Featured Posts

Saturday, June 13, 2015

দুঃখী রবীন্দ্রনাথ

ইংরাজী ১৮৬১ সালের ৭ইং মে তারিখে রবীন্দ্রনাথঠাকুরের জন্ম হয়। বাংলায় ঠিকুজী করতে গেলে তা দাঁড়ায় ১২৬৮ সালের পঁচিশে বৈশাখ, ভোর তিনটে নাগাত। আঁতুড়ঘর ঠাকুর পরিবারের জমিদারবাড়ী, মুলতঃ বাঙ্গালী অধ্যুষিত উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলের, ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের দালানকোঠা। দালান কোঠা হলেও সে সময় এলাকাটা তেমন “ভাল” ছিল না। পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরহিন্দু ব্রাম্ভণ ছিলেন, আদত পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়। ইংরেজরা কলকাতাকে “ক্যালকাটা”, যমুনাকে “জাম্‌না” করার মত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যানার্জি বানিয়েছিল। তবু ভাল। আমেরিকানদের পাল্লায় পড়লে এটাকে “ব্যান্ডোপেডায়ে” বানিয়ে ছাড়ত। ব্রাম্ভণদের লোকে “ঠাকুর মশায়” বলে সম্বোধন করতো। মশায়ের লেজ ছেড়ে সেই ঠাকুরটাই ক্রমশঃ স্থায়ীহয়ে গেল। ইংরেজরা আবার একে মডিফাই করে টেগোর বানিয়ে দেয়। তাও সই। জাপানীরা হলে আবার “তাগোরে” বানিয়ে ছাড়ত। রবীন্দ্রনাথের পিতামাতা ছিলেন যথাক্রমে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদা দেবী। মানুষটা ভাল এবং হীত কাজের জন্য তিনি “মহর্ষি” খেতাব পেয়েছিলেন। এই ঠাকুর পরিবারের আদত বসত ছিল আবার যশোর খুলনা অঞ্চলে। জমিদারীও। দেবেন্দ্রনাথ বাবুখুলনার বাগেরহাটের শাষক ও সুফি সাধক খান জাহান আলী দ্বারা প্রভাবান্বিত হন।অনেকের মতে তিনি ভাবশিষ্য ছিলেন। সেজন্য তাঁদেরকে “পিরালী ব্রাম্ভণ” বলা হতো।উদার মনের দেবেন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মের সংস্কারক ও ব্রাম্ভধর্মের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়ের মতবাদে আকৃষ্ট হোন ও তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে পড়েন। রাম মোহনের হাত ধরেই তিনি ব্রাম্ভ ধর্মে দীক্ষা নেন এবং এই ধর্মের প্রচার ও প্রসারে সম্পুর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন। মৃত্যুর আগ পর্য্যন্ত তিনি “আদি ব্রাম্ভ সমাজ”এর প্রধানপৃষ্ঠপোষক ছিলেন।রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ একজন কবি ও দার্শনিক ছিলেন। তাঁর আর একভাই সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রথম ভারতীয় আই,সি,এস - যিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের মেম্বার হিসাবে একান্ত সাদা চামড়া সর্বস্বলীগে যোগ দেবার পারদর্শিতা দেখাতে পেরেছিলেন। আর এক ভাই, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একজন প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার ও নাট্যকার ছিলেন। বোনদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী দেবী একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ সুসাহিত্যিক হয়েছিলেন।রবি যখন জন্মান, তখন বাবা দেবেন্দ্রনাথের বয়স ৪৫। বড় চার ভাইয়ের বয়সের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রনাথের ২১, সত্যেন্দ্রনাথের ১৯, হেমেন্দ্রনাথের ১৭ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ১৩ বছর।


রবীন্দ্রনাথ শুধু যে বয়ষে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তাই নয়, তফাৎটা এত বেশী ছিল যে,পিঠোপিঠি ভাইবোনদের সঙ্গে খেলাধুলা, গালগল্প, হাসিকান্না, মারপিট, ধাক্কাধাক্কি করে ছেলেবেলার যে মধুর দিনগুলি কাটে, যেটা প্রায় সবার ভাগ্যেই জোটে এবং যা আপাতদৃষ্টিতে অতি স্বাভাবিক, তা রবীন্দ্রনাথের ভাগ্যে জোটেনি।তারা যেন ভাইবোনের বদলে এক একটা গার্জেন, অভিভাবক। এই মরুভুমির মধ্যে একমাত্র মরূদ্যান ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী, কাদম্বরী দেবী। তিনিরবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে অল্প একটু বড় ছিলেন। প্রায় সমবয়সী বলে তিনি খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনে অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।সেইবৌদির অকস্মাৎ আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ রবীন্দ্রনাথের নিঃসংগ জীবনটা পুনরায় মরুময় করে তুলেছিল এবং তাঁর মানসিকতা ও ভবিষ্যত সাহিত্যকর্মের উপর গভীর দাগ ফেলেছিল।জীবনের প্রথম দশ বছরের বেশী নিঃসংগতা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের ঐ সময়টা বেশ খারাপ ভাবেও কাটে। প্রথমতঃ বাড়িতে প্রচুর লোকজন, অতিথিদের হরহামেশ আনাগোণা, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে দৈনিক লোকসংখ্যা ১০০ থেকে ২০০ জন হয়ে যেত। সংসার ও অতিথি সামলাতে মা হিমশিম খেয়ে যেতেন।সব সময় এত ব্যস্ত থাকতেন যে ছেলে মেয়েদের পিছনে কোন সময় দিতে পারতেন না। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথেরমায়ের আদরযত্ন পাবার তেমন সৌভাগ্য হয়নি। উপরন্তু বাবা অনেকটা সন্যাস গ্রহণের মতো কাজে অকাজে প্রায় সময় বাইরে বাইরে থাকতেন – উত্তর ভারত, ইংল্যান্ড বা অন্য কোথাও। অগত্যা রবিকে বাধ্য হয়ে চাকর বাকরদের হাতে মানুষ হতে হয়েছিল। গার্জেনদের কড়া নজর না থাকলে চাকর বাকরদের যা হয়। চাকররা এক একজন মাস্তান হয়ে শাসন করত। রামায়ণের সীতার মতো রবীন্দ্রনাথের চতুর্দিকে একটা গন্ডী কেটে দিয়ে বলত, “খবরদার, কেবল স্কুলে যাওয়া ছাড়া এই গন্ডীর বাইরে বেরিয়েছ কি আর রক্ষা নেই”। গোলমাল করলে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ভাইবোনদের হরেক কিসিমের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। ভয় দেখানোর জন্য তারা রক্ত খেকো রাক্ষস, কন্ঠকাটা ভুত, ভয়াবহ দস্যু, ডাকাত আরও কত কিছুর গল্প করত।অনেক সময় বাচ্ছাদের খাবার দাবার তারা নিজেরাই খেয়ে ফেলত। চাকরদের খুশি করার জন্য খাবারে রুচী নেই বলে রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় না খেয়ে থাকতেন।সব মিলিয়ে এই বদ্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের মন সদাই ছটফট করত। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথকে শারিরীক ও মানসিক দিক থেকে তৈরী করানোর জন্য বেশ আঁটসাট একটা নীতিমালা তৈরী হয় ও তার প্রয়োগ প্রণালীরও একটা তালিকা প্রস্তুত করা হয়। তাঁর গৃহশিক্ষা শুরু হয় দাদা হেমেন্দ্রনাথের কাছে। শারিরীক দিক ঠিক করতে সাঁতার, উঁচু এলাকায় হাঁটা, জুডো ও কুস্তি এবং মানসিক দিকের উন্নতির জন্য শরীরবিদ্যা, ছবি আঁকা, ইংরেজী, ভুগোল, ইতিহাস, অঙ্ক, সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যের উপর পড়াশুনো শুরু হয়। এগুলো হতো স্কুলে যাবার আগেও পরে।এত চাপের মধ্যে তখন থেকেই রুটিন মাফিক স্কুলের শিক্ষাপ্রণালীর ঊপর তাঁর বিতৃষ্ণা শুরু হতে থাকে।


পিরালী ব্রাম্ভণরা ছিল গোত্র হিসেবে বেশ ছোট এবং রক্ষণশীল। বাংলার অন্যান্য ব্রাম্ভণদের সঙ্গে সামাজিকভাবে ওঠাবসা অনেকটা সীমিত ছিল। কিন্তু বিয়ে সাদীর ব্যাপারটা ছিল একেবারে নো নো। অনেকটা বৃহত্তর খ্রীষ্টান সমাজের সঙ্গে “জেহোভাস উইটনেস” অনুসরণকারী খ্রীষ্টানদের মত। তাই পিরালী ব্রাম্ভণরা সাধারণতঃ বিয়ে শাদীগুলো তাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতেন। কিন্তু গোত্রটি ছোট হওয়ায় উপযুক্ত বয়সের পাত্র পাত্রী মেলানো প্রায়শই দূরুহ হয়ে পড়ত। তাইরবীন্দ্রনাথের যখন বিয়ে হয়, তাঁর বয়স ২২ বছর ৭ মাস হোলেও তাঁর স্ত্রী ফুলি ওরফে ভবতারিনী দেবীর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর ৯ মাস। ভবতারিনীর জন্ম ১৮৭৩ সালে খুলনার দক্ষিণ ডিহির ফুলতলি নামে এক গন্ডগ্রামে। ভবতারিনী দেবীর বাবা, বেণীমাধব রায়চৌধুরী ঠাকুরদেরজমিদারীতে সামান্য বেতনের চাকুরী করতেন। ভবতারিনী নামটা অনেকটা সেকেলে শোনায় বলে রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা নামটা পাল্টিয়ে মৃণলিনী দেবী নাম দেন। আর বিয়েটা কন্যার দুঃস্থ পিতার গ্রামের বাড়ীতে না হয়ে সংঘটিত হয়েছিলজোড়াসাঁকোর বিশাল ঠাকুর বাড়ীতে৯ ইং ডিসেম্বর, ১৮৮৩ সালে। কিন্তু বিয়ের দিন রবীন্দ্রনাথের পিতা, মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ও বড়বোন সৌদামিনি দেবী বিয়ে বাড়িতে ছিলেন না। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, সৌদামিনি দেবীর ঘরজামাই স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় এই বিয়ের দিনেইজোড়াসাঁকোয় নিজের শ্বশুরবাড়ীতে মারা যান।শহুরে জমিদার, সম্ভ্রান্ত ঠাকুর বাড়ীর উজ্জ্বলতম সদস্য, এক সৌম্যকান্তি, বিলেত ফেরত, ২২ বছরের এক আকর্ষণীয় যুবক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায় কপর্দকহীন, অজ পাড়াগাঁয়ের এক পরিবারের প্রায় নাবালিকা, প্রায় অশিক্ষিতা ১৩ বছরের ছোট এক কিশোরীকে কেন বিয়ে করতে হয়েছিল কে জানে? সেটা কি কেবল পিরালী ব্রাম্ভণদের সঙ্গে কলকাতার তথাকথিত “ভদ্র সমাজের” অমিলের ফসল? এই নিরাড়ম্বর আয়োজন ও খোদ বিয়েটা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বেশ আক্ষেপ ছিল বলে শোনা যায়। বিয়ের কার্ডের খামের এককোণে ছাপিয়েছিলেন মধুসূদন দত্তের কবিতার এক লাইন,”আশার ছলনে ভুলি, কি ফল লভিনু হায়”।


বিয়ের ব্যাপারে ভবতারিনী দেবীর শুধু নামটাই পালটানো হয়নি বা বিয়েটা মানানসই জায়গায় সম্পন্ন হবার ব্যবস্থা করেই শেষ হয়নি, ঠাকুরবাড়ীরবধু হিসেবে পরিগণিত হবার জন্য তাঁকে রীতিমত লেখাপড়াশেখাবার ব্যবস্থা হয়েছিল। এর প্রধান উদ্দ্যোক্তা ছিলেন আই,সি,এসসত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী,জ্ঞানদা নন্দিনী দেবী। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কাশ্মিরের পাহাড়ে অবস্থানরত অবস্থায় বৌমাকে যেন লরেটো স্কুলে ভর্তি করা হয়, মাইনে এবং পোশাক আশাকের খরচ বাবদ জমিদারী থেকে মাসিক ১৫ টাকা ভাতা বরাদ্দ করে ছেলেকে চিঠি পাঠালেন। রবীন্দ্রনাথ নিজের উদ্দোগেও স্ত্রীর ইংরেজী শিক্ষার জন্য একজন মেম সাহেব ও সংস্কৃত শিক্ষার জন্য পন্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নকে নিয়োগ করেছিলেন। পাঠশালা শেষ করা মৃণালীনি দেবী এই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশুনা করে তিনি একজন সংবেদনশীল মানুষ ও সংস্কৃতিমনা লেখিকা হয়ে উঠেছিলেন। মুল সংস্কৃত থেকে তিনি প্রায় সমগ্র রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করে এনেছিলেন। মহাভারতের শান্তি পর্বের অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ করার সুযোগ পাননি। বয়সের অধিক তারতম্য, সামাজিক নিদারুণ অসমতা এবং অন্যান্য অলিখিত গভীর ব্যবধানের জন্য মৃণালিণী দেবী রবীন্দ্রনাথের কেবল “ওয়াইফ”ই হতে পেরেছিলেন। কবি নিজের মনের কষ্টে তাঁকে কখনো প্রকৃত “স্ত্রী”র মর্য্যাদা দিয়ে মনের মধ্যে বসাতে পারেন নি। এর উপর বিয়ের মাত্র ৪ মাসের মাথায় কবির প্রেরণাদায়িনী বৌঠান কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করে বসেন। কবির তখন দিগবিদিকজ্ঞ্যানশূন্য অবস্থা।


বিয়ের পর মাত্র ৮ বছরের মধ্যে মৃণালিনী দেবী পর পর পাঁচ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি প্রথম সন্তান পেটে ধারণ করেন। এক সন্তানের পর শরীর ঠিক হয়ে ওঠার আগে বার বার সন্তান ধারণের জন্য মৃণালিনী দেবী শারিরীক ও মানসিক দিক থেকে পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন না। ১৯০১ সালে মাত্র ৫ জন ছাত্র নিয়ে রবীন্দ্রানাথ শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের সূচনা করেন। এই ৫ জনের ২ জন হল তাঁর নিজের দুই পুত্র, রথীন্দ্রনাথ ও শমীন্দ্রনাথ। বয়সে তারা নিতান্তই শিশু। জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বসবাসের পূর্বে ১৯০১ সালের ১৫ইং জুন ও ৫ইং আগষ্টকবি তাঁর দুই কিশোরী কন্যা, ১৪ বছরের মাধুরীলতা ও ১০ বছরের রেণুকাকে বিয়ে দিয়ে দেন। নিজের অল্পবয়সে বিবাহ ও তার ফলের কথা চিন্তা করে মৃণালিনী দেবী বিয়েতে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা রবীন্দ্রনাথের সে কথায় কান দেবার সময় ছিল না। শান্তিনিকেতন চালানোর প্রথম দিকে কবিকে নিরারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে পড়তে হয়। মৃণালিনী দেবী নিজের হাতের বালা খুলে দিয়েছিলেন এবং ঐ অসুস্থ শরীর নিয়ে তাঁকে শান্তনিকেতনের সব রান্না করতে হত। এভাবে তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভালোমত চিকিৎসা করানোর পয়সাও ছিল না। শেষে ১৯০২ সালে অসুস্থ মৃণালিনী দেবীকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আনা হয়। কিন্তু ডাক্তাররা নাকি প্রকৃত রোগ ধরতে ব্যর্থ হয়।  দিনে দিনে তাঁর শরীর খারাপের দিকে যেতে থাকে। তিনমাস ভোগান্তির পর শেষ পর্য্যন্ত ১৯০২ সালের ২৩ শে নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ২৯ বছর।  আর রবীন্দ্রনাথের তখন চলছিল ৪১ বছর ৬ মাস।পুত্র রথীন্দ্রনাথের অনুমান তার মা অ্যাপেন্ডাসাইটস-এ মারা গেছেন।কিন্তু অন্য খবর অনুযায়ী তিনি ষষ্ঠ্য সন্তান নিয়ে অন্তঃস্বত্তা ছিলেন এবং ঐ অবস্থায় এক বাড়ীতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যান। যাই হোক মৃণালিনী দেবীর তিল তিল করে মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি অবহেলা করার জন্য মনে মনে খুবই অনুতপ্ত হোনএবং স্ত্রীর অভাব দারুণভাবে অনুভব করতে থাকেন, অনেকটা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্য্যাদা না বোঝার মতো। তাই তিনি লিখেছেন, “আমি না হয় অন্ধ ছিলুম, তুমি কেন জোর করে কেড়ে নিলে না যা তোমার সত্যিকারের প্রাপ্য ছিল। সময় হলে কেন রাজার মত জানিয়ে দাওনি তোমার প্রবলতম সেই দাবী। ভেঙ্গে ফেললে না কেন ঘরের চাবি। আজ যে সেই মিথ্যার বোঝা আমার সার্থকতার পথ বন্ধ করে দিল”।


মৃনালিনী দেবীদের মোট পাঁচটি সন্তানের মধ্যে ছিল তিন কন্যা ও দুই পুত্র। এদের মধ্যে তিনজন রবীন্দ্রনাথের ৫৭ বছর পার হবার আগেই মারা যায়। বড়মেয়ে মাধুরীলতার ডাকনাম ছিল বেলা বাবেলী। বিয়ে হয়েছিল কবি বিহারীলাল চক্রবর্তির তৃতীয় পুত্র, পেশায় উকিল, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তির সঙ্গে। তিনি স্বামীর কলকাতার বাড়িতেমাত্র ৩১ বছর বয়সে যক্ষারোগে মারা যান ১৬ মে, ১৯১৮ ইং ।


পরেরটি ছিল পুত্রসন্তান- বড়ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রথীর জন্ম হয় ১৮৮৮ সালের ২৭ শে নভেম্বর এবং ২১ বছর বয়সে বিয়ে হয় ১৭ বছরের প্রতিমা দেবীর সঙ্গে , ১৯১০ সালের ২৭ শে জানু্যারীতে। প্রতিমা দেবী গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের ভাগ্নী, বোন বিনয়ীনি দেবীর কন্যা। তার আগে একটা বিয়ে হয়েছিলকিন্তু স্বামী নীলনাথ মুখ্যোপাধ্যায় মারা যাওয়ায় বিধবা হয়ে পড়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথ ও প্রতীমা দেবীর বিয়েটাই ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিবাহ।এঁদের কোন সন্তানাদি হচ্ছিল না। তাই নন্দিনী নামে এক কন্যাকে তাঁরা দত্তক নেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর একসময় তাঁরা আলাদা হয়ে যান। রথীন্দ্রনাথ ১৯৫১ সালের ১৪ ইং মে থেকে ১৯৫৩ সালের ২২ শে আগষ্ট পর্য্যন্ত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য ছিলেন। ১৯৬১ সালের ৩ রা জুন দেরাদুনে ৭২ বছর ৬ মাস বয়সে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। প্রতীমা দেবী আরো কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে প্রায় ৭৬ বছর বয়সে মারা যান।


রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় সন্তান ( দ্বিতীয় মেয়ে) , রেনুকা দেবী বা রাণী-র জন্ম হয় ১৮৯১ সালের ২৩ শে জানুয়ারী। বড়বোন মাধুরীলতার বিয়েরদেড় মাসের মধ্যেই ১৯০১ সালে রাণীর বিয়ে হয় সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্যের সাথে। তার বয়স ছিল তখন মাত্র১০ বছর ৬ মাস। তিনিও মাত্র ১২ বছর ৭ মাস বয়সে যক্ষারোগে মারা যান। রেনুকাও কোন সন্তান সন্ততি রেখে যেতে পারেন নি।


চতুর্থ সন্তান (ছোটমেয়ে)মীরা দেবী, ডাকনাম অতসী-র জন্ম হয় ১৮৯৪ সালের ১২ ইং জানুয়ারী। অতসীর যখন নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৯০৭ সালের ৬ ইং জুনে, তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর ৪ মাস। আরও তের বছর ঘর সংসার করার পর ১৯২০ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়। মীরা দেবী অনেক পরে ১৯৬৯ সালে যখন শান্তিনিকেতনে মারা যান, তখন তার বয়স প্রায় ৭৫ বছর। মীরা দেবীদের দুজন সন্তান ছিল। ছেলে নীতিন্দ্রনাথ ডাক নাম নীতু ও মেয়ে নন্দিতা, ডাকনাম বুড়ি। এই নীতুর জন্ম হয় ১৯১২ সালে। উচ্চশিখ্যার্থে জার্মাণীতে থাকা কালীন যক্ষারোগে ১৯৩২ সালের ৭ইং আগষ্ট,মাত্র ২০ বছর বয়সে মারা যান। তখনও তাঁর বিয়ে শাদী হয়নি। এদিকে রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৭১ বছর চলছে। মীরা দেবীদের একমাত্র কন্যা, নন্দিতা দেবী, বুড়ির জন্ম হয় ১৯১৬ সালে ও বিয়ে হয়কৃষ্ণ কৃপালনির সঙ্গে। তিনি কৃপালনি সাহেবের আগেই ১৯৬৭ সালে ৫১ বছর বয়েসে মৃত্যুবরণ করেন। নন্দিতাদেরও কোন সন্তানাদি হয়নি।


পঞ্চম সন্তান ( দ্বিতীয় পুত্র) সমীন্দ্রনাথ, ডাকনাম সমী-র জন্ম হয় ১৮৯৬ সালের ১২ ইং ডিসেম্বর।মীরা দেবীর বিয়ের মাত্র ছ’মাসের মধ্যেই, যখন তিনি বিহার প্রদেশের মুঙ্গেরে এক বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে যান, সেখানে হঠাৎকলেরায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ১০ বছর এগার মাসের মাথায় মারা পড়েন। তারিখটা ছিল ১৯০৭ সালের ২৩ শে নভেম্বর। পাঁচ বছর আগে ঠিক এই দিনটীতে তিনি মা মৃণালিনী দেবীকে হারিয়েছিলেন।


দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকা অবস্থায় তাঁর সবচেয়ে প্রিয়জনদের ইহজগত থেকে একে একে বিদায় নেবার পালা গুলো নিজের চোখে দেখে যেতে হয়েছে। তাঁর এত বড় বিরাট সংসারের রক্তের সম্পর্কের উত্তরাধীকারি বলতে আর কেউ বেঁচে নেই। বাকী থাকছে ঠাকুর বাড়ীর সঙ্গে আলগা সম্পর্কের, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতীমা দেবীর দত্তক নেওয়া সেই মেয়েটি, যার নাম নন্দিনী ঠাকুর। নন্দিনীর জন্ম হয়েছিল ১৯২২ সালে এবং তাঁর বিয়ে হয় ১৯৩৯সালের ৩০শে জানুয়ারী, গুজরাট থেকে আগত শান্তিনিকেতন হাসপাতালের ডেন্টিস্ট ডাঃ গিরিধারী লালার সঙ্গে। তাঁদের সন্তানের জন্ম হয় কলকাতায়, ১৯৫৩ সালে, নাম সুনন্দন লালা। সুনন্দন এখন “প্র্যাক্সএয়ার” নামে এক বিখ্যাত এক গ্যাস কোম্পানীতে কাজ করছেন ব্যাঙ্গালোরে। তাঁর স্ত্রী শমিতা রবীন্দ্রসঙ্গীত গান।  সুনন্দনদের দুই ছেলে। বড়টী বৌ নিয়ে এখন আমেরিকার আটলান্টায় থাকে। ছোটটী আইনজীবি, থাকে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে।  

0 comments:

Post a Comment