রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বিষয়ে ভাবতে গেলে শিল্প সাহিত্যের আধুনিকতার
প্রসঙ্গটি অত্যাবশ্যকীয়রূপে এসে পড়ে। বাংলা কবিতার পরিপ্রেক্ষিত বিষয়টি
দীর্ঘকাল হলো নানাভাবে আলোচিত হয়ে আসছে। ফলে এখন বাংলা আধুনিক কবিতা
সম্পর্কে আমাদের চিনত্মার কয়েকটি বিশেষ সাধারণ ধারণা বিদ্যমান। বলাবাহুল্য
এই ধারণার উদ্ভব ঘটেছিল তিরিশ ও চল্লিশের দশকে; এবং তাও ঐ দুই দশকের কয়েকজন
অসাধারণ প্রতীভাবান কবির কাব্যসৃষ্টির এবং সে সম্পর্কে তাদের কয়েকজনের
তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকজন কবিতা সমালোচকের
মূল্যবান বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঐ ধারণাসমূহ আমাদেরকে আধুনিক বাংলা কবিতার
একটি প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞায় উপনীত করেছে। এই সংজ্ঞানুযায়ী আধুনিক বাংলা
কবিতাকে কালের দিক থেকে রবীন্দ্র পরবর্তী এবং গুণের দিক থেকে রবীন্দ্র
প্রভাবমুক্ত বলে শনাক্ত করেছে। এই কবিতাকে আমরা নগরকেন্দ্রিক, যান্ত্রিক
সভ্যতার দ্বারা তীব্রভাবে প্রভাবিত, নৈরাশ্যে নিমজ্জিত, নিঃসঙ্গতাবোধ ও
অনিকেত মানসিকতায় গভীরভাবে আক্রানত্ম, প্রচলিত বাক প্রতীমার পরিহারে
স্বতন্ত্র এবং প্রাত্যহিক চর্চায় উৎকেন্দ্রিক, আর সে কারণে কুটত্ব লাঞ্ছিত-
এইসব বিভিন্ন অভীধায় দীর্ঘকাল হলো চিহ্নিত হয়ে আসছে। আনত্মর্জাতিকতা
স্থাপন করতে গিয়ে এই কবিতাকে আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী
ইউরোপীয় এবং বিশেষভাবে ইংরেজি কবিতার ও কাব্যভাবনা দিয়ে গভীরভাবে প্রভাবিত
ভাবতে অভ্যসত্ম হয়েছি। কিন্তু এই ধরণের বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ায় নিবদ্ধ হয়ে
সম্ভবতঃ এটাও লক্ষ্য করিনি যে, এই সমসত্ম প্রভাব আধুনিক বাংলা কবিতা কমবেশি
অঙ্গে ধারণ করলেও ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক কারণে তার একটি নিজস্ব
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও একটি বিশিষ্ট প্রবহমান ঐতিহ্যের ধারার বিশুদ্ধ
প্রেক্ষাপট বিদ্যমান; এবং তার অনত্মর্গত গুণাবলী ও বহিরাবরণের শ্রেষ্ঠ ও
গুরুত্বপূর্ণ গুণসমূহের চরিত্র নির্ধারণ করেছে সেই অবিনশ্বর উত্তরাধিকার।
সেই তিরিশ ও চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যনত্ম বাংলা কবিতার গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বসাহিত্যের জটিল প্রেক্ষাপটে বাংলা কবিতা নিজেকে স্থাপন করতে গিয়ে যেমন একদিকে একটি বিশুদ্ধ পরিমার্জিত কাব্যবোধের জন্ম দিয়েছে আধুনিককালের বিশ্বসমাজের ধ্যানধারণার অনুবর্তনে, আবার তেমনি অপরদিকে আধুনিককালের বস্তু সমর্পিত, সাফল্য কবলিত, জীবন চেতনার পরিক্রমণে ‘অর্থ, কীর্তি বা সচ্ছলতা’ নয়, বরং তার অনত্মর্গত প্রবাহমান রক্তের ভিতরে অনুভব করেছে ‘ কোন এক বিপন্ন বিস্ময়’, যে বিস্ময় কখনই ধুনক জীবন বীর প্রায়োগিক প্রবণতার দ্বারা চিহ্নিত নয়। আধুনিক মনন তার পরিপার্শ্বকে অর্থাৎ যে বস্তু বিশ্বে তার অসিত্মত্ব তাকে বিশ্লেষণ করে, জীবন ও জগতের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে নিজেকে নিয়োজিত করে, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তার অসিত্মত্বের নতুন দিগনত্ম উন্মোচিত করতে চায়, কিন্তু কখনই সজ্ঞা প্রভাবিত রহস্যের ঊর্ণাজালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেনা। বিশুদ্ধ অবিমিশ্র আধুনিকতা তাই এক অর্থে কবিতার ও শিল্পের পরিপন্থী। আধুনিক মানুষ ‘বিপুলাপৃত্থী ও নিরবধি কাল’ কে অণুবীক্ষণে বিশ্লেষিত করতে আগ্রহী, যে আগ্রহের লক্ষ্য হলো মহাকালের অর্থ উন্মোচন এবং সম্ভব হলে তার অসিত্মত্বের অনুপূঙ্খ ব্যবচ্ছেদ। সম্ভবত অক্টাভিওপাজ আধুনিক মনন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এই কথাটি বোঝাতে চেয়েছেন“...
বাংলা কবিতার বয়স হাজার বছর। চর্যাপদ থেকে হাজার বছরের এ পথচলায় আশ্চর্যময় সব বাঁক নিয়েছে বাংলা কবিতা। কবির গভীরতম অনুভূতি, কবিতার গঠনশৈলী, ভাষার প্রবহমানতা, কবিতার উদ্দেশ্য, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিপার্শ্ব এবং প্রকাশ ভঙ্গির স্বাতন্ত্রসহ নানাবিধ কারণে মঙ্গল-কাব্য, পুঁথি-কাব্য, বৈষ্ণব পদাবলির মাধ্যমে পেয়েছে বহু বর্ণিল রূপ। ঊনিশ শতকের কবিরা বৃটিশ ঔপনিবেশিকতাকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন হাজার বছরের ঐতিহ্যকে। প্রত্ন-প্রবণতা ভেঙে মাইকেল মধুসূদন দত্তই প্রথম বাংলা কবিতাকে চারিয়ে দেন বিশ্বকবিতার কক্ষপথে। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মিলনসাধনে ব্যাপ্তি দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক বৈষম্যবিরোধী এক বিপ্লবী মেজাজ সঞ্চার করেন কাজী নজরুল ইসলাম। ত্রিশের দশকের কবিগোষ্ঠী বাসত্মবিক আধুনিকতার উন্মেষ ঘটালেও সে আধুনিকতা ছিল অনেকটাই শেকড়চ্যুত। বিংশ শতকের প্রথম তিন দশকে আলোকবিন্দু ফেলা হয়েছে ইংরেজি শিক্ষিত শেকড়চ্যুত আধুনিক কবিদের ওপর। সাতচল্লিশের দেশভাগ বাংলা কবিতাকে করেছে দ্বিচারী। চল্লিশের কবিরা মুখের ভাষা কবিতায় আনতে চেয়েছেন। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কবিদের হাতে পেয়েছে প্রানত্ম থেকে আনত্মর্জাতিকতার ব্যাপ্তি। বিগত পঞ্চাশ বছরের লালনে-সৃজনে বৈচিত্রতর হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতা। আধুনিক বাংলা কবিতা বিশ্বকবিতার ওপর কোন প্রভাব বিসত্মার করতে পেরেছে কিনা তা স্পষ্ট না হলেও ভাব, বিষয় এবং আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যে ঋদ্ধ করেছে সুনিশ্চিত। আধুনিকতার মূল নির্যাস হলো মহাকালের সমালোচনা, বর্তমান সময় গভীর তাৎপর্যময় সময় প্রকৌশল ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রা হয়তো মানুষকে নান্দনিক অর্থে এমন অনুর্বর ও নীরস দৃশ্যপটের দিকেই অমোঘভাবে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ শিল্পে সঙ্গীতে কবিতায় সৌন্দর্য সৃষ্টির যে কোনো প্রক্রিয়ায় মানুষের যুক্তি বুদ্ধিকে অতিক্রম করে তার বোধের ভেতরে থাকে আরেক চিরনত্মন, এক নির্মোহ সত্য সুন্দরের অভিমুখে অভিযাত্রা যার সজ্ঞা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে দুলিয়ে দেয় জীবনের সকল রহস্যের যবনিকা এবং হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে উন্মোচিত করে তোলে ‘বাতাসের ওপারে বাতাস’ ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ অর্থাৎ সুন্দরের শাশ্বত অথচ দুর্বিশ্লেষ্য জগৎ; আর এই জগৎটাই সকল সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের অনিত্মম অন্বিষ্ট। পরস্পর বিচ্ছিন্ন বস্তু নিচয়, বর্ণ আদল ও অবয়ব এবং ধ্বনি থেকে শিল্পী ও কবির মনে জন্ম নেয় এক বিশুদ্ধ সুন্দরের আবেগ যা অযোধ্যার চেয়েও সত্য হয়ে ওঠে অকস্মাৎ; হঠাৎ করে দেখা কোনো এক বিরল মুহূর্তে বাচন ও অনির্বচনীয়ের ভাষা ও কল্পচিত্রের সংযোগ রচিত হয়ে যায়, যেন এমন একটি সত্মরে শিল্পীর বোধ এসে ঠেকে যায় যার কোনো ব্যাকরণ নেই, বিশ্লেষণ নেই, অঙ্কশাস্ত্রের অযৌক্তিক বা ইরেশনাল সংখ্যার মতো। প্রকৃতপক্ষে সভ্যতা যতই অগ্রসর হচ্ছে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতিতে রীতিক রহস্যময়তা যতো স্বচ্ছ হয়ে উঠছে তার কাছে। ততই মানুষের কর্মে, তার শিল্পবোধে এবং সে জন্যেই তার শিল্প সৃষ্টিতে বিশুদ্ধতার পরিচর্যা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আধুনিককাল থেকে শুরু করে বর্তমান কালকে তথাকথিত উত্তরাধুনিককাল বলে ধরলেও এই চরম শুদ্ধতার পরিচর্যাই আপাততঃ জ্ঞানে বিজ্ঞানে ও শিল্পে আমাদের ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’। এই বিশুদ্ধতার পরিচর্যা যা প্রকৃতপক্ষে সত্যানুসন্ধান কবিকে, চিত্রশিল্পীকে, ভাস্করকে কখনও কখনও বিমূর্ততার দিকে প্রণোদিত করে। সমসত্ম দৃশ্যমান অবয়ব থেকে সেইসব অবয়বের মূল নির্যাস টেনে নিয়ে একটি বিশুদ্ধ অবয়ব সৃষ্টির আকাক্সায় সে উন্মোথিত হয়। এই উন্মোথিত হওয়া, এই উদগ্রীব অন্বেষণই শিল্পীর, কবির ও স্বপ্ন দ্রষ্টার অনন্য জাগরণ এবং সে জাগরণ সমসত্মকালকে অতিক্রম করে যায়। শিল্পী ও বোদ্ধার এই জাগরণ দুর্ভাগ্যবশতঃ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি একই দেশের বিভিন্ন সামাজিক সত্মরে বিভিন্ন জণগোষ্ঠীর মধ্যে একভাবে সঞ্চারিত হয় না, তার কারণ দেশে দেশে এমনকি একই দেশের বিভিন্ন সামাজিক অর্থনৈতিক সত্মর বিন্যাসে একটি সমাজের বিপুল জনগোষ্ঠীতে বাসত্মব ও বৌদ্ধিক অগ্রযাত্রার সমার্থক নয়, ফলে শিল্পীর নতুন উপলব্ধির ধারণা সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে না সর্বত্র। এবং সেজন্যে দেখা যায় শ্রেষ্ঠ কবি বা শ্রেষ্ঠ শিল্পী সবসময় তার সময় থেকে এগিয়ে থাকেন আর সে জন্যই যখন তিনি দ্রষ্টার ভূমিকায়- তখন সমাজের সঙ্গে তার সংঘর্ষ। ইয়েটস যখন ‘কেন্দ্রের টান আর থাকছেনা এবং কেন্দ্রাতীগ শক্তিতে বস্তু নিচয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে’ সভ্যতার এমন অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন তখন প্রকৃতপক্ষে তিনি এই পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতের ধারণাটিকে স্পষ্ট করবার চেষ্টা করছেন, অভূতপূর্ব সঞ্চরমান চিত্রকল্পে, বলাবাহুল্য বিমূর্ত চিত্রকল্পে। কেমন তবে বাংলা কবিতা? প্রশ্নের উত্তরে কবি সাযযাদ কাদিরের ‘বাংলা কবিতা’টির ছয়টি পংক্তি দু’ভাগে উল্লেখ করা যায়।
‘বাংলা কবিতা আমাদের এই বাংলার মতোই।
এর চরণে-চরণে বাজে বৃষ্টির নূপুর
ছন্দে-ছন্দে মেতে ওঠে এলোমেলো হাওয়ার আনন্দ।’
এ তিন পংক্তির মধ্য দিয়ে চর্যাপদ থেকে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলা কবিতার স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতাকে বোঝার জন্য একই কবিতার আর তিনটি পংক্তির শরণাপন্ন হতে হয়।
‘বাংলা কবিতা এ বাংলার মতোই।
ঘুরে-ঘুরে চলে মেঠো এবড়োথেবড়ো পথে
মাত্রার হিসাব, মাপজোখ করে না অত।
তাহলে আসলে যা ঘটছে সময়ের বিবর্তনে ইতিহাসের অমোঘ যাত্রায় সমসত্ম বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বস্তু নিশ্চয় মানব সম্পর্কের পরিবর্তন। তাই এই জীবন ও জগৎকে কবি সেই পরিবর্তিত প্রেক্ষিত প্রত্যক্ষ করছেন; আর সেই জন্যই বদলে যাচ্ছে তার উপমা-রূপক-উৎপ্রোর চেহারা। তার বাচনের প্রস্বর, তার জ্যোতির পারম্পর্য, তার শব্দের চিত্রকল্পের ব্যঞ্জনা ও গূঢ়ার্থ।’ কাজেই কবিতা বিষয়ে ‘আধুনিকতা’র প্রসঙ্গটাই আর অর্থবহ থাকে না। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বা এমনকি পঞ্চাশের দশকেও আমাদের কবিতা সম্পর্কে আধুনিকতার প্রসঙ্গটি হয়তো কিছুটা প্রাসঙ্গিক ছিল। কারণ তৎপূর্ববর্তী কাব্যভাষার সঙ্গে তৎকালের কাব্যভাষার ব্যবধান হয়ে যায় বিসত্মর। এখন এই প্রসঙ্গটিই প্রকৃতপক্ষে অবানত্মর। আরো স্পষ্ট করে বললে তখন বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা ছিল এই অর্থে যে, একটি বিশেষ সময়ের পরিসরে ধরা যাক প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ও তার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে। ‘ধরা যাক যে তা মহাশূন্যে অভিযাত্রার কাল’ পর্যনত্ম প্রসারিত, সমগ্র বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পট পরিবর্তনের সমানত্মরালে কবিতার তথা নমনীয় শিল্পের আঙ্গিকে একটি অতি স্পষ্ট ও লক্ষ্যযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছিল। কিন্তু আজকে একবিংশ শতকের ঊষালগ্নে দাঁড়িয়ে আমরা সেই পরিবর্তনের একটি পরিণত রূপ প্রত্যক্ষ করি। তখন প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলতে পারি যে, সেই পরিবর্তনের কারণে শিল্পের মৌলিক চরিত্রে কোনো গুণগত পরিবর্তন আরোপিত হয়নি। - কবিতা এখনও কবিতাই রয়ে গেছে, চিত্রকলা চিত্রকলাই। তবে টেড হিউজ বা টমাস হিনি আলেকজান্ডার পোপের মতো কবিতা রচনা করেন না, শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদ লেখেন না বিহারীলালের মতো, জয়নুল আবেদীন, সুলতান বা কিবরিয়া আঁকেন না রুবেনস এর মতো, অর্থাৎ শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। তার পরিপ্রেক্ষিত হয়তো গেছে বদলে এবং নতুন কিছু যুক্ত হয়েছে তার কৌশলে। ঠিক তেমনিভাবেই কবির কাব্য ভাষায়ও হয়তো যুক্ত হয়েছে কিছু অভিনব বৈশিষ্ট। কিন্তু কবিতার বহিরঙ্গ বা অনত্মরঙ্গ আয়তনে যে ভাষার বঞ্জনায় কেঁপে ওঠা, প্রচলিত অর্থের সীমা অতিক্রম করে শব্দের নতুন অর্থের যে উদ্ভাবক, শব্দের ধ্বনি ও সঙ্গীতে আনন্দের যে অনাবিল নির্ঝর তা কিন্তু বদলায়নি একটুও। হয়তো আগের তুলনায় বর্তমানের কবি আরো নির্মোহ হয়ে খুঁজছেন তার বিশুদ্ধতার অনন্য অবয়ব। সাতচল্লিশের দেশভাগ বাংলা কবিতায় একটি বিশাল প্রভাবসৃষ্টিকারী ঘটনা। সাতচল্লিশ-উত্তর কালে বাংলা কবিতা বিকশিত হয়েছে দুই বিপ্রতীপ স্রোতে। এখান থেকেই বাংলাদেশের কবিতার আলোচনা জুড়তে চাই। চল্লিশের দশকে বাংলা কবিতাতে সমাজতন্ত্র ও নতুন রাষ্ট্রের স্বাপ্নিক ইসলাম সমানভাবে আচ্ছন্ন করে। কিন্তু দ্রুততম সময়ে উল্কার মতো দু’টিরই পতন ঘটে। পঞ্চাশের দশকে এ দু’টি বিষয় আসে নাগরিকতা ও লোকজ চেতনার নতুন মোড়কে। তথাপি পঞ্চাশ দশক থেকেই বাঙালি চেতনার সক্রিয় ও সার্থক উন্মেষ ঘটে। অস্থিরতা ও নৈরাশ্যের অবক্ষয়ের ভেতরেও নিরনত্মর পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও ব্যাপৃত হন ষাটের কবিরা। প্রথাসিদ্ধ পথের বাইরে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প ও শব্দচয়নে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যযুক্ত হয়েছে এ সময়। ষাট দশকে মূল্যবোধের ভাঙচুর ও নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কবিতা পেয়েছে গাম্বির্যতা। সত্তরের দশকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় ছিল চূড়ানত্মভাবে অরাজকতাপূর্ণ। স্বাধীনতার উজ্জ্বল আভার বিপরীতে প্রকাশ পাচ্ছিল বিপন্ন বিস্ময়। স্বাধীনতার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় এ সময় স্লোগানধর্মিতার প্রভাব বিসত্মার করে বাংলা কবিতায়। ত্রিশের দশকে আনত্মর্জাতিকতার বাসত্মবিক উন্মেষ হলেও তার বিসত্মার লাভ করেছে ষাট-সত্তরে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের সঙ্কট ও সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হয়েছেন সত্তর ও আশির কবিরা। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুবাদে নব্বইয়ের দশকের কবিরা নতুন করে প্রাণসঞ্চার করেছেন বাংলাদেশের কবিতায়। লাতিন ও আফ্রিকান মুক্তিকামী মানুষ ও প্রানিত্মক-নিম্নবর্গের মানুষের ঔপনিবেশিকতা বিরোধী কাব্যস্বর প্রভাবিত করেছে আশি-নব্বইয়ের কবিতাকে। বাংলাদেশের কবিতার পরতে-পরতে জড়িয়ে আছে ভাষাআন্দোলন, স্বাধিকার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা-উত্তরকালে গণমানুষের স্বপ্নভঙ্গ, প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব, স্বৈরাচারের উত্থান ও গণতন্ত্রের বিপর্যসত্ম যাত্রা। এমন ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের মুখোমুখি হয় নি ভারতীয় বঙ্গের কবিতা। বাংলাদেশের কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের জীবনসংগ্রাম, ভারতীয় বঙ্গের কবিতায় প্রাধান্য জুড়েছে অসঙ্গতি। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা দুই দেশের বাংলা কবিতার বৈশিষ্ট্য বিচার করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আসলে বাংলাদেশের কবিতা মানেই এই সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্রসংবলিত এক উন্মাতাল বাণীভুবন। পশ্চিম বঙ্গীয় বাংলা কবিতার সঙ্গে বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার মৌলিক পার্থক্য এখানেই।’ বাংলা কবিতায় রোমান্টিসিজম ও রিয়েলিজমের দ্বন্দ্বকে নতুন করে আবিষ্কার করছেন কেউ- কেউ। এ দুইয়ের সম্পর্কে বলছেন, আপাত বিরোধমুখর কিন্তু আখেরে সমানত্মরাল। পাশাপাশি চলে, চলছে এবং সম্ভবত চলবে। বর্তমানের কবিতায় ধর্ম, মিথ, প্রকৃতি ও ইন্দ্রিয়সহযোগে আবহমান বাংলার লোকজ ও ধ্রুপদ রোমান্টিজম জেঁকে বসেছে। পাশাপাশি স্বগতোক্তি, বিবৃতি, প্রাত্যহিক ধারাবর্ণনা ইত্যাদি ফর্মে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে রিয়েলিজম। বলা হচ্ছে, রোমান্টিকতা কৃত্রিমতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে, রিয়েলিটি পরছে মুখোশ। রোমান্টিসিজমে ভারতীয় বঙ্গ ও রিয়ালিজমে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের কবিতা। আসলে দুই দেশের কবিতায় পার্থক্য তৈরি করেছে জীবনবাসত্মবতা, উপলব্ধি, উপস্থাপন ভঙ্গি ও কাব্যভাষা। বাংলাদেশের কবিতা অবিকশিত নগরযন্ত্রণা, জীবনযাতনা, সরব দেশকালের উপস্থিতি, প্রকৃতিবর্ণনা, শেকড়কেন্দ্রিকতার মিশেলে স্বকীয়। ভারতীয় বঙ্গের কবিতায় বিনির্মাণ, রহস্য, অনুভূতি ও নিরীক্ষার জটিল মনসত্মত্ত্ব নির্ভর বিষয়কেন্দ্রিক। বাংলাদেশের কবিতা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, দ্বন্দ্ব-সঙ্কটে টলটলায়মান, হৃদয়াবেগে ফেনা তোলা, অফুরনত্ম-সম্ভাবনায় সামনের দিকে ধাবমান। বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গের কবিতা নিরাবেগ, অবসাদে মনমরা, স্বপ্ন ও প্রাণ-প্রাচুর্যহীন, মেধার বিচ্ছুরণ। ভারতীয় বঙ্গের কবিতায় যেখানে শব্দ বুননের কৌশল পরিণত, জীবনঘনিষ্ঠ ও দ্বিধাহীন সেখানে বাংলাদেশের কবিতায় শব্দপ্রয়োগ, রূপকল্প, উপমা, প্রকাশের ভঙ্গিমায় উচ্ছ্বসিত, চটুলতাপূর্ণ, অপরিণত, জটিল, অনুকরণপ্রিয়তায় দ্বিধাগ্রসত্ম। এপারের কবিতা ছন্দ থেকে বেরিয়ে আসছে, কিন্তু ওপারের কবিতা এখনও দারুণ ছন্দপ্রিয়। তথাপি পাঠকের অভিমত, বিষয়াবলী, ভাষাগত নিরীক্ষা, বিশেষ করে আঞ্চলিক ভাষা ও বাকভঙ্গির ব্যবহারে বাংলাদেশের কবিরা এগিয়ে থাকলেও প্রকরণগত নিরীক্ষায় সমরূপীয় এবং আনত্মর্জাতিক প্রবণতায় দুই দেশের বাংলা কবিতা সমগোত্রীয়। ভারতীয় বঙ্গের নবীনদের পড়ে প্রবীণরা গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি প্রেরণা দেন। বাংলাদেশে যে রীতি গড়ে ওঠে নি এখনও। আমার ধারণা ‘আধুনিকতা’র প্রসঙ্গটি মূলত কোন সময়ের জনগোষ্ঠীর এবং আরো বিশ্লেষিত করে বললে কোন পাঠক গোষ্ঠীর সাধারণ রুচি ও শিক্ষার মান ও প্রকৃতির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। আধুনিকতা সর্বকালেই একটি আপেক্ষিক ধারণা। জন ডান যখন লিখতেন তখন অবশ্যই তিনি অত্যনত্ম আধুনিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার সময়ে অনাধুনিক ছিলেন না। এমনকি বিহারীলালও না। অনগ্রসর এবং সাধারণভাবে প্রতিক্রিয়াশীল রক্ষণবাদের কাছে সমর্পিত সময় থেকে অনেক অগ্রসর শিল্পকর্মকে সমসত্ম যুগেই অভূতপূর্ব ও সেকারণেই দুর্বোধ্য এবং এমনকি উদ্ভট বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তার অনত্মর্নিহিত শক্তিকে অস্বীকার করা বড়ো কঠিন; এবং সেজন্যে তাকে বহুবার কাঠগড়াতেও উঠতে হয়েছে। কেবলমাত্র শিল্পেই নয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে এই সেদিন পর্যনত্ম। ডারউইন সম্পর্কিত ঘটনা তো অল্পকাল আগে।
এসব কিছুর কারণ কিন্তু একটাই প্রচলিত রুচির বাইরে সর্বসাধারণ মানুষ বা একটি সমাজের বিপুল সংখ্যক সদস্য সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। নিউটনের সূত্রের অনুসরণে বস্তুর মতো রুচিতেও পরিবর্তন আনতে হলে কিছু শক্তির প্রয়োজন হয়; এবং সেই শক্তি সরবরাহ করেন পিকাসো বা জয়নুলের মতো শিল্পী, বোদলেয়ার বা জীবনানন্দের মতো কবি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ও প্রসার ও তার সমানত্মরালে রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের আধুনিকতর পরিপ্রেক্ষিত নীরবে বদলে যায়। রবীন্দ্রনাথের গানের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা ও জনপ্রিয়তার প্রসার ঘটেছে অত্যনত্ম স্বল্প সময়ের পরিসরে। এর কারণ যতোটা রাজনৈতিক তার চাইতে অনেক বেশি শিক্ষাগত ও নান্দনিক। কিন্তু তবু কি তার গান সর্বসাধারণের মধ্যে সম্পৃক্ত হতে পেরেছে এতোদিন পরেও? দেশের সর্বত্র কি সমানভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা হচ্ছে বা লোকে শুনছে? কিন্তু তবুও যুক্তিগ্রাহ্যভাবে বলা যেতে পারে যে মূলধারার শিক্ষার ক্রমাগত চিনত্মার এবং সংস্কৃতির ব্যাপকতর চর্চায় মানুষের রুচি পরিবর্তনের ফলে একদিন এমন পরিস্থিতি উদ্ভব অসম্ভব নয় যে রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সাধারণ লোকায়ত ঐতিহ্যের মধ্যে মিশে যাবে। কবিতার ক্ষেত্রেও যে ঐ একই সূত্র কাজ করে তা বলা হয়তো অসঙ্গত হবে না। মানব সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, জীবন জগৎ ও আমাদের পরিপার্শ্ব সম্পর্কে অধিকতর তথ্য ও সংবাদ আহরণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের উপলব্ধির দিগনত্ম ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হয়ে যায়। আর তারই প্রোপটে কোনো মানব গোষ্ঠীর সমকালীন কবিতাসহ সকল শিল্পসৃষ্টি তার নির্দিষ্ট অবয়ব খুঁজে নেয় তার নিজের আর্থ সামাজিক ও মনসত্মাত্ত্বিক বাসত্মবতার নিরিখে। আমাদের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। কেবল কবিতা কেন শিল্পের যে কোন ক্ষেত্রে সম্পর্কে কথাটি প্রযোজ্য- চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নাট্যকলা, সঙ্গীত, স্থাপত্য। এই সমসত্ম ক্ষেত্রেই আধুনিকতা বলতে আপাতত আমরা সাধারণ অর্থে যা বুঝি তা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে জারিত হয়ে আসা কেবল পাশ্চাত্য সমাজে সংঘটিত কিছু পরিবর্তনের চিহ্ন, কিন্তু প্রথমত ও বিশেষতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে কেবল পাশ্চাত্য সমাজই নয় প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ মানব সমাজই একটি নতুন সময়ের মধ্যে জেগে উঠেছিল। পরবর্তীতে বিগত শতাব্দীর মধ্য বিন্দু থেকে আজকের দিন পর্যনত্ম বিশ্ব অর্থনীতিতে যে বৈষম্যমূলক ঊর্ধ্বতন এবং এশীয় উন্নয়নের প্রারম্ভ সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্বের যে বিভ্রানত্ম বাসত্মবতা ‘এইসব রং রক্ত বিভীষিকা’, এবং ‘এইসব ভয়াবহ আরতির ভিতর দিয়ে’ মানব সমাজ হয়তো আরো সংশয়ী হয়েছে। সতর্ক হয়েছে সন্ত্রসত্ম হরিণের মতো। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় সে নিশ্চলতা হারিয়েছে, স্বসিত্ম হারিয়েছে, সচকিত হয়েছে সন্ত্রাসে যখন সে জেনেছে নিজের সম্পর্কে ভীতিপ্রদ হনত্মারক সত্য, পশুশক্তির এখনও জয়জয়কার এবং তার আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা যা শেষ, আপাতদৃষ্টিতে শেষ হবার নয়। কেননা সে এখনও পর্যনত্ম পর্যুদসত্ম হচ্ছে এক নায়কত্বে, স্বৈরাচারে, রাজনৈতিক শঠতার আক্রমণে, আনুপূর্ব মিথ্যাভাষণে, মানুষের বর্তমান ভাষা ও বাসত্মবতার দ্বৈরথে। তার নিজের সমস্যা সম্পর্কে এই ঋণাত্বক জ্ঞানের ভার অনেকক্ষেত্রে দুর্বিষহ হয়ে উঠে তার জন্য। সন্ত্রাস তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে কখনও কখনও। এই উত্তরাধিকারকে সে অস্বীকার করতে পারবে আজ? আমরা কি আর নিরঙ্কুশ আনন্দ আর্জন করতে পারবো সরল একমাত্রিক এলিজি থেকে? কবিতায় কি আমরা আবার ফিরে যাবো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ? হয়তো যাবো, হয়তো যাবো না। হয়তো পরীক্ষা নিরীক্ষা করবো। কিন্তু সেই পর্যায় আর কোনোদিনই ভারত চন্দ্রের পর্যায় হবে না, এমনকি জসীম উদ্দীনেরও নয়। কাজেই আধুনিকতাপূর্ব, আধুনিক ও আধুনিতা উত্তর কবিতা বলে সত্যিকার অর্থে কোন কাব্যিক আঙ্গিকের অসিত্মত্ব আছে বলে ধারণা করা কষ্টকর। কারণ কবিতার ধারাক্রম চিরনত্মন এবং তার মর্মেও রয়েছে মানুষের চিরনত্মন পুরুষার্থ ও তার শাশ্বত নান্দনিক চৈতন্যের প্রবহমানতা, এই চলমানতার মধ্যেই পরবর্তী যুগের কবিতা, ভবিষ্যতের কবিতা নিজের বিশিষ্টরূপটি পরিগ্রহ করে নেবে। কিছু পরিগ্রহণ করবে, কিছু বর্জন হয়তো করবে, কিন্তু তার অনত্মরতম চরিত্রে নির্যাসে এবং অবয়বে থাকবে মানুষেরই চিরনত্মন উপলব্ধি সমূহ- প্রেম-অপ্রেম, রিরংসা, ঈর্ষা, আনন্দবেদনা, সুদূরের পিপাসা সৌন্দর্যের উৎকর্ষে নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার উদগ্র অভীঞ্ঝা। কী রূপে সে প্রতিভাত হবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা নির্ভর করবে ভবিষ্যতের সেই বিশেষ সমাজ বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং তার অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভৌগোলিক, দার্শনিক ও মনসত্মাত্ত্বিক বাসত্মবতার বৈশিষ্ট্যের ওপরে। কেবলমাত্র এইটুকুই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তা মৌলিকভাবে কবিতাই থাকবে অন্য কোনো শিল্প হবে না। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রসঙ্গে আবার স্বাভাবিকভাবেই কিছু কঠিন বাসত্মবতার অনুপ্রবেশ ঘটে যার একটি হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের সমাজ মানসের প্রেক্ষাপট। অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর তৃতীয় বিশ্বে সাধারণভাবে যা ঘটে তা হচ্ছে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার ব্যবহারের মধ্যে সময়ের তফাৎ এবং অনগ্রসর সমাজে জীবনযাত্রার মাঝে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা। অগ্রসর বিশ্বে যখন স্বয়ম্বু প্রযুক্তির ঊর্ধ্বতনের ভেতর দিয়ে অলক্ষ্যে সমাজ মানুষেও বিবর্তন আসতে থাকে আমাদের ক্ষেত্রে তখন উন্নত প্রযুক্তি নিজের ভেতর দিয়ে উদ্ভূত না হয়ে বাইরে থেকে আমাদের ওপর অনেক সময় আরোপিত হয়। অতএব নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব ও বিকাশে যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি অন্যত্র সাধিত হয়েছে তার প্রেক্ষাপট এবং তাকে অন্য আরেকটি একেবারে ভিন্ন পরিস্থিতিতে ধারণ করবার ক্ষমতা- এ দুয়ের মধ্যে বিরাট ব্যবধান থেকে যায়। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ, এমনকি সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির এক বিরাট অংশ এই ব্যবধানজনিত পশ্চাদপদতার শিকার। অতএব তাদের মানসিক বিবর্তন অপেক্ষাকৃত শ্লথগতি হওয়াই স্বাভাবিক। উপরন্তু সকল সমাজে সর্বকালেই সাংস্কৃতিক দিক থেকে বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা সাধারণত নগণ্য হয়ে থাকে। আমাদের দেশে শিল্প সাহিত্যে বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে নতুন করে আধুনিকতা ও তজ্জনিত দুর্বোধ্যতার প্রসঙ্গ এই বাসত্মবতার সঙ্গে সম্পর্কিত। কেননা কবি, চিনত্মাবিদ, দার্শনিক, শিল্পী এরা সাধারণত স্বকীয় সমাজে ও তাদের কায়িক সময় থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকেন এবং এ কারণেই স্ব স্ব সমাজে সমসাময়িক রুচির পরিবর্তনে অনুঘটকের ভূমিকা গ্রহণ করেন তারাই। যিনি যতো বেশি শক্তিমান তিনি ততো বেশি পরিবর্তন ঘটিয়ে দেন। সর্বকালে সর্ব দেশে অলক্ষ্যে এমনটা সংঘটিত হয়ে চলেছে। কাল পরম্পরায় শিল্পের অবয়বে যে পরিবর্তন বা তাতে আধুনিকতার যে পরিচয় বা চিনত্মাসমূহ বিধৃত হয় তা তো মূলত বহিঃরঙ্গে যদিও তার অনত্মরঙ্গেও যে পরিবর্তন সূচিত হয় না তা নয়। তবে স্পনসরের সময় থেকে ফিলিপ লারকিনের সময় পর্যনত্ম চর্যাপদের কাল থেকে আল মাহমুদের কাল পর্যনত্ম পরিবর্তন ঘটেছে কি ইংরেজি বাংলা বিষয় আসয়ে, প্রকৃতি, প্রেম, নারী, ঈশ্বর, মানুষ, মানুষের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা-হতাশা- এই সবই তো সেকালে যেমন একালেও তেমনি সমানভাবে কবির উপজীব্য। আমাদের অনত্মরের গহীন ভেতরে যে চিন্ময়, শাশ্বত বহমান ধারা কাজ করে তার চরিত্রে কি হয়েছে কোনো পরিবর্তন? পরিবর্তন ঘটেছে কি মানুষের গভীরতম নিবিড় অনুসন্ধিৎসার?
কেমন যাচ্ছে বাংলাদেশের কবিতার দিনকাল? কি রূপ বর্তমানের কবিতার? গতিমুখই বা কোন দিকে? এমনতর বহু প্রশ্ন আসছে প্রতিনিয়ত। দশক বিভাজনের পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু প্রবণতার উন্মেষ, চর্চা ও প্রভাব বিসত্মার হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তথাপি অর্ধশতকের কাব্যিক ঐতিহ্য, বিভ্রানিত্ম ও মেধার সংশ্লেষে আশ্চর্য নৈরাজ্যময় বর্তমান। বিগত শতকের আশি ও নব্বইয়ের ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খেতে-খেতে দিগ্বিদিক লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছে নতুন শতকের বাংলাদেশের কবিতা। তত্ত্বচর্চা এখন গৌণ। ধ্রুপদী, রোমান্টিক, মডার্ন, পোস্টমডার্ন ইত্যাদি তত্ত্ব এখন কবিতার ইতিহাসে সময় নির্দেশকমাত্র। চলতি শতকের প্রথম দশকের কবিতায় অবসন্ন হয়ে পড়েছে স্লোগানধর্মিতা, অবসিত হয়েছে প্রেমকাতরতা। কবিতার প্রধান দুই ধারা তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ ও মন্ময় বা গীতিকবিতা। বর্তমানের কবিতায় দুই ধারার একাংশ বর্জিত, অন্যাংশ অতিচর্চিত। তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ কবিতার মধ্যে রূপক, ব্যঙ্গকবিতার চর্চা অব্যাহত থাকলেও পরিত্যাজ্য হয়েছে গাথা, মহাকাব্য, নীতিকবিতা ও লিপি-কবিতা। একইভাবে মন্ময় বা গীতিকবিতার মধ্যে চিনত্মামূলক, প্রেমমূলক, প্রকৃতি বিষয়ক, স্বদেশ-প্রীতিমূলক, লঘু বৈঠকি ও চতুদর্শপদীর চর্চা অব্যাহত থাকলেও পরিত্যাজ্য হয়েছে ভক্তিমূলক, শোক-গীত ও সেত্মাত্র। বর্তমানের কবিতা কথার টুকরো, ভাবের ভগ্নাংশ-নির্ভর এক ভঙ্গুর ও পারম্পর্যহীন বাক্যসমবায়ে বিনির্মিত চিত্রকল্পের জটিল প্রকাশ। পাঠকের অনুযোগ কবিতা হয়ে উঠেছে কৃত্রিম, আড়ষ্ট, বানানো। কবিরা হয়ে পড়েছেন দৃশ্যশিকারী। কিন্তু সে দৃশ্যকে সর্বানত্মঃকরণে অনুসরণ করতে পারছে না ভাবনা। একটি প্রধান ভাব উৎপাদন ও তা অনুসরণ করে কবিতাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা পঞ্চাশ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা ভেঙে যাচ্ছে বর্তমান সময়ে। কবিতা এখন আর আখ্যান ও পূর্ণাঙ্গতাকে ধারণ করতে পারছে না। এক চিমটি লবণের মতো গল্প, মিথ, ইতিহাস, দর্শন, চিত্রের মিশেলে দৃশ্য থেকে দৃশ্যানত্মরে উল্লম্ফনে হয়ে উঠেছে কোলাজ। প্রথম দশকের প্রথম কবিতা সঙ্কলন ‘শূন্যের কবিতা’ সম্পাদনা করেছেন একই সময়ের কবি সোহেল হাসান গালিব। সঙ্কলনের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘মানুষের অনত্মর্জগতে নানামুখী চোরাস্রোতের টানে যে ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়েছে শূন্যের কবিতা সেইদিকে পাঠকের দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছে। সেই ঘূর্ণাবর্তে বিচিত্র জল-কোলাহল চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে উঠছে। এই জলের উৎস যেখানেই থাকুক না কেন, গনত্মব্যের ঠিক নেই কোনও। এখানে তৈরি হয়েছে এক কেওটিক বিভ্রম। এই বিভ্রমকে শনাক্ত করতে গিয়ে আমরা উৎসের দিকে ফিরে তাকাই নি। অর্থাৎ আমরা ইতিহাস-চেতনাকে ঠেলে দিয়েছি বিস্মৃতির দিকে। শূন্যের কবিতা প্রকৃতপক্ষে বিস্মৃতির সাধনাই করেছে বলা যায়। এ যেন নির্জ্ঞান লাভের সাধনা।’ এ দশকের আরেকজন কবি তারিক টুকু’র মতে, ‘এক ধরনের অনির্দিষ্টতা সম্পন্ন, অসঙ্গতিজ্ঞাপক ও চেতনাচূর্ণের এক বহুবর্ণিল ও বহুরৈখিক কোলাজকে বলা যায় শূন্যদশকের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য- যাকে নির্দিষ্টতাজ্ঞাপক কোনও একটি শব্দে বেঁধে ফেলা কঠিন।’ কবিতায় এ অনির্দিষ্টতা ও অসঙ্গতি কিন্তু প্রথম দশকের কবিদের মাধ্যমে আমদানি নয়। তাঁরা বিশেষত্ব দিয়েছেন মাত্র। পরের মুখে ঝাল খাওয়া বাংলা কবিতা পাঠকদের প্রতিষ্ঠিত এক রীতি। প্রতিষ্ঠিত কোনও কবি বা প্রতিষ্ঠান নতুন একজনকে নিয়ে ইতিবাচক মনত্মব্য করলেই মিলছে তাঁর কল্কে। স্ফীত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনের ভাড়ার, বইছে পাঠকের আগ্রহের জোয়ার। অন্যরা পিছিয়ে পড়ছেন, হারিয়ে যাচ্ছেন। ফলস্বরূপ বাড়ছে গোষ্ঠীর কদর ও নিয়ন্ত্রণ। সঙ্কুচিত হচ্ছে সাধনার নির্জনতা, প্রেরণার তাড়না ও ইতিবাচক দায়বোধ। এর পরিষ্কার প্রভাব পড়ছে কবিতায়। দিঘি থেকে বেরিয়ে সবাই রাজত্ব করতে চাইছেন নিজস্ব কুয়োয়। ভাল কবিতা লেখার চেয়ে, বেশি কবিতা লেখা ও প্রচারের প্রবণতা বেড়েছে। কবিত্বের চেয়ে মার্কেটিং কৌশল ও ধূর্তামি রপ্ত করছেন নতুন কবিরা। উচ্ছিষ্টের প্রতি লোভাতুর এ কবিরা করুণ ও কাতর চিত্তে সুবিধার কানাগলি খুঁজতে দ্বিধা করছেন না। তবে করধ্বনি-কোলাহলের বাইরে, সুবিধার মৌচাক থেকে দূরে, নির্জন মনোপথে এখনও হাঁটছেন কেউ কেউ।
অসংলগ্নতার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে ক্লানত্ম হচ্ছেন না বর্তমানের কবিরা। তাঁরা বলছেন, যেভাবে মূল ভাবনা গোটা কবিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে সেভাবে শীর্ষ কোন যুক্তি জীবনকে নিয়ন্ত্রণে অক্ষম। কোনও সমস্যার এখন আর একরৈখিক সমাধান মিলছে না। প্রয়োজন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে যুক্তি ও যুক্তিহীনতার তীর্থ থেকে তীর্থে। কবিতাকে সামগ্রিকতা দিয়ে দেখার দিন ফুরিয়েছে, এখন বহুরৈখিকতার তুমুল মহামারির যুগ। সার্থক কবিতার জন্য সঙ্গতিপূর্ণ পঙ্ক্তি রচনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তেমন অসঙ্গতিপূর্ণ পঙ্ক্তি রচনাও অর্থহীন নয়। একটি কবিতা একরৈখিকভাবে পূর্ণতা পেলো কিনা তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বহুরৈখিক কবিতায় পঙ্ক্তি বিশেষ কতটুকু কবিতা হয়ে উঠলো। পারিপার্শ্বিকতাকে কবিতাকে আক্রানত্ম করছে। বর্তমানের কবিতা ব্যক্তির যাপনশৈলী, দার্শনিকবোধ, স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাসার বিলাচ্ছে। প্রতীকায়ন ঘটাচ্ছে, সীমানাপ্রাচীর ভাঙছে। কবিতায় বাসা বাঁধছে আরোপিত আবেগ, স্বতঃস্ফূর্ততাহীন নির্মাণ, নিরীক্ষাবিমুখকতা, অপ্রাসঙ্গিক জটিলতা ও নন্দনসৌন্দর্যহীনতা। নতুন কবিরা এ অসঙ্গতিকে বহুরৈখিকতা হিসেবে আখ্যায়িত করলেও কবি সাযযাদ কাদির একে ‘চিনত্মার স্বচ্ছতার অভাব’ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চান। প্রবীণের অভিযোগ যুক্তির শেকলছেড়া ও বহুরৈখিকতার নামে কবিরা অসংলগ্নতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এতে তৈরি হচ্ছে বিভ্রম। বহুরৈখিকতার দোহাই দিয়ে ঢাকা হচ্ছে দুর্বলতা। কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ পুরনো। বর্তমানের কবিরা পাঠকের রুচিকে পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছেন না। এক্ষেত্রে কবি পাবলো নেরুদা’র মুখে ঝাল খেয়ে তাঁরা বলছেন, ‘কবিতা কোনও সময়ই স্থিতিশীল নয়, কবিতা জলস্রোতের মতো, মাঝে-মাঝে সৃষ্টিকর্তার হাতের নাগাল থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যায়।’ কিন্তু নতুন কবিদের কাব্যদর্শন অবোধ্য। অগোছালো, অসম্পূর্ণ, অর্থহীন, অবোধ্য বক্তব্য ও অন্যের কাছে মূল্যহীন ব্যক্তিগত আবেগকে অমূল্য ভাবছেন অনেকেই। গদ্য কবিতার অজুহাতে নিছক গদ্যকেই কবিতা বলে চালিয়ে দিতে চান কেউ-কেউ। নতুন কবিরা বলছেন, কবিতা হবে কেন্দ্রহীন, পরম্পরাহীন; অস্পষ্টতার ধূম্রজালে বাঁধা; এক শব্দের সঙ্গে অন্য শব্দের সম্পর্ক হবে না, এক পংক্তির সঙ্গে অন্য পংক্তি ভুগবে ক্রমাগত দাম্পত্য বিরহে। বিপরীতে প্রবীণ পাঠকরা বলছেন, এমন প্রবণতা এক শাব্দিক নৈরাজ্যের জন্ম দেবে। এর ভেতর থেকে কিছু শব্দ ও পংক্তি ঝলক দিলেও সার্বিকভাবে তেমন কিছু দাঁড়াবে না। দুর্বোধ্যতার দায়ে যখন কমছে কবিতার পাঠকসংখ্যা। তখন উল্টো প্রশ্ন উঠছে, কবিতা কি আদৌ কোনকালে বহুলপঠিত ছিল? এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, বর্তমানে কবিতার প্রতি মানুষের আগ্রহ রীতিমতো তলানিতে। কোনও-কোনও প্রবীণ পাঠক বলছেন, কবিতাকে ফের পাঠকের কাছে ফেরাতে প্রয়োজন এক নতুন জগৎ নির্মাণের। কিন্তু সে জগৎ কেমন হবে তা আবিষ্কারই হবে প্রধান চ্যালেঞ্জ। একদা প্রতিষ্ঠিত ধারণা ছিল, কবিদের কবি হতে হলে জানতে হবে সুর-ছন্দ-মাত্রা। রপ্ত করতে হবে অলঙ্কার শাস্ত্র। নিজস্বতা থাকতে হবে ভাষা, শব্দচয়ন ও প্রয়োগে। শব্দালঙ্কারের ভাণ্ডার আয়ত্ত থাকার পাশাপাশি থাকতে হবে শব্দালঙ্কারের সুনিপুণ ব্যবহার করবার দক্ষতা। ‘প্রকাশই কবিত্ব নয়’ প্রকাশের সঙ্গে থাকতে হবে সংগতিপূর্ণ ভাষা ও তার প্রয়োগ। মহাকবি কায়কোবাদ এ নিয়ে বলেছেন, ‘কবি হওয়ার ক্ষমতা মানবের নহে, উহা ঈশ্বর প্রদত্ত। ঈশ্বর যাহার কণ্ঠে মধুরতা দেন নাই, সে কেমন করিয়া সংগীত গাইয়া পরকে ভুলাইবে? কবি যে সাহিত্য-কুঞ্জ কাননের গায়ক।’ কবি আল মাহমুদ বলেন, কবির একটা স্থায়ী চেহারা হলো ছন্দ। কবি বলতেই আমাদের বুঝতে হবে যে, তিনি সমিল বাক্যে কথা বলেন। এটাই মানুষ ধরে নেয়। আটপৌরে গদ্যের বাইরে একটা ভাষা আছে তার। সেই ভাষা ছন্দোবদ্ধ। কবিকে ছন্দ জানতেই হবে।’ তরুণ কবিদের নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ নতুন কবিদের ছন্দে লিখতে রীতিমতো অনুরোধ করেছেন। তাঁর মতে, ‘সবাইকে একটা কথা অত্যনত্ম স্পষ্টভাবে মনে রাখা দরকার, যারা ছন্দ জানে না, তারা কবি নয়।’ কিন্তু বর্তমান কবিতার ঝোঁক হচ্ছে ছন্দহীনতার প্রতি। অনেক কবি প্রকাশ্যে গর্বের সঙ্গে বলছেন তিনি ছন্দ জানেন না কিন্তু কবিতা জানেন। এ ঝোঁকের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ-কেউ বলছেন, প্রচলিত সকল ছন্দই সাধুভাষার। কবিতায় কথ্যভাষার সে প্রতিষ্ঠা ঘটেছে তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারে নি ছন্দ। কিন্তু বাংলা কবিতা এখন অগ্রসরমান ও বিশ্বকবিতায় বহমান অপরাপর স্রোতের সঙ্গে লীন হতে আগ্রহী। তাই ছন্দের মতো বিষয়কে ঝেড়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর। নতুন কবিরা কবিতা ছন্দোবদ্ধ না গদ্য কাঠামোর, তার চেয়ে মানকে গুরুত্ব দিতে চান। এক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে আসছে শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি। ফলে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ছন্দোবদ্ধ কবিতার চেয়ে অনেক বেশি রচিত হচ্ছে গদ্যছন্দের কবিতা। যার স্বাদকে কবি আল মাহমুদ ‘লবণ ছাড়া ডিম খাওয়া’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। অবশ্য ছন্দবাদীরা এখনও গোঁ ধরে বলছেন, কবিতাকে স্মরণীয় করতে ছন্দের গুরুত্ব অপরিসীম। ছন্দ, অনুপ্রাস প্রভৃতি অলঙ্কার কবিতায় মুগ্ধতা তৈরি, পাঠককে অনুপ্রাণিত ও কবিতার প্রতি প্রেমাসক্ত করে তোলে। একথা বাসত্মবিক যে, কবিতা নিরাভরণা নয়, নারী যেমন আকার-ইঙ্গিতে, সাজসজ্জায়, বিলাসে-প্রসাধনে আপনাকে মনোরমা করে তোলেন, কবিতাও তেমনি শব্দে, সংগীতে, উপমায়, চিত্রে ও অনুভূতির নিবিড়তায় নিজেকে প্রকাশিত করে। তথাপি শেষ পর্যনত্ম কবিতা একটি মনোজাগতিক বিষয়। প্রথমত ভাবনা ও অনুভূতির অনুবাদ এবং দ্বিতীয় নির্মাণের বিষয়। বর্তমান কবিতার আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বাতন্ত্রহীনতা বা স্বতন্ত্র কাব্যভাষা সৃষ্টির ব্যর্থতা। জীবনানন্দ অনুভূতির ভাষা, জসীম উদ্দীন লোকজ ভাষা, শামসুর রাহমান নাগরিক ভাষা, আল মাহমুদ ধ্রুপদী ভাষায় লোকজ অনুষঙ্গ তুলে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজস্ব কাব্যভাষা। এমন স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন আরও অনেকেই। কিন্তু এখন কবির নাম কেটে দেয়া হলে কোনটি কার কবিতা তা নির্ধারণ করা রীতিমতো দুঃসাধ্য। সার্বিক বিবেচনায় ব্যক্তি নয় বাজছে সমষ্টির স্বর, একীভূত সমষ্টির ভাষা। তবুও অনেকের কবিতায় উঠে আসছে তীব্র জীবনবোধ। কিছু কবিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বহুসত্মর ও বহুরৈখিকতায় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ঘোরলাগা বিস্ময়ের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এতসব নৈরাজ্য-নৈরাশ্যের মধ্যেও আলোর ফুলকি দেখতে পাচ্ছেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। বর্তমান কবিতার প্রবণতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘লিরিকের তাৎপর্যপূর্ণ নবনিরীক্ষার পাশাপাশি গদ্যবয়ান, প্রতীকময়তা, কোলাজ, অনত্মর্গামিতা ও বক্রস্বরপ্রবণতা নব্বইয়ের পর শূন্য দশকের কবিতায় তাৎপর্যপূর্ণ বাঁকবদলের সূচনা করছে।’ সাম্প্রতিককালে ব্লগের কারণে কবিতাকে আটকাতে রাখতে পারছে না ভৌগোলিক সীমারেখা। মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে যাচ্ছে অনত্মর্জাল বিশ্বে। বাংলা কবিতার প্রতি মুহূর্তের উচ্ছ্বাসের ঢেউ ভাঙছে বাংলাভাষী পৃথিবীর প্রতিটি কূলে। ব্লগে দশকের রাজনীতি নেই, গোষ্ঠীর কানাগলি নেই, প্রতিষ্ঠানের ব্রাহ্মণ্য, দৈনিক ও লিটলম্যাগ সম্পাদকদের প্রভাব খাটে না, ফাঁকা বেলুন প্রকাশ্যে ফুটো হয়। তবে প্রযুক্তির এ সহজলভ্যতা পরোক্ষভাবে ক্ষতির কারণ হচ্ছে প্রকৃত কবিতার। দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছে কবিতা-অকবিতার। সর্বোপরি, প্রযুক্তি নির্ভর গতিময় জীবন, চাহিদার সম্প্রসারণ, মূল্যবোধের সঙ্কট ও পাঠক বিমুখতার ভেতরও কবিতার প্রতি নতুন কবিদের দুর্মর আগ্রহ সত্যিই আশাব্যঞ্জক। জীবনের অন্যান্য পরিচর্যার মতো কবিতায়ও অবশ্যই পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে বিসত্মৃততর হবে, আরো অনুপূঙ্খ হবে জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে কবির মনোযোগ। কিন্তু কবির সেই অর্জিত জ্ঞান সেই নিরীক্ষার নির্যাস কবিতাতেই প্রকাশিত হবে অনিবার্যভাবে অন্য কোনো শিল্প মাধ্যমে নয়। তবে ভবিষ্যতের কবিতা যে রূপই পরিগ্রহ করুক না কেন তা যদি বিশুদ্ধ কবিতার প্রজ্জ্বলনে ঝলসে না ওঠে তাহলে স্বভাবতই কাল তার বাঁধ সাধবেই। আর বিশ্ব সভ্যতা যদি ধ্বংসের দিকে না গিয়ে মঙ্গলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতের সেই সমাজে কবিতার মাত্রা অবশ্যই বেড়ে যাবে এবং কেবলমাত্র ব্যক্তির জন্যই নয় সমাজের জন্যও তা হবে প্রয়োজনীয়, অর্থবহ ও তাৎপর্যময়।
সেই তিরিশ ও চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যনত্ম বাংলা কবিতার গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বসাহিত্যের জটিল প্রেক্ষাপটে বাংলা কবিতা নিজেকে স্থাপন করতে গিয়ে যেমন একদিকে একটি বিশুদ্ধ পরিমার্জিত কাব্যবোধের জন্ম দিয়েছে আধুনিককালের বিশ্বসমাজের ধ্যানধারণার অনুবর্তনে, আবার তেমনি অপরদিকে আধুনিককালের বস্তু সমর্পিত, সাফল্য কবলিত, জীবন চেতনার পরিক্রমণে ‘অর্থ, কীর্তি বা সচ্ছলতা’ নয়, বরং তার অনত্মর্গত প্রবাহমান রক্তের ভিতরে অনুভব করেছে ‘ কোন এক বিপন্ন বিস্ময়’, যে বিস্ময় কখনই ধুনক জীবন বীর প্রায়োগিক প্রবণতার দ্বারা চিহ্নিত নয়। আধুনিক মনন তার পরিপার্শ্বকে অর্থাৎ যে বস্তু বিশ্বে তার অসিত্মত্ব তাকে বিশ্লেষণ করে, জীবন ও জগতের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে নিজেকে নিয়োজিত করে, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তার অসিত্মত্বের নতুন দিগনত্ম উন্মোচিত করতে চায়, কিন্তু কখনই সজ্ঞা প্রভাবিত রহস্যের ঊর্ণাজালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেনা। বিশুদ্ধ অবিমিশ্র আধুনিকতা তাই এক অর্থে কবিতার ও শিল্পের পরিপন্থী। আধুনিক মানুষ ‘বিপুলাপৃত্থী ও নিরবধি কাল’ কে অণুবীক্ষণে বিশ্লেষিত করতে আগ্রহী, যে আগ্রহের লক্ষ্য হলো মহাকালের অর্থ উন্মোচন এবং সম্ভব হলে তার অসিত্মত্বের অনুপূঙ্খ ব্যবচ্ছেদ। সম্ভবত অক্টাভিওপাজ আধুনিক মনন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এই কথাটি বোঝাতে চেয়েছেন“...
বাংলা কবিতার বয়স হাজার বছর। চর্যাপদ থেকে হাজার বছরের এ পথচলায় আশ্চর্যময় সব বাঁক নিয়েছে বাংলা কবিতা। কবির গভীরতম অনুভূতি, কবিতার গঠনশৈলী, ভাষার প্রবহমানতা, কবিতার উদ্দেশ্য, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিপার্শ্ব এবং প্রকাশ ভঙ্গির স্বাতন্ত্রসহ নানাবিধ কারণে মঙ্গল-কাব্য, পুঁথি-কাব্য, বৈষ্ণব পদাবলির মাধ্যমে পেয়েছে বহু বর্ণিল রূপ। ঊনিশ শতকের কবিরা বৃটিশ ঔপনিবেশিকতাকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন হাজার বছরের ঐতিহ্যকে। প্রত্ন-প্রবণতা ভেঙে মাইকেল মধুসূদন দত্তই প্রথম বাংলা কবিতাকে চারিয়ে দেন বিশ্বকবিতার কক্ষপথে। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মিলনসাধনে ব্যাপ্তি দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক বৈষম্যবিরোধী এক বিপ্লবী মেজাজ সঞ্চার করেন কাজী নজরুল ইসলাম। ত্রিশের দশকের কবিগোষ্ঠী বাসত্মবিক আধুনিকতার উন্মেষ ঘটালেও সে আধুনিকতা ছিল অনেকটাই শেকড়চ্যুত। বিংশ শতকের প্রথম তিন দশকে আলোকবিন্দু ফেলা হয়েছে ইংরেজি শিক্ষিত শেকড়চ্যুত আধুনিক কবিদের ওপর। সাতচল্লিশের দেশভাগ বাংলা কবিতাকে করেছে দ্বিচারী। চল্লিশের কবিরা মুখের ভাষা কবিতায় আনতে চেয়েছেন। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কবিদের হাতে পেয়েছে প্রানত্ম থেকে আনত্মর্জাতিকতার ব্যাপ্তি। বিগত পঞ্চাশ বছরের লালনে-সৃজনে বৈচিত্রতর হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতা। আধুনিক বাংলা কবিতা বিশ্বকবিতার ওপর কোন প্রভাব বিসত্মার করতে পেরেছে কিনা তা স্পষ্ট না হলেও ভাব, বিষয় এবং আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যে ঋদ্ধ করেছে সুনিশ্চিত। আধুনিকতার মূল নির্যাস হলো মহাকালের সমালোচনা, বর্তমান সময় গভীর তাৎপর্যময় সময় প্রকৌশল ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রা হয়তো মানুষকে নান্দনিক অর্থে এমন অনুর্বর ও নীরস দৃশ্যপটের দিকেই অমোঘভাবে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ শিল্পে সঙ্গীতে কবিতায় সৌন্দর্য সৃষ্টির যে কোনো প্রক্রিয়ায় মানুষের যুক্তি বুদ্ধিকে অতিক্রম করে তার বোধের ভেতরে থাকে আরেক চিরনত্মন, এক নির্মোহ সত্য সুন্দরের অভিমুখে অভিযাত্রা যার সজ্ঞা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে দুলিয়ে দেয় জীবনের সকল রহস্যের যবনিকা এবং হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে উন্মোচিত করে তোলে ‘বাতাসের ওপারে বাতাস’ ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ অর্থাৎ সুন্দরের শাশ্বত অথচ দুর্বিশ্লেষ্য জগৎ; আর এই জগৎটাই সকল সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের অনিত্মম অন্বিষ্ট। পরস্পর বিচ্ছিন্ন বস্তু নিচয়, বর্ণ আদল ও অবয়ব এবং ধ্বনি থেকে শিল্পী ও কবির মনে জন্ম নেয় এক বিশুদ্ধ সুন্দরের আবেগ যা অযোধ্যার চেয়েও সত্য হয়ে ওঠে অকস্মাৎ; হঠাৎ করে দেখা কোনো এক বিরল মুহূর্তে বাচন ও অনির্বচনীয়ের ভাষা ও কল্পচিত্রের সংযোগ রচিত হয়ে যায়, যেন এমন একটি সত্মরে শিল্পীর বোধ এসে ঠেকে যায় যার কোনো ব্যাকরণ নেই, বিশ্লেষণ নেই, অঙ্কশাস্ত্রের অযৌক্তিক বা ইরেশনাল সংখ্যার মতো। প্রকৃতপক্ষে সভ্যতা যতই অগ্রসর হচ্ছে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতিতে রীতিক রহস্যময়তা যতো স্বচ্ছ হয়ে উঠছে তার কাছে। ততই মানুষের কর্মে, তার শিল্পবোধে এবং সে জন্যেই তার শিল্প সৃষ্টিতে বিশুদ্ধতার পরিচর্যা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আধুনিককাল থেকে শুরু করে বর্তমান কালকে তথাকথিত উত্তরাধুনিককাল বলে ধরলেও এই চরম শুদ্ধতার পরিচর্যাই আপাততঃ জ্ঞানে বিজ্ঞানে ও শিল্পে আমাদের ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’। এই বিশুদ্ধতার পরিচর্যা যা প্রকৃতপক্ষে সত্যানুসন্ধান কবিকে, চিত্রশিল্পীকে, ভাস্করকে কখনও কখনও বিমূর্ততার দিকে প্রণোদিত করে। সমসত্ম দৃশ্যমান অবয়ব থেকে সেইসব অবয়বের মূল নির্যাস টেনে নিয়ে একটি বিশুদ্ধ অবয়ব সৃষ্টির আকাক্সায় সে উন্মোথিত হয়। এই উন্মোথিত হওয়া, এই উদগ্রীব অন্বেষণই শিল্পীর, কবির ও স্বপ্ন দ্রষ্টার অনন্য জাগরণ এবং সে জাগরণ সমসত্মকালকে অতিক্রম করে যায়। শিল্পী ও বোদ্ধার এই জাগরণ দুর্ভাগ্যবশতঃ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি একই দেশের বিভিন্ন সামাজিক সত্মরে বিভিন্ন জণগোষ্ঠীর মধ্যে একভাবে সঞ্চারিত হয় না, তার কারণ দেশে দেশে এমনকি একই দেশের বিভিন্ন সামাজিক অর্থনৈতিক সত্মর বিন্যাসে একটি সমাজের বিপুল জনগোষ্ঠীতে বাসত্মব ও বৌদ্ধিক অগ্রযাত্রার সমার্থক নয়, ফলে শিল্পীর নতুন উপলব্ধির ধারণা সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে না সর্বত্র। এবং সেজন্যে দেখা যায় শ্রেষ্ঠ কবি বা শ্রেষ্ঠ শিল্পী সবসময় তার সময় থেকে এগিয়ে থাকেন আর সে জন্যই যখন তিনি দ্রষ্টার ভূমিকায়- তখন সমাজের সঙ্গে তার সংঘর্ষ। ইয়েটস যখন ‘কেন্দ্রের টান আর থাকছেনা এবং কেন্দ্রাতীগ শক্তিতে বস্তু নিচয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে’ সভ্যতার এমন অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন তখন প্রকৃতপক্ষে তিনি এই পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতের ধারণাটিকে স্পষ্ট করবার চেষ্টা করছেন, অভূতপূর্ব সঞ্চরমান চিত্রকল্পে, বলাবাহুল্য বিমূর্ত চিত্রকল্পে। কেমন তবে বাংলা কবিতা? প্রশ্নের উত্তরে কবি সাযযাদ কাদিরের ‘বাংলা কবিতা’টির ছয়টি পংক্তি দু’ভাগে উল্লেখ করা যায়।
‘বাংলা কবিতা আমাদের এই বাংলার মতোই।
এর চরণে-চরণে বাজে বৃষ্টির নূপুর
ছন্দে-ছন্দে মেতে ওঠে এলোমেলো হাওয়ার আনন্দ।’
এ তিন পংক্তির মধ্য দিয়ে চর্যাপদ থেকে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলা কবিতার স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতাকে বোঝার জন্য একই কবিতার আর তিনটি পংক্তির শরণাপন্ন হতে হয়।
‘বাংলা কবিতা এ বাংলার মতোই।
ঘুরে-ঘুরে চলে মেঠো এবড়োথেবড়ো পথে
মাত্রার হিসাব, মাপজোখ করে না অত।
তাহলে আসলে যা ঘটছে সময়ের বিবর্তনে ইতিহাসের অমোঘ যাত্রায় সমসত্ম বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বস্তু নিশ্চয় মানব সম্পর্কের পরিবর্তন। তাই এই জীবন ও জগৎকে কবি সেই পরিবর্তিত প্রেক্ষিত প্রত্যক্ষ করছেন; আর সেই জন্যই বদলে যাচ্ছে তার উপমা-রূপক-উৎপ্রোর চেহারা। তার বাচনের প্রস্বর, তার জ্যোতির পারম্পর্য, তার শব্দের চিত্রকল্পের ব্যঞ্জনা ও গূঢ়ার্থ।’ কাজেই কবিতা বিষয়ে ‘আধুনিকতা’র প্রসঙ্গটাই আর অর্থবহ থাকে না। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বা এমনকি পঞ্চাশের দশকেও আমাদের কবিতা সম্পর্কে আধুনিকতার প্রসঙ্গটি হয়তো কিছুটা প্রাসঙ্গিক ছিল। কারণ তৎপূর্ববর্তী কাব্যভাষার সঙ্গে তৎকালের কাব্যভাষার ব্যবধান হয়ে যায় বিসত্মর। এখন এই প্রসঙ্গটিই প্রকৃতপক্ষে অবানত্মর। আরো স্পষ্ট করে বললে তখন বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা ছিল এই অর্থে যে, একটি বিশেষ সময়ের পরিসরে ধরা যাক প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ও তার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে। ‘ধরা যাক যে তা মহাশূন্যে অভিযাত্রার কাল’ পর্যনত্ম প্রসারিত, সমগ্র বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পট পরিবর্তনের সমানত্মরালে কবিতার তথা নমনীয় শিল্পের আঙ্গিকে একটি অতি স্পষ্ট ও লক্ষ্যযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছিল। কিন্তু আজকে একবিংশ শতকের ঊষালগ্নে দাঁড়িয়ে আমরা সেই পরিবর্তনের একটি পরিণত রূপ প্রত্যক্ষ করি। তখন প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলতে পারি যে, সেই পরিবর্তনের কারণে শিল্পের মৌলিক চরিত্রে কোনো গুণগত পরিবর্তন আরোপিত হয়নি। - কবিতা এখনও কবিতাই রয়ে গেছে, চিত্রকলা চিত্রকলাই। তবে টেড হিউজ বা টমাস হিনি আলেকজান্ডার পোপের মতো কবিতা রচনা করেন না, শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদ লেখেন না বিহারীলালের মতো, জয়নুল আবেদীন, সুলতান বা কিবরিয়া আঁকেন না রুবেনস এর মতো, অর্থাৎ শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। তার পরিপ্রেক্ষিত হয়তো গেছে বদলে এবং নতুন কিছু যুক্ত হয়েছে তার কৌশলে। ঠিক তেমনিভাবেই কবির কাব্য ভাষায়ও হয়তো যুক্ত হয়েছে কিছু অভিনব বৈশিষ্ট। কিন্তু কবিতার বহিরঙ্গ বা অনত্মরঙ্গ আয়তনে যে ভাষার বঞ্জনায় কেঁপে ওঠা, প্রচলিত অর্থের সীমা অতিক্রম করে শব্দের নতুন অর্থের যে উদ্ভাবক, শব্দের ধ্বনি ও সঙ্গীতে আনন্দের যে অনাবিল নির্ঝর তা কিন্তু বদলায়নি একটুও। হয়তো আগের তুলনায় বর্তমানের কবি আরো নির্মোহ হয়ে খুঁজছেন তার বিশুদ্ধতার অনন্য অবয়ব। সাতচল্লিশের দেশভাগ বাংলা কবিতায় একটি বিশাল প্রভাবসৃষ্টিকারী ঘটনা। সাতচল্লিশ-উত্তর কালে বাংলা কবিতা বিকশিত হয়েছে দুই বিপ্রতীপ স্রোতে। এখান থেকেই বাংলাদেশের কবিতার আলোচনা জুড়তে চাই। চল্লিশের দশকে বাংলা কবিতাতে সমাজতন্ত্র ও নতুন রাষ্ট্রের স্বাপ্নিক ইসলাম সমানভাবে আচ্ছন্ন করে। কিন্তু দ্রুততম সময়ে উল্কার মতো দু’টিরই পতন ঘটে। পঞ্চাশের দশকে এ দু’টি বিষয় আসে নাগরিকতা ও লোকজ চেতনার নতুন মোড়কে। তথাপি পঞ্চাশ দশক থেকেই বাঙালি চেতনার সক্রিয় ও সার্থক উন্মেষ ঘটে। অস্থিরতা ও নৈরাশ্যের অবক্ষয়ের ভেতরেও নিরনত্মর পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও ব্যাপৃত হন ষাটের কবিরা। প্রথাসিদ্ধ পথের বাইরে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প ও শব্দচয়নে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যযুক্ত হয়েছে এ সময়। ষাট দশকে মূল্যবোধের ভাঙচুর ও নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কবিতা পেয়েছে গাম্বির্যতা। সত্তরের দশকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় ছিল চূড়ানত্মভাবে অরাজকতাপূর্ণ। স্বাধীনতার উজ্জ্বল আভার বিপরীতে প্রকাশ পাচ্ছিল বিপন্ন বিস্ময়। স্বাধীনতার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় এ সময় স্লোগানধর্মিতার প্রভাব বিসত্মার করে বাংলা কবিতায়। ত্রিশের দশকে আনত্মর্জাতিকতার বাসত্মবিক উন্মেষ হলেও তার বিসত্মার লাভ করেছে ষাট-সত্তরে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের সঙ্কট ও সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হয়েছেন সত্তর ও আশির কবিরা। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুবাদে নব্বইয়ের দশকের কবিরা নতুন করে প্রাণসঞ্চার করেছেন বাংলাদেশের কবিতায়। লাতিন ও আফ্রিকান মুক্তিকামী মানুষ ও প্রানিত্মক-নিম্নবর্গের মানুষের ঔপনিবেশিকতা বিরোধী কাব্যস্বর প্রভাবিত করেছে আশি-নব্বইয়ের কবিতাকে। বাংলাদেশের কবিতার পরতে-পরতে জড়িয়ে আছে ভাষাআন্দোলন, স্বাধিকার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা-উত্তরকালে গণমানুষের স্বপ্নভঙ্গ, প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব, স্বৈরাচারের উত্থান ও গণতন্ত্রের বিপর্যসত্ম যাত্রা। এমন ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের মুখোমুখি হয় নি ভারতীয় বঙ্গের কবিতা। বাংলাদেশের কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের জীবনসংগ্রাম, ভারতীয় বঙ্গের কবিতায় প্রাধান্য জুড়েছে অসঙ্গতি। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা দুই দেশের বাংলা কবিতার বৈশিষ্ট্য বিচার করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আসলে বাংলাদেশের কবিতা মানেই এই সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্রসংবলিত এক উন্মাতাল বাণীভুবন। পশ্চিম বঙ্গীয় বাংলা কবিতার সঙ্গে বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার মৌলিক পার্থক্য এখানেই।’ বাংলা কবিতায় রোমান্টিসিজম ও রিয়েলিজমের দ্বন্দ্বকে নতুন করে আবিষ্কার করছেন কেউ- কেউ। এ দুইয়ের সম্পর্কে বলছেন, আপাত বিরোধমুখর কিন্তু আখেরে সমানত্মরাল। পাশাপাশি চলে, চলছে এবং সম্ভবত চলবে। বর্তমানের কবিতায় ধর্ম, মিথ, প্রকৃতি ও ইন্দ্রিয়সহযোগে আবহমান বাংলার লোকজ ও ধ্রুপদ রোমান্টিজম জেঁকে বসেছে। পাশাপাশি স্বগতোক্তি, বিবৃতি, প্রাত্যহিক ধারাবর্ণনা ইত্যাদি ফর্মে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে রিয়েলিজম। বলা হচ্ছে, রোমান্টিকতা কৃত্রিমতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে, রিয়েলিটি পরছে মুখোশ। রোমান্টিসিজমে ভারতীয় বঙ্গ ও রিয়ালিজমে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের কবিতা। আসলে দুই দেশের কবিতায় পার্থক্য তৈরি করেছে জীবনবাসত্মবতা, উপলব্ধি, উপস্থাপন ভঙ্গি ও কাব্যভাষা। বাংলাদেশের কবিতা অবিকশিত নগরযন্ত্রণা, জীবনযাতনা, সরব দেশকালের উপস্থিতি, প্রকৃতিবর্ণনা, শেকড়কেন্দ্রিকতার মিশেলে স্বকীয়। ভারতীয় বঙ্গের কবিতায় বিনির্মাণ, রহস্য, অনুভূতি ও নিরীক্ষার জটিল মনসত্মত্ত্ব নির্ভর বিষয়কেন্দ্রিক। বাংলাদেশের কবিতা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, দ্বন্দ্ব-সঙ্কটে টলটলায়মান, হৃদয়াবেগে ফেনা তোলা, অফুরনত্ম-সম্ভাবনায় সামনের দিকে ধাবমান। বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গের কবিতা নিরাবেগ, অবসাদে মনমরা, স্বপ্ন ও প্রাণ-প্রাচুর্যহীন, মেধার বিচ্ছুরণ। ভারতীয় বঙ্গের কবিতায় যেখানে শব্দ বুননের কৌশল পরিণত, জীবনঘনিষ্ঠ ও দ্বিধাহীন সেখানে বাংলাদেশের কবিতায় শব্দপ্রয়োগ, রূপকল্প, উপমা, প্রকাশের ভঙ্গিমায় উচ্ছ্বসিত, চটুলতাপূর্ণ, অপরিণত, জটিল, অনুকরণপ্রিয়তায় দ্বিধাগ্রসত্ম। এপারের কবিতা ছন্দ থেকে বেরিয়ে আসছে, কিন্তু ওপারের কবিতা এখনও দারুণ ছন্দপ্রিয়। তথাপি পাঠকের অভিমত, বিষয়াবলী, ভাষাগত নিরীক্ষা, বিশেষ করে আঞ্চলিক ভাষা ও বাকভঙ্গির ব্যবহারে বাংলাদেশের কবিরা এগিয়ে থাকলেও প্রকরণগত নিরীক্ষায় সমরূপীয় এবং আনত্মর্জাতিক প্রবণতায় দুই দেশের বাংলা কবিতা সমগোত্রীয়। ভারতীয় বঙ্গের নবীনদের পড়ে প্রবীণরা গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি প্রেরণা দেন। বাংলাদেশে যে রীতি গড়ে ওঠে নি এখনও। আমার ধারণা ‘আধুনিকতা’র প্রসঙ্গটি মূলত কোন সময়ের জনগোষ্ঠীর এবং আরো বিশ্লেষিত করে বললে কোন পাঠক গোষ্ঠীর সাধারণ রুচি ও শিক্ষার মান ও প্রকৃতির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। আধুনিকতা সর্বকালেই একটি আপেক্ষিক ধারণা। জন ডান যখন লিখতেন তখন অবশ্যই তিনি অত্যনত্ম আধুনিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার সময়ে অনাধুনিক ছিলেন না। এমনকি বিহারীলালও না। অনগ্রসর এবং সাধারণভাবে প্রতিক্রিয়াশীল রক্ষণবাদের কাছে সমর্পিত সময় থেকে অনেক অগ্রসর শিল্পকর্মকে সমসত্ম যুগেই অভূতপূর্ব ও সেকারণেই দুর্বোধ্য এবং এমনকি উদ্ভট বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তার অনত্মর্নিহিত শক্তিকে অস্বীকার করা বড়ো কঠিন; এবং সেজন্যে তাকে বহুবার কাঠগড়াতেও উঠতে হয়েছে। কেবলমাত্র শিল্পেই নয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে এই সেদিন পর্যনত্ম। ডারউইন সম্পর্কিত ঘটনা তো অল্পকাল আগে।
এসব কিছুর কারণ কিন্তু একটাই প্রচলিত রুচির বাইরে সর্বসাধারণ মানুষ বা একটি সমাজের বিপুল সংখ্যক সদস্য সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। নিউটনের সূত্রের অনুসরণে বস্তুর মতো রুচিতেও পরিবর্তন আনতে হলে কিছু শক্তির প্রয়োজন হয়; এবং সেই শক্তি সরবরাহ করেন পিকাসো বা জয়নুলের মতো শিল্পী, বোদলেয়ার বা জীবনানন্দের মতো কবি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ও প্রসার ও তার সমানত্মরালে রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের আধুনিকতর পরিপ্রেক্ষিত নীরবে বদলে যায়। রবীন্দ্রনাথের গানের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা ও জনপ্রিয়তার প্রসার ঘটেছে অত্যনত্ম স্বল্প সময়ের পরিসরে। এর কারণ যতোটা রাজনৈতিক তার চাইতে অনেক বেশি শিক্ষাগত ও নান্দনিক। কিন্তু তবু কি তার গান সর্বসাধারণের মধ্যে সম্পৃক্ত হতে পেরেছে এতোদিন পরেও? দেশের সর্বত্র কি সমানভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা হচ্ছে বা লোকে শুনছে? কিন্তু তবুও যুক্তিগ্রাহ্যভাবে বলা যেতে পারে যে মূলধারার শিক্ষার ক্রমাগত চিনত্মার এবং সংস্কৃতির ব্যাপকতর চর্চায় মানুষের রুচি পরিবর্তনের ফলে একদিন এমন পরিস্থিতি উদ্ভব অসম্ভব নয় যে রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সাধারণ লোকায়ত ঐতিহ্যের মধ্যে মিশে যাবে। কবিতার ক্ষেত্রেও যে ঐ একই সূত্র কাজ করে তা বলা হয়তো অসঙ্গত হবে না। মানব সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, জীবন জগৎ ও আমাদের পরিপার্শ্ব সম্পর্কে অধিকতর তথ্য ও সংবাদ আহরণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের উপলব্ধির দিগনত্ম ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হয়ে যায়। আর তারই প্রোপটে কোনো মানব গোষ্ঠীর সমকালীন কবিতাসহ সকল শিল্পসৃষ্টি তার নির্দিষ্ট অবয়ব খুঁজে নেয় তার নিজের আর্থ সামাজিক ও মনসত্মাত্ত্বিক বাসত্মবতার নিরিখে। আমাদের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। কেবল কবিতা কেন শিল্পের যে কোন ক্ষেত্রে সম্পর্কে কথাটি প্রযোজ্য- চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নাট্যকলা, সঙ্গীত, স্থাপত্য। এই সমসত্ম ক্ষেত্রেই আধুনিকতা বলতে আপাতত আমরা সাধারণ অর্থে যা বুঝি তা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে জারিত হয়ে আসা কেবল পাশ্চাত্য সমাজে সংঘটিত কিছু পরিবর্তনের চিহ্ন, কিন্তু প্রথমত ও বিশেষতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে কেবল পাশ্চাত্য সমাজই নয় প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ মানব সমাজই একটি নতুন সময়ের মধ্যে জেগে উঠেছিল। পরবর্তীতে বিগত শতাব্দীর মধ্য বিন্দু থেকে আজকের দিন পর্যনত্ম বিশ্ব অর্থনীতিতে যে বৈষম্যমূলক ঊর্ধ্বতন এবং এশীয় উন্নয়নের প্রারম্ভ সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্বের যে বিভ্রানত্ম বাসত্মবতা ‘এইসব রং রক্ত বিভীষিকা’, এবং ‘এইসব ভয়াবহ আরতির ভিতর দিয়ে’ মানব সমাজ হয়তো আরো সংশয়ী হয়েছে। সতর্ক হয়েছে সন্ত্রসত্ম হরিণের মতো। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় সে নিশ্চলতা হারিয়েছে, স্বসিত্ম হারিয়েছে, সচকিত হয়েছে সন্ত্রাসে যখন সে জেনেছে নিজের সম্পর্কে ভীতিপ্রদ হনত্মারক সত্য, পশুশক্তির এখনও জয়জয়কার এবং তার আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা যা শেষ, আপাতদৃষ্টিতে শেষ হবার নয়। কেননা সে এখনও পর্যনত্ম পর্যুদসত্ম হচ্ছে এক নায়কত্বে, স্বৈরাচারে, রাজনৈতিক শঠতার আক্রমণে, আনুপূর্ব মিথ্যাভাষণে, মানুষের বর্তমান ভাষা ও বাসত্মবতার দ্বৈরথে। তার নিজের সমস্যা সম্পর্কে এই ঋণাত্বক জ্ঞানের ভার অনেকক্ষেত্রে দুর্বিষহ হয়ে উঠে তার জন্য। সন্ত্রাস তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে কখনও কখনও। এই উত্তরাধিকারকে সে অস্বীকার করতে পারবে আজ? আমরা কি আর নিরঙ্কুশ আনন্দ আর্জন করতে পারবো সরল একমাত্রিক এলিজি থেকে? কবিতায় কি আমরা আবার ফিরে যাবো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ? হয়তো যাবো, হয়তো যাবো না। হয়তো পরীক্ষা নিরীক্ষা করবো। কিন্তু সেই পর্যায় আর কোনোদিনই ভারত চন্দ্রের পর্যায় হবে না, এমনকি জসীম উদ্দীনেরও নয়। কাজেই আধুনিকতাপূর্ব, আধুনিক ও আধুনিতা উত্তর কবিতা বলে সত্যিকার অর্থে কোন কাব্যিক আঙ্গিকের অসিত্মত্ব আছে বলে ধারণা করা কষ্টকর। কারণ কবিতার ধারাক্রম চিরনত্মন এবং তার মর্মেও রয়েছে মানুষের চিরনত্মন পুরুষার্থ ও তার শাশ্বত নান্দনিক চৈতন্যের প্রবহমানতা, এই চলমানতার মধ্যেই পরবর্তী যুগের কবিতা, ভবিষ্যতের কবিতা নিজের বিশিষ্টরূপটি পরিগ্রহ করে নেবে। কিছু পরিগ্রহণ করবে, কিছু বর্জন হয়তো করবে, কিন্তু তার অনত্মরতম চরিত্রে নির্যাসে এবং অবয়বে থাকবে মানুষেরই চিরনত্মন উপলব্ধি সমূহ- প্রেম-অপ্রেম, রিরংসা, ঈর্ষা, আনন্দবেদনা, সুদূরের পিপাসা সৌন্দর্যের উৎকর্ষে নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার উদগ্র অভীঞ্ঝা। কী রূপে সে প্রতিভাত হবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা নির্ভর করবে ভবিষ্যতের সেই বিশেষ সমাজ বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং তার অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভৌগোলিক, দার্শনিক ও মনসত্মাত্ত্বিক বাসত্মবতার বৈশিষ্ট্যের ওপরে। কেবলমাত্র এইটুকুই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তা মৌলিকভাবে কবিতাই থাকবে অন্য কোনো শিল্প হবে না। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রসঙ্গে আবার স্বাভাবিকভাবেই কিছু কঠিন বাসত্মবতার অনুপ্রবেশ ঘটে যার একটি হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের সমাজ মানসের প্রেক্ষাপট। অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর তৃতীয় বিশ্বে সাধারণভাবে যা ঘটে তা হচ্ছে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার ব্যবহারের মধ্যে সময়ের তফাৎ এবং অনগ্রসর সমাজে জীবনযাত্রার মাঝে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা। অগ্রসর বিশ্বে যখন স্বয়ম্বু প্রযুক্তির ঊর্ধ্বতনের ভেতর দিয়ে অলক্ষ্যে সমাজ মানুষেও বিবর্তন আসতে থাকে আমাদের ক্ষেত্রে তখন উন্নত প্রযুক্তি নিজের ভেতর দিয়ে উদ্ভূত না হয়ে বাইরে থেকে আমাদের ওপর অনেক সময় আরোপিত হয়। অতএব নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব ও বিকাশে যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি অন্যত্র সাধিত হয়েছে তার প্রেক্ষাপট এবং তাকে অন্য আরেকটি একেবারে ভিন্ন পরিস্থিতিতে ধারণ করবার ক্ষমতা- এ দুয়ের মধ্যে বিরাট ব্যবধান থেকে যায়। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ, এমনকি সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির এক বিরাট অংশ এই ব্যবধানজনিত পশ্চাদপদতার শিকার। অতএব তাদের মানসিক বিবর্তন অপেক্ষাকৃত শ্লথগতি হওয়াই স্বাভাবিক। উপরন্তু সকল সমাজে সর্বকালেই সাংস্কৃতিক দিক থেকে বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা সাধারণত নগণ্য হয়ে থাকে। আমাদের দেশে শিল্প সাহিত্যে বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে নতুন করে আধুনিকতা ও তজ্জনিত দুর্বোধ্যতার প্রসঙ্গ এই বাসত্মবতার সঙ্গে সম্পর্কিত। কেননা কবি, চিনত্মাবিদ, দার্শনিক, শিল্পী এরা সাধারণত স্বকীয় সমাজে ও তাদের কায়িক সময় থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকেন এবং এ কারণেই স্ব স্ব সমাজে সমসাময়িক রুচির পরিবর্তনে অনুঘটকের ভূমিকা গ্রহণ করেন তারাই। যিনি যতো বেশি শক্তিমান তিনি ততো বেশি পরিবর্তন ঘটিয়ে দেন। সর্বকালে সর্ব দেশে অলক্ষ্যে এমনটা সংঘটিত হয়ে চলেছে। কাল পরম্পরায় শিল্পের অবয়বে যে পরিবর্তন বা তাতে আধুনিকতার যে পরিচয় বা চিনত্মাসমূহ বিধৃত হয় তা তো মূলত বহিঃরঙ্গে যদিও তার অনত্মরঙ্গেও যে পরিবর্তন সূচিত হয় না তা নয়। তবে স্পনসরের সময় থেকে ফিলিপ লারকিনের সময় পর্যনত্ম চর্যাপদের কাল থেকে আল মাহমুদের কাল পর্যনত্ম পরিবর্তন ঘটেছে কি ইংরেজি বাংলা বিষয় আসয়ে, প্রকৃতি, প্রেম, নারী, ঈশ্বর, মানুষ, মানুষের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা-হতাশা- এই সবই তো সেকালে যেমন একালেও তেমনি সমানভাবে কবির উপজীব্য। আমাদের অনত্মরের গহীন ভেতরে যে চিন্ময়, শাশ্বত বহমান ধারা কাজ করে তার চরিত্রে কি হয়েছে কোনো পরিবর্তন? পরিবর্তন ঘটেছে কি মানুষের গভীরতম নিবিড় অনুসন্ধিৎসার?
কেমন যাচ্ছে বাংলাদেশের কবিতার দিনকাল? কি রূপ বর্তমানের কবিতার? গতিমুখই বা কোন দিকে? এমনতর বহু প্রশ্ন আসছে প্রতিনিয়ত। দশক বিভাজনের পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু প্রবণতার উন্মেষ, চর্চা ও প্রভাব বিসত্মার হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তথাপি অর্ধশতকের কাব্যিক ঐতিহ্য, বিভ্রানিত্ম ও মেধার সংশ্লেষে আশ্চর্য নৈরাজ্যময় বর্তমান। বিগত শতকের আশি ও নব্বইয়ের ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খেতে-খেতে দিগ্বিদিক লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছে নতুন শতকের বাংলাদেশের কবিতা। তত্ত্বচর্চা এখন গৌণ। ধ্রুপদী, রোমান্টিক, মডার্ন, পোস্টমডার্ন ইত্যাদি তত্ত্ব এখন কবিতার ইতিহাসে সময় নির্দেশকমাত্র। চলতি শতকের প্রথম দশকের কবিতায় অবসন্ন হয়ে পড়েছে স্লোগানধর্মিতা, অবসিত হয়েছে প্রেমকাতরতা। কবিতার প্রধান দুই ধারা তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ ও মন্ময় বা গীতিকবিতা। বর্তমানের কবিতায় দুই ধারার একাংশ বর্জিত, অন্যাংশ অতিচর্চিত। তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ কবিতার মধ্যে রূপক, ব্যঙ্গকবিতার চর্চা অব্যাহত থাকলেও পরিত্যাজ্য হয়েছে গাথা, মহাকাব্য, নীতিকবিতা ও লিপি-কবিতা। একইভাবে মন্ময় বা গীতিকবিতার মধ্যে চিনত্মামূলক, প্রেমমূলক, প্রকৃতি বিষয়ক, স্বদেশ-প্রীতিমূলক, লঘু বৈঠকি ও চতুদর্শপদীর চর্চা অব্যাহত থাকলেও পরিত্যাজ্য হয়েছে ভক্তিমূলক, শোক-গীত ও সেত্মাত্র। বর্তমানের কবিতা কথার টুকরো, ভাবের ভগ্নাংশ-নির্ভর এক ভঙ্গুর ও পারম্পর্যহীন বাক্যসমবায়ে বিনির্মিত চিত্রকল্পের জটিল প্রকাশ। পাঠকের অনুযোগ কবিতা হয়ে উঠেছে কৃত্রিম, আড়ষ্ট, বানানো। কবিরা হয়ে পড়েছেন দৃশ্যশিকারী। কিন্তু সে দৃশ্যকে সর্বানত্মঃকরণে অনুসরণ করতে পারছে না ভাবনা। একটি প্রধান ভাব উৎপাদন ও তা অনুসরণ করে কবিতাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা পঞ্চাশ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা ভেঙে যাচ্ছে বর্তমান সময়ে। কবিতা এখন আর আখ্যান ও পূর্ণাঙ্গতাকে ধারণ করতে পারছে না। এক চিমটি লবণের মতো গল্প, মিথ, ইতিহাস, দর্শন, চিত্রের মিশেলে দৃশ্য থেকে দৃশ্যানত্মরে উল্লম্ফনে হয়ে উঠেছে কোলাজ। প্রথম দশকের প্রথম কবিতা সঙ্কলন ‘শূন্যের কবিতা’ সম্পাদনা করেছেন একই সময়ের কবি সোহেল হাসান গালিব। সঙ্কলনের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘মানুষের অনত্মর্জগতে নানামুখী চোরাস্রোতের টানে যে ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়েছে শূন্যের কবিতা সেইদিকে পাঠকের দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছে। সেই ঘূর্ণাবর্তে বিচিত্র জল-কোলাহল চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে উঠছে। এই জলের উৎস যেখানেই থাকুক না কেন, গনত্মব্যের ঠিক নেই কোনও। এখানে তৈরি হয়েছে এক কেওটিক বিভ্রম। এই বিভ্রমকে শনাক্ত করতে গিয়ে আমরা উৎসের দিকে ফিরে তাকাই নি। অর্থাৎ আমরা ইতিহাস-চেতনাকে ঠেলে দিয়েছি বিস্মৃতির দিকে। শূন্যের কবিতা প্রকৃতপক্ষে বিস্মৃতির সাধনাই করেছে বলা যায়। এ যেন নির্জ্ঞান লাভের সাধনা।’ এ দশকের আরেকজন কবি তারিক টুকু’র মতে, ‘এক ধরনের অনির্দিষ্টতা সম্পন্ন, অসঙ্গতিজ্ঞাপক ও চেতনাচূর্ণের এক বহুবর্ণিল ও বহুরৈখিক কোলাজকে বলা যায় শূন্যদশকের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য- যাকে নির্দিষ্টতাজ্ঞাপক কোনও একটি শব্দে বেঁধে ফেলা কঠিন।’ কবিতায় এ অনির্দিষ্টতা ও অসঙ্গতি কিন্তু প্রথম দশকের কবিদের মাধ্যমে আমদানি নয়। তাঁরা বিশেষত্ব দিয়েছেন মাত্র। পরের মুখে ঝাল খাওয়া বাংলা কবিতা পাঠকদের প্রতিষ্ঠিত এক রীতি। প্রতিষ্ঠিত কোনও কবি বা প্রতিষ্ঠান নতুন একজনকে নিয়ে ইতিবাচক মনত্মব্য করলেই মিলছে তাঁর কল্কে। স্ফীত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনের ভাড়ার, বইছে পাঠকের আগ্রহের জোয়ার। অন্যরা পিছিয়ে পড়ছেন, হারিয়ে যাচ্ছেন। ফলস্বরূপ বাড়ছে গোষ্ঠীর কদর ও নিয়ন্ত্রণ। সঙ্কুচিত হচ্ছে সাধনার নির্জনতা, প্রেরণার তাড়না ও ইতিবাচক দায়বোধ। এর পরিষ্কার প্রভাব পড়ছে কবিতায়। দিঘি থেকে বেরিয়ে সবাই রাজত্ব করতে চাইছেন নিজস্ব কুয়োয়। ভাল কবিতা লেখার চেয়ে, বেশি কবিতা লেখা ও প্রচারের প্রবণতা বেড়েছে। কবিত্বের চেয়ে মার্কেটিং কৌশল ও ধূর্তামি রপ্ত করছেন নতুন কবিরা। উচ্ছিষ্টের প্রতি লোভাতুর এ কবিরা করুণ ও কাতর চিত্তে সুবিধার কানাগলি খুঁজতে দ্বিধা করছেন না। তবে করধ্বনি-কোলাহলের বাইরে, সুবিধার মৌচাক থেকে দূরে, নির্জন মনোপথে এখনও হাঁটছেন কেউ কেউ।
অসংলগ্নতার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে ক্লানত্ম হচ্ছেন না বর্তমানের কবিরা। তাঁরা বলছেন, যেভাবে মূল ভাবনা গোটা কবিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে সেভাবে শীর্ষ কোন যুক্তি জীবনকে নিয়ন্ত্রণে অক্ষম। কোনও সমস্যার এখন আর একরৈখিক সমাধান মিলছে না। প্রয়োজন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে যুক্তি ও যুক্তিহীনতার তীর্থ থেকে তীর্থে। কবিতাকে সামগ্রিকতা দিয়ে দেখার দিন ফুরিয়েছে, এখন বহুরৈখিকতার তুমুল মহামারির যুগ। সার্থক কবিতার জন্য সঙ্গতিপূর্ণ পঙ্ক্তি রচনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তেমন অসঙ্গতিপূর্ণ পঙ্ক্তি রচনাও অর্থহীন নয়। একটি কবিতা একরৈখিকভাবে পূর্ণতা পেলো কিনা তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বহুরৈখিক কবিতায় পঙ্ক্তি বিশেষ কতটুকু কবিতা হয়ে উঠলো। পারিপার্শ্বিকতাকে কবিতাকে আক্রানত্ম করছে। বর্তমানের কবিতা ব্যক্তির যাপনশৈলী, দার্শনিকবোধ, স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাসার বিলাচ্ছে। প্রতীকায়ন ঘটাচ্ছে, সীমানাপ্রাচীর ভাঙছে। কবিতায় বাসা বাঁধছে আরোপিত আবেগ, স্বতঃস্ফূর্ততাহীন নির্মাণ, নিরীক্ষাবিমুখকতা, অপ্রাসঙ্গিক জটিলতা ও নন্দনসৌন্দর্যহীনতা। নতুন কবিরা এ অসঙ্গতিকে বহুরৈখিকতা হিসেবে আখ্যায়িত করলেও কবি সাযযাদ কাদির একে ‘চিনত্মার স্বচ্ছতার অভাব’ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চান। প্রবীণের অভিযোগ যুক্তির শেকলছেড়া ও বহুরৈখিকতার নামে কবিরা অসংলগ্নতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এতে তৈরি হচ্ছে বিভ্রম। বহুরৈখিকতার দোহাই দিয়ে ঢাকা হচ্ছে দুর্বলতা। কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ পুরনো। বর্তমানের কবিরা পাঠকের রুচিকে পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছেন না। এক্ষেত্রে কবি পাবলো নেরুদা’র মুখে ঝাল খেয়ে তাঁরা বলছেন, ‘কবিতা কোনও সময়ই স্থিতিশীল নয়, কবিতা জলস্রোতের মতো, মাঝে-মাঝে সৃষ্টিকর্তার হাতের নাগাল থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যায়।’ কিন্তু নতুন কবিদের কাব্যদর্শন অবোধ্য। অগোছালো, অসম্পূর্ণ, অর্থহীন, অবোধ্য বক্তব্য ও অন্যের কাছে মূল্যহীন ব্যক্তিগত আবেগকে অমূল্য ভাবছেন অনেকেই। গদ্য কবিতার অজুহাতে নিছক গদ্যকেই কবিতা বলে চালিয়ে দিতে চান কেউ-কেউ। নতুন কবিরা বলছেন, কবিতা হবে কেন্দ্রহীন, পরম্পরাহীন; অস্পষ্টতার ধূম্রজালে বাঁধা; এক শব্দের সঙ্গে অন্য শব্দের সম্পর্ক হবে না, এক পংক্তির সঙ্গে অন্য পংক্তি ভুগবে ক্রমাগত দাম্পত্য বিরহে। বিপরীতে প্রবীণ পাঠকরা বলছেন, এমন প্রবণতা এক শাব্দিক নৈরাজ্যের জন্ম দেবে। এর ভেতর থেকে কিছু শব্দ ও পংক্তি ঝলক দিলেও সার্বিকভাবে তেমন কিছু দাঁড়াবে না। দুর্বোধ্যতার দায়ে যখন কমছে কবিতার পাঠকসংখ্যা। তখন উল্টো প্রশ্ন উঠছে, কবিতা কি আদৌ কোনকালে বহুলপঠিত ছিল? এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, বর্তমানে কবিতার প্রতি মানুষের আগ্রহ রীতিমতো তলানিতে। কোনও-কোনও প্রবীণ পাঠক বলছেন, কবিতাকে ফের পাঠকের কাছে ফেরাতে প্রয়োজন এক নতুন জগৎ নির্মাণের। কিন্তু সে জগৎ কেমন হবে তা আবিষ্কারই হবে প্রধান চ্যালেঞ্জ। একদা প্রতিষ্ঠিত ধারণা ছিল, কবিদের কবি হতে হলে জানতে হবে সুর-ছন্দ-মাত্রা। রপ্ত করতে হবে অলঙ্কার শাস্ত্র। নিজস্বতা থাকতে হবে ভাষা, শব্দচয়ন ও প্রয়োগে। শব্দালঙ্কারের ভাণ্ডার আয়ত্ত থাকার পাশাপাশি থাকতে হবে শব্দালঙ্কারের সুনিপুণ ব্যবহার করবার দক্ষতা। ‘প্রকাশই কবিত্ব নয়’ প্রকাশের সঙ্গে থাকতে হবে সংগতিপূর্ণ ভাষা ও তার প্রয়োগ। মহাকবি কায়কোবাদ এ নিয়ে বলেছেন, ‘কবি হওয়ার ক্ষমতা মানবের নহে, উহা ঈশ্বর প্রদত্ত। ঈশ্বর যাহার কণ্ঠে মধুরতা দেন নাই, সে কেমন করিয়া সংগীত গাইয়া পরকে ভুলাইবে? কবি যে সাহিত্য-কুঞ্জ কাননের গায়ক।’ কবি আল মাহমুদ বলেন, কবির একটা স্থায়ী চেহারা হলো ছন্দ। কবি বলতেই আমাদের বুঝতে হবে যে, তিনি সমিল বাক্যে কথা বলেন। এটাই মানুষ ধরে নেয়। আটপৌরে গদ্যের বাইরে একটা ভাষা আছে তার। সেই ভাষা ছন্দোবদ্ধ। কবিকে ছন্দ জানতেই হবে।’ তরুণ কবিদের নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ নতুন কবিদের ছন্দে লিখতে রীতিমতো অনুরোধ করেছেন। তাঁর মতে, ‘সবাইকে একটা কথা অত্যনত্ম স্পষ্টভাবে মনে রাখা দরকার, যারা ছন্দ জানে না, তারা কবি নয়।’ কিন্তু বর্তমান কবিতার ঝোঁক হচ্ছে ছন্দহীনতার প্রতি। অনেক কবি প্রকাশ্যে গর্বের সঙ্গে বলছেন তিনি ছন্দ জানেন না কিন্তু কবিতা জানেন। এ ঝোঁকের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ-কেউ বলছেন, প্রচলিত সকল ছন্দই সাধুভাষার। কবিতায় কথ্যভাষার সে প্রতিষ্ঠা ঘটেছে তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারে নি ছন্দ। কিন্তু বাংলা কবিতা এখন অগ্রসরমান ও বিশ্বকবিতায় বহমান অপরাপর স্রোতের সঙ্গে লীন হতে আগ্রহী। তাই ছন্দের মতো বিষয়কে ঝেড়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর। নতুন কবিরা কবিতা ছন্দোবদ্ধ না গদ্য কাঠামোর, তার চেয়ে মানকে গুরুত্ব দিতে চান। এক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে আসছে শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি। ফলে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ছন্দোবদ্ধ কবিতার চেয়ে অনেক বেশি রচিত হচ্ছে গদ্যছন্দের কবিতা। যার স্বাদকে কবি আল মাহমুদ ‘লবণ ছাড়া ডিম খাওয়া’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। অবশ্য ছন্দবাদীরা এখনও গোঁ ধরে বলছেন, কবিতাকে স্মরণীয় করতে ছন্দের গুরুত্ব অপরিসীম। ছন্দ, অনুপ্রাস প্রভৃতি অলঙ্কার কবিতায় মুগ্ধতা তৈরি, পাঠককে অনুপ্রাণিত ও কবিতার প্রতি প্রেমাসক্ত করে তোলে। একথা বাসত্মবিক যে, কবিতা নিরাভরণা নয়, নারী যেমন আকার-ইঙ্গিতে, সাজসজ্জায়, বিলাসে-প্রসাধনে আপনাকে মনোরমা করে তোলেন, কবিতাও তেমনি শব্দে, সংগীতে, উপমায়, চিত্রে ও অনুভূতির নিবিড়তায় নিজেকে প্রকাশিত করে। তথাপি শেষ পর্যনত্ম কবিতা একটি মনোজাগতিক বিষয়। প্রথমত ভাবনা ও অনুভূতির অনুবাদ এবং দ্বিতীয় নির্মাণের বিষয়। বর্তমান কবিতার আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বাতন্ত্রহীনতা বা স্বতন্ত্র কাব্যভাষা সৃষ্টির ব্যর্থতা। জীবনানন্দ অনুভূতির ভাষা, জসীম উদ্দীন লোকজ ভাষা, শামসুর রাহমান নাগরিক ভাষা, আল মাহমুদ ধ্রুপদী ভাষায় লোকজ অনুষঙ্গ তুলে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজস্ব কাব্যভাষা। এমন স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন আরও অনেকেই। কিন্তু এখন কবির নাম কেটে দেয়া হলে কোনটি কার কবিতা তা নির্ধারণ করা রীতিমতো দুঃসাধ্য। সার্বিক বিবেচনায় ব্যক্তি নয় বাজছে সমষ্টির স্বর, একীভূত সমষ্টির ভাষা। তবুও অনেকের কবিতায় উঠে আসছে তীব্র জীবনবোধ। কিছু কবিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বহুসত্মর ও বহুরৈখিকতায় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ঘোরলাগা বিস্ময়ের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এতসব নৈরাজ্য-নৈরাশ্যের মধ্যেও আলোর ফুলকি দেখতে পাচ্ছেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। বর্তমান কবিতার প্রবণতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘লিরিকের তাৎপর্যপূর্ণ নবনিরীক্ষার পাশাপাশি গদ্যবয়ান, প্রতীকময়তা, কোলাজ, অনত্মর্গামিতা ও বক্রস্বরপ্রবণতা নব্বইয়ের পর শূন্য দশকের কবিতায় তাৎপর্যপূর্ণ বাঁকবদলের সূচনা করছে।’ সাম্প্রতিককালে ব্লগের কারণে কবিতাকে আটকাতে রাখতে পারছে না ভৌগোলিক সীমারেখা। মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে যাচ্ছে অনত্মর্জাল বিশ্বে। বাংলা কবিতার প্রতি মুহূর্তের উচ্ছ্বাসের ঢেউ ভাঙছে বাংলাভাষী পৃথিবীর প্রতিটি কূলে। ব্লগে দশকের রাজনীতি নেই, গোষ্ঠীর কানাগলি নেই, প্রতিষ্ঠানের ব্রাহ্মণ্য, দৈনিক ও লিটলম্যাগ সম্পাদকদের প্রভাব খাটে না, ফাঁকা বেলুন প্রকাশ্যে ফুটো হয়। তবে প্রযুক্তির এ সহজলভ্যতা পরোক্ষভাবে ক্ষতির কারণ হচ্ছে প্রকৃত কবিতার। দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছে কবিতা-অকবিতার। সর্বোপরি, প্রযুক্তি নির্ভর গতিময় জীবন, চাহিদার সম্প্রসারণ, মূল্যবোধের সঙ্কট ও পাঠক বিমুখতার ভেতরও কবিতার প্রতি নতুন কবিদের দুর্মর আগ্রহ সত্যিই আশাব্যঞ্জক। জীবনের অন্যান্য পরিচর্যার মতো কবিতায়ও অবশ্যই পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে বিসত্মৃততর হবে, আরো অনুপূঙ্খ হবে জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে কবির মনোযোগ। কিন্তু কবির সেই অর্জিত জ্ঞান সেই নিরীক্ষার নির্যাস কবিতাতেই প্রকাশিত হবে অনিবার্যভাবে অন্য কোনো শিল্প মাধ্যমে নয়। তবে ভবিষ্যতের কবিতা যে রূপই পরিগ্রহ করুক না কেন তা যদি বিশুদ্ধ কবিতার প্রজ্জ্বলনে ঝলসে না ওঠে তাহলে স্বভাবতই কাল তার বাঁধ সাধবেই। আর বিশ্ব সভ্যতা যদি ধ্বংসের দিকে না গিয়ে মঙ্গলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতের সেই সমাজে কবিতার মাত্রা অবশ্যই বেড়ে যাবে এবং কেবলমাত্র ব্যক্তির জন্যই নয় সমাজের জন্যও তা হবে প্রয়োজনীয়, অর্থবহ ও তাৎপর্যময়।
0 comments:
Post a Comment