অনেকের সাথে পরিচিত হলো র্যাঁবো এবং যুবরাজের সাথে নিজেও নন্দিত হলো এক প্রতিশ্রুতিবান কিশোর কবি হিসেবে। এবার র্যাঁবোর সামনে উন্মোচিত হলো আর এক নতুন জগৎ। আরো তিনটি কবিতা লিখে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনি প্রথম পুরস্কার পান। তিনি ১৮৭০ সালে La Revue Pour Tous পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটির রচনাকালে ১৮৬৯ সাল এবং এর শিরোনাম Les Etrennes des orphelins. র‌্যাবোর পড়াশুনা ছিল বহুমাত্রিক। ক্ষুধার্ত গরু, পাখি যেমন সামনে যা পায় তাই বাছ বিচার না করে শুধু গ্রাস করতে থাকে র‌্যাঁবোর অবস্থাও তাই- যে সব বই সামনে পেতো তাই পড়তো। তবে পড়ার কোনো বিরাম ছিল না কখনো।

দুঃখ-বেদনায় ভরা তিক্ত অভিজ্ঞতার এক বিচিত্র রক্তক্ষরিত জীবন ছিল র‌্যাঁবোর। রেললাইনে হেঁটে যাওয়া বা প্রথাবদ্ধ ছকে আটকানো জীবন তার ছিল না। এক দুরন্ত বাধা বন্ধনহারা নোঙর ছেড়া উন্মুক্ত জীবন আর উন্মুক্ত মাঠেই সে মুক্তি খুঁজেছে। তার স্কুলের শিক্ষকদের সাথেও মানসিকতায় জটিলতা দেখা দিয়েছিল বার বার। তাই র্যাঁবো বলেছে- ‘বহুদিনের গর্ব আমার, সম্ভব-অসম্ভব সমস্ত নিসর্গ শোভার ওপরই আছে আমার দখল আধুনিক কাব্য ও চিত্রকলার গগণস্পর্শী খ্যাতির আড়ালে জেনেছি তার চূড়ান্ত অসারতা। আমাকে টানে অর্থহীন ছবি, দরজার ওপর দিকটা, সাজ-সজ্জা, ক্রীড়কের পট, বিজ্ঞাপন ফলক, লোকশিল্পের রং চং সেকেলে সাহিত্য, গির্জার ল্যাটিন, বানান ভুলে ভর্তি আদিরসের বই, প্রাগৈতিহাসিক কাহিনী, রূপকথা, শৈশবের ছোট বই, পুরোনো গীতিনাট্য, সরল অস্থায়ী অমার্জিত ছন্দ।

এরই মধ্যে র্যাঁবো বেশ অনেকগুলো কবিতা লিখে ফেললো। প্যারি যাওয়া, আরো কবিতা রচনা ও প্রখ্যাত কবিদের সাথে দেখা করা এবং পরিচিত হওয়া এ ভাবনা যেন র‌্যাঁবোকে উন্মাদ করে তুলেছে-

এ সময়েই প্যারির বড়ো বড়ো কবির সাথে র্যাঁবো চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগও করলো এবং কয়েকটি কবিতাও পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু কোথাও কোনো কবিতা প্রকাশিত হয়নি, তবে কেউ কেউ তাকে প্যারিস চলে আসার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। র‌্যাঁবো যে দুরন্ত এক কিশোর। দু’চোখে দুনিয়াটাকে ছেঁকে নেবার জন্যই যেন তার জন্ম। তাই এক জায়গায় অবস্থান আর ঘরে বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে যে মুক্তি চায় প্রথাবদ্ধ জীবন ও সংস্কৃতি হতে মুক্তি; প্রচলিত ধর্ম ও চিন্তাচেতনা হতে মুক্তি এবং সে যেন বলতে চায়-

আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,

আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে।...

বিশ্ববিধাতার যজ্ঞশালা, আত্মহোমের বহ্নিজ্বালা

জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি আশে।

এবার র‌্যাঁবোর জীবনে শুরু হলো আর এক নতুন পর্ব। ১৮৭০ সালের ২৯ আগস্ট ষোল বছরের দুরন্ত কিশোর র‌্যাঁবো বাড়ি থেকে পালিয়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চিত্রশিল্প বিশেষ করে কবিতার স্বর্গ এবং স্বপ্ন রাজ্য প্যারিতে তার যাত্রা কিন্তু রেলে বিনা টিকিটে। শেষ পর্যন্ত তার হাজতবাস। বন্ধু শিক্ষক ও কবিতার প্রেরণাদাতা জর্জ ইজামবার্ডের সহায়তায় পেলো মুক্তি। মাত্র কিছুদিন বাড়িতে তবে কবিতা লেখার বিরাম নেই তার।

দুনিয়াটাকে দু’ চোখে ছেঁকে নেবার এক দুর্নিবার দুরন্ত কিশোর যে র‌্যাঁবো। এক জায়গায় অল্পক্ষণ থাকলেই তার চোখে সবই বিবর্ণ মনে হয়। পৃথিবীটা মনে হয় পাণ্ডুর ও ধূসর। তাই বাড়িতে বা নির্ধারিত স্থানে কে আটকে রাখবে তাকে! আবার বাড়ি থেকে পলায়ন। এবার তার গন্তব্য ব্রাঁসেলস। কিন্তু তার শিক্ষক বন্ধু ইজামবার্ড যেন বার বারই ত্রাণকর্তা হিসেবে ছায়ার মতো তার পেছনে তাকে অনুসরণ করে। তাই ব্রাসেলসে পালিয়েও তার মুক্তি নেই। সেখানে ইজামবার্ডের এক বন্ধু তার পরিচয় পেয়ে তাকে অনেক করে বুঝিয়ে পকেটে কিছু টাকা দিয়ে গাড়ির টিকিট কিনে সোজা বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।

র্যাঁবোর মা ছেলের এতোসব কাণ্ড দেখে হতাশ ও হতবাক। শেষ পর্যন্ত ভর্তি করে দিলেন এক আবাসিক স্কুলে। কিন্তু স্কুলের সেই প্রথাবদ্ধ নিয়ম মাফিক বুলি এবং বন্দিঘর বা কারাগারস্বরূপ ক্লাস ভালো লাগবে কেন র‌্যাঁবোর! এরই মধ্যে সে অনেক পড়েছে, অনেক জেনেছে, উন্মুক্ত প্রান্তরের শিক্ষা লাভ করেছে এবং দার্শনিক হয়ে ওঠেছে। কিছুদিন বাড়িতে অবস্থান করছে র‌্যাঁবো ঠিকই কিন্তু এ যেন খাঁচায় বন্ধ গর্জন মুখর এক ক্রুদ্ধ সিংহ। পোষ মানবে কেন সে! এ সময়ের মানসিকতা পরে প্রকাশ পেয়েছে এভাবে- ‘আমি আবিষ্কার করতে চেয়েছি নতুন ফুল, নতুন তারা, নতুন আকাশ ও নতুন ভাষা। নিজেকে চিনেছি অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী বলে। এখন এতো কল্পনা এতো স্মৃতির কবর দাও, আর কী! আমার শিল্পের ও কথকতার খ্যাতির এমন একটা সুযোগ হারালাম।

আমি, যে আমি নিজেকে বলে এসেছি অবধূত বা দেবদূত সব রকম নীতি থেকে যে আমি পলাতক, সেই আমাকে কে আজ ফিরিয়ে দিলো মাটির হাতে, সঙ্গে দিলো এমন এক কর্তব্যের ভার যাকে খুঁজে ফিরতে হবে, এমন অকরুণ এক বাস্তব যাকে আঁকড়ে না ধরে উপায় নেই।

জয় অবশেষে আমাকে ধরা দিলো। দাঁতের কিড়মিড় শব্দ আগুনের হিস্ হিস ও বিষিয়ে ওঠা হা-হুতাস এতোক্ষণে নিজেদের সংযত করে আনল- নোংরা স্মৃতির ভিড় মুছে যায়। যা কিছু অনুতাপ ছিল অবশিষ্ট, যার কারণ আমার ঈর্ষা ভিখারীদের প্রতি আমার ঈর্ষা চোর-ডাকাত, মরণের বন্ধু গোষ্ঠী, পেছিয়ে পড়া সব রকম হতভাগ্যদের প্রতি তাও পাততাড়ি গুটোয়। হায়রে অভিশপ্ত জীবন। নিজের ওপর প্রতিহিংসা জাগে আজ। একবারে আধুনিক হওয়া চাই-

ভক্তি সংগীত আর নয়- একবার যখন চলেছো, গতিটি ছেড়ো না। কঠিন রাত। শুকিয়ে ওঠা রক্ত মুখখানা আমায় ধূমায়িত করে দেয়। পেছনে তো কিছুই দেখছি না এক ওই বীভৎস চারাগাছটি ছাড়া আমার মস্ত বড় একটা সান্তনা এই যে, আগাগোড়া মিথ্যা ভরা ওইসব পুরোনো প্রেমের কাহিনী শুনে আমি হো হো করে হেসে ওঠতে পারি, লজ্জায় কুকড়ে দিতে পারি ওই মিথ্যাভাষী দম্পতিদের। কেননা ওদের নরক আমি দেখে নিয়েছি’।

বার বার র্যাঁবোর জীবনের বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। এবার স্কুল থেকে পালালো র্যাঁবো। সম্বল একমাত্র হাতঘড়ি বিক্রির সামান্য ক’টি টাকা। প্যারিতে পাড়ি জমালো। এরপর নেশা, যথেচ্ছাচার যৌন অনাচার পতিতালয়ে পতিতাদের সাথে বসবাস। এরই মধ্যে লিখছে আলৌকিক বাণীর মতো কবিতা। আর এসব কবিতায় বিষয়বস্তু আঙ্গিকে, প্রতীকে, রূপকে ও উপমায় এবং ভাবের গভীরতা ও অনুভূতির তীক্ষ্মতায় প্রচলিত কবিতার ধারাকে তছনছ করে উড়িয়ে দিয়েছে।

প্যারি থেকে বাড়ি ফিরে এলো র‌্যাঁবো- লেখা হয়ে গেলো মাতাল তরণী। এবারের সতেরো বছরের কিশোর র‌্যাঁবো যেন প্রাণোচ্ছল এক পরিণত যুবক। নিজের বয়সকে পরাজিত করে সে অনেক এগিয়ে গেছে, চোখে মুখে এমন কি সমস্ত দেহাবয়ে আলোকোজ্জ্বল কি যেন চাওয়া পাওয়ার চাহিদা।

এ সময় কবিতার শব্দ ভাব বিষয় ও বাণী বিন্যাস নিয়ে নতুন ভাবে যেন গবেষণা করছে র‌্যাঁবো। এরই মধ্যে তার লেখা দু’টি চিঠি সাহিত্যর ইতিহাসে হয়ে রইলো যুগোত্তীর্ণ ও মানোত্তীর্ণ। একটি তার বন্ধু শিক্ষক এবং পাবন জর্জ ইজামবার্ড অপরটি বন্ধু পল ডেমেনিকে। দু’টি চিঠিই পিঠা-পিঠি। ১৩ মে এবং ১৫ মে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে। এই চিঠি দুটিতে র‌্যাঁবো স্পষ্ট করে বলেছে যে, কবিতা সহজ ব্যাপার নয়, কবিতা আত্মার পীড়ন, হৃদয়ের যন্ত্রণা ও রক্তক্ষরণ এবং মানসিক যন্ত্রণার দহন, নিজের দেহ ও মনকে অশান্তির অনলে উত্তপ্ত কড়াইয়ে বলক দিতে হবে, প্রতি লোমকূপে ঝরাতে হবে রক্ত বিন্দু, প্রতি মুহূর্তে যৌন সম্ভোগকে সৃজনশীল ও নান্দনিক এবং কলামণ্ডিত করে নতুন উন্মত্ত আগ্রহ ও আনন্দ সৃষ্টি করতে হবে। কবিতা আসলে জ্যামিতিক বা গাণিতিক সূত্রের মতো কিছু নয়- এ হৃদয়, মন ও মস্তিষ্কের ওলট- পালট অবিন্যস্ত একটি প্রক্রিয়া মাত্র।

প্যারির কবিদের র‌্যাঁবো যেন চটিয়েই চলেছে। তার এক একটি উক্তি, কবিতার চরণ ও শব্দ যেন কবিদের কাছে আণবিক বিস্ফোরণ।

বহু বিচিত্র জীবন র‌্যাঁবোর। র‌্যাঁবোর সারাটা জীবনই বিদ্রোহ আর প্রতিবাদের উচ্চস্বরে উচ্চকিত। এবং এই প্রতিবাদ, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের আগুন তার উষ্ণ রক্তস্রোতে ও প্রতি রক্ত কণিকায়। সময়টা প্যারি কমিউনের উত্তপ্তকাল। বিপ্লব, বিদ্রোহ আর আন্দোলনের আগুনে সমস্ত ফ্রান্স উত্তপ্ত। প্রান্তিক ছোট্ট শহর শার্লভিল থেকে সারা পথ পায়ে হেঁটে এসে এ আন্দোলনে একাত্ম হলো র‌্যাঁবো। দৈহিক অবয়বে র‌্যাঁবো সুদর্শন ও লতানো লম্বা। হাত-পা যেন আরো লম্বা। পরনে খাটো প্যান্ট, অবিন্যস্ত মাথার চুল মুখে ধূমায়িত জ্বলন্ত বিরাট চুরুট। সবাই বলতো র্যাঁবোর দুই চোখের আগুনে আর জ্বলন্ত লম্বা চুরুটের আগুন এক হয়ে যেতো।

এবার র‌্যাঁবোর জীবনে আরম্ভ হলো আর এক নতুন পর্ব। কবিতার ক্ষেত্রে ভর্লেন তখন তেমন পরিচিত না হলেও র্যাঁবোর কবিতার মাধ্যমেই তার নামের সাথে পরিচিত। এবং এ পরিচিতিতেই তার কাছে পাঠিয়ে দিলো কিছু কবিতা। র্যাঁবোর কবিতা আর চিঠি পেয়ে ভর্লেন আবেগ ও উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত। উত্তরে লিখলো ‘হে কবিতার আলোক দূত মহান বন্ধু আমার, তুমি কবিতার দেবদূত- যতো তাড়াতাড়ি পারো চলে এসো প্যারি এবং প্যারির কবিকূল অপেক্ষা করছে তোমার জন্য’। এবার কিশোর র‌্যাঁবোর মনে যেন ভরা নদীতে আবেগের জোয়ার। প্রাণের আবেগ যেন ‘রুধিয়া রাখিতে নারী।’ সে রাতেই তার চিরন্তন ও অমর সৃষ্টি ‘মাতাল তরণী’ এবং যেন বাতাসে পক্ষ বিস্তার করে ভোরেই তার যাত্রা প্যারিস।

ভর্লেন ভেবেছিলেন র‌্যাঁবো এক বিশাল ব্যক্তিত্ব ধরনের একটা কেউ হবেন। কিন্তু স্টেশনে গিয়ে এমন কাউকে পেলেন না। তিক্ত-বিরক্ত হতাশ মনে ফিরে এলো বাড়ি। ভর্লেন তখন ঘরজামাই। সুতরাং শ্বশুড় বাড়িতে ফিরে আসা ছাড়া তার আর উপায় কী! অবাক কাণ্ড ভর্লেন বাসায় ফিরে দেখলেন চোখে-মুখে বিদ্যুতের বহ্নিবাণ লিক লিকে সুদর্শন এক উদাসীন কিশোর পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে চুরুট টানছে। তাকে দেখে বিস্ময় বিমূঢ় হলেন ভর্লেন। র‌্যাঁবোর কী যেন এক আকর্ষণে সম্বিৎহারা হয়ে গেলেন ভর্লেন। বিস্ময়ে বিমোহিত হয়ে তার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হলো ‘ও তুমি’! এই নোঙর ছেঁড়া, পথে ভাসা- ছিন্ন বস্ত্র ও ময়লা ভর্তি গা উদভ্রান্ত র‌্যাঁবোকে শুধু মাদাম ফ্লেয়ভিল কেন প্যারির কোনো কবি-সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবী কারো পছন্দ হয়নি। মাদাম ফ্লেয়ভিলতো তার উচ্ছন্ন আচরণে অতিষ্ঠ ও ত্রাহি ত্রাহি করছেন। এরই মধ্যে র‌্যাঁবো এমন কিছু অঘটন ঘটালো যা শুধু শিষ্টাচারবহির্ভূত নয়- নোঙরামির শেষ তলানি। যেমন :

১. খাবার টেবিল পা তুলে বসে পা নাচানো। ২. কারো অনুমতি না নিয়েই খাবার ঘরে উগ্র তামাকের পাইপ টেনে ধোঁয়ার গন্ধে ঘরময় ভরে তোলা ও সবার অস্বস্তি সৃষ্টি করা। ৩. সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় বাগানে শুয়ে থাকা এবং মাদাম ফ্লেয়ভিলের দৃষ্টিতে পড়া।

এমন অনাসৃষ্টির আপদকে কে সহ্য করবে! তাই এমন পরিবেশে শুধু র্যাঁবো কেন ভর্লেনেরই নীড় হারা অবস্থা। ভর্লেনের সাথে সমস্ত পরিবারের মনোমালিন্য ও অসহযোগ অবস্থা।

দুরন্ত কিশোর র‌্যাঁবোকে নিয়মের নিগড়ে আটকে রাখবে কে? তাড়া খাবার আগে সে নিজেই প্যারির রাস্তার পরিব্রাজক। হেঁটে আর অনাহারে শ্রান্ত ও ক্লান্ত অবসন্ন র্যাঁবো। র্যাঁবোর অভাবে ভর্লেনের দুরন্ত ব্যাকুলতা প্যারির রাস্তা হতে উদ্ধার করলো তাকে এবং কবি বন্ধুদের কাছে চাঁদা তুলে তার থাকা-খাওয়ার একটা ব্যবস্থাও করে দিলো ভর্লেন।

সমসাময়িক কবিদের কোনো পাত্তাই দিতো না র‌্যাঁবো। তবে বোদলেয়ারের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল। বলতে গেলে র‌্যাঁবোর মাধ্যমেই বোদলেয়ার কবিতার মঞ্চে নতুন করে আবির্ভূত হলো এবং প্যারির কাব্যলোকে র‌্যাঁবোর ঘোষণা- ‘বোদলেয়ার হচ্ছে কবিদের রাজা ও কবিদের শিরোমণি।’

ভর্লেন ও র‌্যাঁবোর জীবনে শুরু হলো আবার এক নতুন নাটক। র‌্যাঁবোকে কিছু টাকাসহ চিঠি লিখলো ভর্লেন- কী করুণ মিনতি- 'আমি কারাগারে মরে যাচ্ছি' এই বন্দি জীবন আমার সহ্য হচ্ছে না- 'প্রিয় বন্ধু আমার, তোমার সঙ্গ ছাড়া আমি বাঁচবো না- আমাকে বাঁচাও। আমাকে রক্ষা করো।' আর এ সময়েরই সৃষ্টি 'নারকী রাত্রি' ও 'নারকী প্রেমিক'। এখানে কিছু অংশ উপস্থাপন করছি-

সুস্বাদু গরলের এক ঢোঁক গিলে ফেলেছি। যে-নির্দেশ এলো আমার কাছে তা ধন্য হোক, ধন্য হোক। সুস্বাদু জ্বালায় জ্বলে গেলাম। প্রচণ্ড গরমে আমার গা-হাত-পা বেঁকেচুরে শেষ হয়ে গেলো। বিকৃত হয়ে গেলাম। কে যেন আমায় ছুঁয়ে ফেলে দিলো। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে এলো চেঁচাতেও পারিনি। এই-ই নরক। এই যন্ত্রণার শেষ নেই! দ্যাখো, দ্যাখো, আগুন কি করে মাথা তুলেছে! আমাকে জ্বলতেই হবে- জ্বল তবে রাক্ষস।

একদিন না একদিন নরক আমায় টানতোই আমার ক্রোধের জন্য। আমার অহংকারের জন্য এবং সোহাগেরও এক নরক; কী বিচিত্র এক টান নরকের!

অবসন্ন হয়েই মরেছি কেবল। তাতেই তো করব- পালাই কৃমির উদ্দেশে সাংঘাতিকের চেয়েও সাংঘাতিক! শয়তান ভাঁড়, আমাকে চুর্ণ করতে চাও তোমার মোহিনী মন্ত্রে। আমি চাই, দাবি আমার, আমাকে দাও কাঁটা, একটি খোঁচা শুধু দাও আগুনের একটি বিন্দু।

আবার জীবনে ফিরে যাওয়া! চোখ বুলালো হাজার বিকৃতিতে! আর সেই গরল, সহস্রবার অভিশপ্ত সেই চুম্বন। আর সেই দুর্বলতা আমার। নিষ্ঠুর পৃথিবী। দয়া করো ঈশ্বর লুকিয়ে ফেলো আমায়! কী অশিষ্ট আচরণ আমার! লুকিয়ে আছি, আবার লুকিয়ে নেই। আগুনটা তার হতভাগ্য সহচরকে নিয়ে জ্বলে ওঠে বার বার।’ (নারকী রাত্রি)

‘আমি এখন পৃথিবীর অতল তলে- হায় বন্ধুরা! না, না, বন্ধুতো নয়- এই প্রলাপ, এই যন্ত্রণার তুলনা নেই কী মূঢ়তা! আমার যে বড়ো কষ্ট, আামি যে কাঁদছি- সত্যিই বড়ো কষ্ট আমার। যদিও সবই পেতে পারতাম- আমি জর্জর সেই গ্লানি ও ঘৃণায় যা যোগ্য চরম ঘৃণার্হ হৃদয়ের। ...সত্যিকারের জীবন সরে গেলো আমাদের কাছে থেকে। ও যখন যায় আমিও যাই- তা-ই তো দরকার। অথচ প্রায়ই ও আগুন হয়ে উঠতো আমার ওপর- এই আমি, আমার নিরুপায় আমার ওপর। একটা অসুর যেন, অসুরই বটে’। (নারকী প্রেমিক)

নিন্দে-কুৎসা নিয়ে প্যারির পরিবেশ অসহ্য মনে হয়েছিল- ভর্লেন আর র‌্যাবোর। তাই প্যারি ছেড়ে দু’মাস থাকলো বেলজিয়াম, এরপর সেখান থেকেই আবার দু’জনে শার্লভিতে র‌্যাঁবোদের খামার বাড়িতে কিছুদিন থেকে দু’জনে পাড়ি জমালো লন্ডনে। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে র‌্যাঁবো ফিরে গেলো শার্লভিতে মা’র কাছে। কিন্তু ভর্লেনকে ছেড়ে র‌্যাবোরও মন টিকছে না, তাই ফিরে এলো লন্ডনে ভর্লেনের কাছে। কিন্তু র‌্যাঁবোর পড়ার অভ্যেস কমে নি। বৃটিশ মিউজিয়ামে গিয়ে পড়ে ফেললো বেশ কিছু মূল্যবান বই, তবে এর মধ্যে কাব্য ও দর্শনের বই-ই বেশি। কিন্তু এর মধ্যে ভালো কবিতা রচনারও বিরতি নেই। এ সময়ই কবিতার সমস্ত ব্যাকরণ, নিয়ম রীতি ও আঙ্গিক প্রকারণ ভেঙে র্যাঁবোর অমর সৃষ্টি Une Saison EN Enfer (নরকে এক ঋতু)। যা র‌্যাঁবোর বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী মানসিকতার ফসল।

নারীর প্রতি মোহ কোনোদিনই ছিল না র‌্যাঁবোর। কিন্তু এরপরও ঘটলো এক অঘটন। লন্ডনে একটি মেয়ের প্রেমে পড়লো র‌্যাবো। এবার র‌্যাঁবো বুঝলো- নারীই জীবনের সবকিছু এবং নারীর ভালোবাসা ও নারী প্রেমই যথার্থ ভালোবাসা ও প্রেম। এবার ভর্লেনের প্রতি তার বিকর্ষণ। ভর্লেনের সাথে সংঘাত, জীবনের চরম বিপর্যয়, এতো-সবের পরে কবিতার জগৎ হতে চিরতরে বিদায় নিলো র‌্যাঁবো এবং এরপর আর কবিতা রচনা করেনি। সে ১৮৭৪ সনের কথা। র‌্যাঁবো নিজেই তার কুড়ি বছর পার হবার কথা বলেছে- ‘মানুষের শ্রম! সেই বিস্ফোরণেই আমার অতল কালো গহ্বর থেকে চমকে ওঠে।

মিথ্যে দেমাক তো নয়- চলো বিজ্ঞানের পথে, চলো সম্মুখ পথে’।... আর একটু জোরে পা ফেলো- তাড়াতাড়ি!- রাত্রির এই গভীরে শাশ্বতী লুকিয়ে রাখে ভাবীকালের পুরস্কার। আমাদের কপালে কি কিছু জুটবে না?

আমার জীবনে তো আর কিছু নেই, তাকে ব্যবহার করা হয়ে গেছে।...এ যাত্রা বেঁচে যাবো আমোদ করে। আসুরিক প্রেম আর আজগুবি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্বপ্নদেখে নালিশ করবো, তর্ক বাধাবো পৃথিবীর যতো বাহ্য সাদৃশ্য নিয়ে, তর্ক করবো ক্রীড়ক নিয়ে, ভিখারী, শিল্প-ডাকাত-পুরুত নিয়ে। ধূপের প্রবল গন্ধ এমন করে ফিরে এলো আমার হাসপাতালের শয্যায়- শহীদ যে, তার আত্মনিবেদনের পূতগন্ধী দ্বারিক সে।

ওইখানে চিনতে পারি আর শৈশবের কলুষিত শিক্ষাকে। এরপর! কুড়িটি বছর পেরিয়ে আসা। সকলেই আসে। না- আজ আমার বিদ্রোহ মৃত্যুর বিরুদ্ধে। গর্বের চোটে কাজটা খুবই হালকা মনে হচ্ছে। যে বঞ্চনা করে গেলাম পৃথিবীকে, তার যন্ত্রণা যেন ক্ষণস্থায়ী হয়। চরম মুহূর্তে, আক্রমণ চালাবো এদিক, ওদিক, ডাইনে-বায়ে...।

র্যাঁবোর কবিতার এসব উক্তি বিশ্লেষণ করলেই তার মানস চর্চা ও চর্যার শাশ্বত রূপ প্রতিভাত হবে আমাদের কাছে। র্যাঁবো আরো বলেছে- স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো কোনো কমনীয় যৌবন, শৌর্যপূর্ণ ও কল্পনায় কল্পিত, তা কি পাই নি অন্তত একবার- কতো বড়ো সেই ভাগ্য! এমন কী ভুল করেছি, কী সে- পাপ যার যোগ্যতায় অর্জন করলাম এতো বড়ো দৌর্বল্য তুমি তো ভান করো, বলতে চাও যে, জন্তুরাও দুঃখের দীর্ঘশ্বাস ফেলে, রোগীরা গুমরোয় হতাশ্বাসে, দুঃস্বপ্নে আকুল হয় মৃতরা- আমার পতন আর ঘুমের ইতিহাস বর্ণনা করো না একবার! আমি নিজেকে আর ভোলাতে চাই না বিবাগীর এই অবিরাম ‘পেটার’ আর ‘আভে মারিয়া’য়। আর বলতে পারি না আমি!

তুমি বিশ্বাস আজ, নরকের সঙ্গে সম্পর্ক আমার এইখানেই শেষ হলো না! সে নরক ছিল ভালো প্রাচীন তার দরজা খুলেছিলেন মানুষের মহান সন্তান।

একই মরুভূমিতে, একই রাত্রে, আমার ক্লান্ত চোখ বার বার জেগে ওঠে শুক্তিবর্ণ তারায় তারায়, জীবননাথ যদিও নিশ্চল, প্রজ্ঞার সেই তিন মূর্তি হৃদয়, আত্মা ও চেতনা। কবে যাবো আমরা ওই কঙ্কর বিছানো সৈকত ও শৈলশৃঙ্গের পাশ দিয়ে, নমস্কার করবো নতুন শ্রমের জন্মকে, নতুন প্রজ্ঞাকে- পালাবে বর্বর দস্যুদল, অন্ত হবে সব কুসংস্কারের, সে দিনই ধরনীতে হবে প্রথম খ্রিষ্টোৎসব। প্রথম পূজার দিন। আকাশ গেয়ে উঠলো পথিকের চলায় চলায়। বন্দি যারা তারা যেন জীবনকে আর অভিশাপ না দেয়।’

কাব্য জীবনে র‌্যাঁবো কী করেছে এটাই বড় কথা নয়- বরং কী করেনি তাই বড় বিষয়। জীবনকে দলিত-মথিত করেছে র্যাঁবো এবং দেবাসুরের সমুদ্র মন্থনের মতোই র্যাঁবো জীবন সমুদ্রকে মন্থন করে পৃথিবীকে ও কাব্যলোকে দিয়েছে অমৃত আর পান করেছে তরল-গরল এবং জীবনের শেষ তলানিটুকু। ভর্লেনের পিস্তলের গুলিতে আহত হবার পর আর কবিতা লিখেনি র‌্যাঁবো। বের হলো দেশ ভ্রমণে- প্রথমে লন্ডন ও জার্মান। ভালো করে রপ্ত করলো ইংরেজি ও জার্মান ভাষা। মাঝে কিছুদিন স্টুটগার্ডে টিউশনি করেছে। এরই মাঝে শিখে নিলো ইটালি, গ্রিক, স্প্যানিশ ও ডাচ ভাষা।

কি বিস্ময়ের বিষয়! জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ভর্লেন স্টুটগার্ডে আবার দেখা করলো। র‌্যাঁবো কিন্তু তাকে ফিরিয়ে দিলো মাতিলের কাছে। র‌্যাঁবো এখন এক অন্য মানুষ। বিচিত্র তার জীবন। ফোরম্যান, কফি কোম্পানির সুপারভাইজার, দীর্ঘ বিশ দিন ঘোড়ায় চেপে পৌঁছে গেলো হারারে।

সেনাবাহিনীতে যোগদানের একমাস পর পলায়ন। টানা দশ বছর কাটিয়েছে আফ্রিকায়- জড়িত হয়ে পড়েছে হাতীর দাঁত ও দাস ব্যবসা এবং বন্দুকের চোরাচালানে। এই চোরাচালানের সময় পায়ে গুলি খেয়ে দেশে ফিরে হাসপাতালে ভর্তি হয়। একটি পা উরু পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়। ৩৭ বছর বয়সে স্বজনহারা হাসপাতালে বোন ইসাবেলের কোলে মাথা রেখে কবিতার দেবতা ও কবিতার আলোকদূত মৃত্যুবরণ করে। বিস্ময়ের বিষয় বোন ইসাবেলাও জানতো না যে, তার ভাই এতো বড়ো কবি ছিলেন।

নিয়তির পরিহাস, এতো কিছুর পরও ভর্লেন ভুলতে পারেনি র‌্যাঁবোকে। র‌্যাঁবোর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ভর্লেনও মৃত্যুবরণ করেন কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে র‌্যাঁবোর সমস্ত লেখা প্রকাশ করে যান।

র্যাঁবোর মৃত্যুর পর তার বিরোধীরাই প্রশংসা করে বলেছে- প্রতীক, চিত্রকল্প, রূপক এবং বিশেষ করে শব্দের যোজনা তথা বাণীবিন্যাসে র‌্যাঁবো এক অলৌকিক কবি। কবিতার প্রতীক ও শব্দ যোজনায় র‌্যাঁবোর তুলনা হয় না। তখন বলা হতো বাণীবিন্যাস তথা শব্দই কবিতার প্রাণ ও আত্মা। এ প্রসঙ্গে এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে হয়। মালার্মের এক চিত্রকর বন্ধু তাকে জানালো যে, তার ভেতর ভাবের প্রচণ্ড পীড়ন কিন্তু তিনি একটিও কবিতা লিখতে পারছেন না। উত্তরে মালার্মে জানালো- One does not write a poem with ideas. One writes it with good words. অর্থাৎ ভাবকে নান্দনিক ঐশ্বর্যে কবিতায় রূপদান করতে হলে সুন্দর শব্দ ও বাণী বিন্যাস চাই।

একজন শক্তিমান কবির হাতে এক একটি শব্দ হয়ে ওঠে ভয়াবহ ভূমিকম্পের মতো, বিসুভিয়াসের বিস্ফোরণের মতো, বজ্রের মতো ও এটমের মতো শক্তিশালী, প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডবের মতো, সাগরের উত্তাল গর্জনের মতো, সূর্যের মতো তেজোদীপ্ত, আকাশের ও দিগন্তের মতো বিস্তার এবং পূর্ণিমার চাঁদের মতো আলোকোজ্জ্বল ও সাগরের মতো অতলান্ত গভীর। তাই আর্য ঋষিরা ঈশ্বরের কাছে শৈল্পিক শব্দ এবং ওজস্বী ও আবেদন ঋদ্ধ উচ্চারণ প্রার্থনা করতেন যেন ঈশ্বরের কাছে তার প্রার্থনার কণ্ঠস্বর পৌঁছে। র্যাঁবো তার কবিতায় এই প্রার্থিত শব্দেরই এক আলৌকিক কবি। র‌্যাঁবো জীবন্ত- র‌্যাঁবো প্রাণবন্ত। কবিতায় ও ভাবে, রূপক ও প্রতীকে, চিন্তা-চেতনা ও শব্দের অভিযোজনায় র‌্যাঁবোর বিদ্রোহ চলবেই। র্যাঁবোকে পড়ে, র‌্যাঁবোকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে, র‌্যাঁবোকে বুঝিয়ে কেউ কখনো শেষ করতে পারবে না। তার সৃষ্টি অল্প- কিন্তু তাই পারমাণবিক শক্তিতে ভরপুর- ভেতরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। সৌরচুল্লির কেন্দ্রীয় তাপের মতো র‌্যাঁবোর কাব্যের মহৎ ভাব ও উত্তাপ কালান্তরে উৎসারিত হবে। র‌্যাঁবোর কবিতা ও ভাব কখনো জরাগ্রস্ত হবে না। এ যেন সে পৌরাণিক ফিনিক্স। বারবারই জরাকে পরিহার করে নব কলেবরে পক্ষ বিস্তার করবে ইকারোসের উজ্জ্বল আকাশে। কোনো জরা কোনো জীর্ণতা র‌্যাঁবোকে আচ্ছন্ন করতে পারবে না। ফ্লোরেন্সের রাজপথে প্রৌঢ় দান্তেকে হেঁটে যেতে দেখে নাকি যুবতীরা বলতো নরকের পথে হেঁটে হেঁটে তাঁর দাঁড়ি পুড়ে গেছে। কিন্তু নরকের আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটেছে র‌্যাঁবো- মাঝে মাঝে শুধু আগুনের ওপর দিয়েই হাঁটেনি আগুনের ভেতর ডুবে গেছে- নরকের গলিত লাভা স্রোতের প্রলেপ আচ্ছাদিত হয়েছে সমস্ত গা কিন্তু র‌্যাবোর গায়ে একটুও আঁচ লাগেনি- তার গায়ের একটি লোমও পুড়েনি। র‌্যাঁবো বলতো, ‘আমার কবিতা কোন তরুণী বা যুবতীর জন্য নয়।’ র‌্যাঁবো কবিতা অভিঘাত করেছে শুধু ফ্রান্সে নয় জার্মান-গ্রিকে, স্পেনে এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও। র‌্যাবোকে স্বাগত জানিয়ে নন্দিত করেছেন ভিক্টর হুগো, পাবলো নেরুদা, ব্রেশট। নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে র‌্যাঁবোর উচ্চারণে তারা উচ্ছ্বসিত হয়েছেন।

আলবেয়ার কামুর মতে, কবিদের মধ্যে র‌্যাঁবো সেরা এবং বৃত্ত ভাঙার এক বিদ্রোহী কবি। আদ্রে ব্রেতোঁস বলেছেন র‌্যাঁবো কবিতার ‘এক কিশোর দেবতা’ আর রেঁনের ধারণায় র‌্যাঁবো কুমারী সভ্যতার প্রথম কবি। র‌্যাঁবোর পরে যারা নতুন কবি, বৃত্ত ভাঙার কবি, তাদের এমন একজনও নেই যাদের উপর র‌্যাঁবোর প্রভাব প্রতিফলিত হয়নি। ফ্রান্সের চরম ক্রান্তিলগ্নে অস্থিরতা ও উত্তেজনায় র‌্যাঁবো অসীম এবং অনন্তের উদ্ভাসে অনন্ত সত্তায় আলোকিত জীবনের সন্ধান করেছে। সমস্ত গ্লানি ও কলঙ্কের ওপর গড়তে চেয়েছে অনন্ত সত্তা।

আমাদের এখানে অবশ্যি স্মরণে রাখতে হবে যে, র‌্যাঁবোর বিশ বছরে বয়সের পরের যে জীবন এ জীবন কবি র‌্যাঁবো বা সাহিত্যিক র‌্যাঁবোর জীবন নয়। আর এ জন্যই বিশ বছর পূর্তির প্রাক্কালে র‌্যাঁবোর বিদ্রোহের আর এক বিস্ফোরিত জীবনের প্রচণ্ড প্রজ্বলন। আর এ জন্যই বিশ বছরপূর্তির প্রাক্কালে র‌্যাঁবো তার নিজের কিছু মহৎ রচনার পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলে প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে। শুরু হয় তার অন্য এক জীবন। যে জীবন নিজের ওপর নিজের অত্যাচারের। সুতরাং র‌্যাঁবোর কাব্যজীবন ও সাহিত্যিক জীবনের সাথে বিশোত্তীর্ণ এ জীবনের কোনো সম্পর্কই নেই। গবেষক সাহিত্যিক ও কবিতা প্রেমিক এবং এমন কি কবিরাও আমার সাথে একমত হবেন না জানি; কিন্তু আমার ধারণা র‌্যাঁবোর কবিতার ভাব ও ভাষা, রূপক ও প্রতীক এবং চিত্রকল্প ও উপমা এতোই গভীর ও সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন যে, মনে হবে দূর অসীম অনন্ত ওই আকাশের নক্ষত্রলোক থেকে যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়ে আসা আলো। অন্য কথায় বলা যায় র‌্যাঁবোর কবিতা অসীম অনন্ত আকাশের যেন মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথ- যেখানে কোটি কোটি নক্ষত্র আলো দিচ্ছে কিন্তু সবটুকু বুঝে যাচ্ছে না- দেখাও যাচ্ছে না অথচ সেখানে আলোর উৎসব ও ঝর্ণাধারা বয়ে যাচ্ছে। একবার পড়ে র‌্যাঁবোর কবিতা কিছুই অনুভব ও উপলব্ধি করা যাবে না, মনে হবে ভেতরে সারবস্তা বলতে কিছুই নেই, যেন কেবলই স্বপন করিছে বপন পবনে। আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সবগুলো দ্বারা উম্মুখ রেখে বার বার র‌্যাঁবোর কবিতা পড়লেই তবেই দেখা যাবে তার কবিতা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে অসীম অনন্ত আকাশের ওই নক্ষত্রলোকে মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথে, সাগরের অতল গহন গভীরে, মাটির প্রতিটি কণার অনুযঙ্গে এবং সবচেয়ে দুর্গম মানুষের মনের অতলান্তে। এ ছাড়া আরো বোঝা যাবে র‌্যাঁবোর কবিতার ব্যাপকতা, বিশালতা ও বিস্তৃতি। আমরা তখন আরো উপলব্ধি করবো যে, র‌্যাঁবো সত্যিই কবিতার দেবতা ও কবিতার ফিনিক্স। (সমাপ্ত)

লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

0 comments:

Post a Comment