Featured Posts

Tuesday, June 9, 2015

নির্মলেন্দু গুণ'র কবিতা-১

১৬-৬-৮৪ - নির্মলেন্দু গুণ


হয় নিদ্রা আসুক, না হয় এক্ষুনি অবসান হোক
এই অসহ রাত্রির । আমি আর সইতে পারছি না ।
আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে নির্ঘুমতা ।
এই রাত্রি এখন আমার সহ্যসীমার বাইরে ।
দুঃখে-ক্ষোভে, অভিমানে আমার বুকের ভিতর থেকে
বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস, যেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে
শূন্য হাতে উঠে আসা কোনো ব্যর্থ ডুবুরী ।

চোখের ভিতরে হুল ফুটিয়ে বলি, একটু ঘুমাও,
আর কতক্ষণ, আর কতদিন এভাবে চলবে?
লক্ষীসোনা, মণি আমার, একটু ঘুমাও ।
মনকে বলি, এখন তো ছোট্ট ছেলেটি তুমি নও,
যে তোমাকে শোনাবে কেউ ঘুমপাড়ানিয়া গান ।
এখন তোমার ঘুমের জন্য কোন গান নেই ।
ভালোবাসার সাঁকো বেয়ে তুমি পৌছে গেছো এক
চির-নির্ঘুম দেশে, যেখানে দাউদাউ অগ্নিকুণ্ডে
জ্বলন্ত পৃথিবী; যেখানে নিদ্রা এক অচেনা প্রসঙ্গ ।

একশ' থেকে উল্টোদিকে শূণ্য পর্যন্ত গুনে
সেই কখন শেষ করেছি, তবু ঘুম আসে না ।
চিৎকার করে বলি, একশ এতো কম কেন?


দুঃখ আমাকে জাগিয়ে রাখে ।
আনন্দের সাধ্য কী সে পাল্লা দেবে
দুঃখের সঙ্গে, দুঃখ খুব জাগরণ ভালোবাসে ।
হায় আমার দিনগুলি রাতের সঙ্গে, আর
রাতগুলি দিনের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে ।
একটি দিনকে অন্যদিন থেকে পৃথক করে যে-নিদ্রা,
সে-ই যদি অন্তর্হিত হয়, তবে কীভাবে আমি
অনুভব করি আমার সপ্রাণতা?
আমার কাঁধে চেপে বসেছে অখণ্ড সময়ের বোঝা ।
চিৎকার করে বলি, 'এ বোঝা আমার নামাও ।'

তুমি কি কিছু শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছো?
প্রত্যাশা করছো কেউ তোমাকে কিছু বলবে?
কেউ তোমাকে কিচ্ছু বলবেনা, লক্ষীসোনা ভাই,
আমি বলছি, তুমি ঘুমাও । আরও একটু ভাবো,
বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করো তোমার অস্তিত্ব;
'ভালোবাসা' শব্দিটিকে নাড়াচাড়া করে দেখো ।

হয়তো একটু হলেই রহস্যের সূত্র পেয়ে যাবে,
চোখের সামনেই খুলে যাবে অন্ধকারের তালা,
আর তুমি পেয়ে যাবে তোমার ঘুম-নগরীর চাবি ।
বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া নকল নিদ্রা নয়,
তাকে তুমি ভিতর থেকে জাগাও ।


আমার খোলা আকাশের মতো চোখে
উড়ে বেড়ায় হরেক রঙের পাখি ।
আমার মস্তিষ্কের গভীর গোপন কুঠুরিতে
আজস্র পরীর দল প্রলয় নৃত্যে মাতে ।
স্বপ্ন-প্রেম, কামনা-বাসনা, স্মৃতি-বিস্মৃতির
জটাজলে বন্দী আমার রাত্রির পৃথিবী ।

আমি সেই জট খুলতে খুলতে ক্লান্ত হই,
ক্লান্ত হই; কিন্তু আমার ঘুম আসে না ।
আমার আত্মার অন্তর্ভেদী আর্তনাদে
ঘরের দেয়ালগুলি কাঁপে ।

রাতজাগা টিকটিকি ও আরশোলার মতো
আমি দেয়ালে-দেয়ালে অস্থির ছুটে যাই ।
শেষবারের মতো রাতের উদ্দেশে
আমার শেষ-তর্জনী তুলে বলি;
'হয় অবসান হোক এই দুঃসহ রাত্রির,
না হয় নিদ্রা আসুক ।'

পতিগৃহে পুরোনো প্রেমিক - নির্মলেন্দু গুণ


পাঁজরে প্রবিষ্ট প্রেম জেগে ওঠে পরাজিত মুখে,
পতিগৃহে যেরকম পুরোনো প্রেমিক
স্বামী ও সংসারে মুখোমুখি ।
প্রত্যাখ্যানে কষ্ট পাই,--ভাবি, মিথ্যে হোক
সত্যে নাই পাওয়া । বুকের কার্নিশে এসে
মাঝে-মধ্যে বসো প্রিয়তমা,
এখানে আনন্দ পাবে, পাবে খোলা হাওয়া ।

সেই কবে তোমাকে বুনেছি শুক্রে, শুভ্র বীজে,
যখন নদীর পাড় ঢাকা ছিল গভীর সবুজে ।
সময় খেয়েছে মূলে, বীজের অঙ্কুরে অমাক্রোধ,
দাবাগ্নিতে পুড়ে গেছে ভালোবাসা জনিত প্রবোধ ।

অহল্যাও পেয়েছিল প্রাণ জীবকোষে, পাথর-প্রপাতে
একদিন । তোমার অতনু জুড়ে কোনোদিন হবে নাকি
সেরকম প্রাণের সঞ্চার ? কোনদিন জাগিবে না আর?
পুরোনো প্রেমিক আমি কতো পুরাতনে যাবো?
ক্ষমা করো ভালোবাসা, প্রিয় অপরাধ ।

যদি কভু মধ্যরাতে পরবাসে ঘুম ভেঙে যায়,
যদি আচ্ছন্ন স্বপ্নের ঘোরে উচ্চারণ করো এই মুখ,
যদি ডাকো যৌবনের প্রিয় নাম ধরে--;
রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাবো পতিগৃহে পুরোনো প্রেমিক ।
মুখোমুখি দাঁড়াবো তোমার, যদি ক্ষমা পাই ।

মানুষের হৃদয়ে ফুটেছি - নির্মলেন্দু গুণ


গতকাল ছিল কালো-লালে মেশা
একটি অদ্ভুত টুনটুনি ।
লাফাচ্ছিল ডাল থেকে ডালে,
পাতার আড়ালে, ফুল থেকে ফুলে ।

তার সোনামুখী ঠোঁট, যেন
কলমের ডগায় বসানো একরত্তি হীরে ।
প্রতিটি আঁচড়ে কেটে ভাগ করছিল
ফুল থেকে মধু, মধু থেকে ফুল;
আমার সমস্ত কলতল ভেসে যাচ্ছিল
রক্তকরবীর মধুস্রোতে ।

আজ সকাল থেকেই রক্তকরবীর ডালে
ফুলের আগুন-জ্বলা হাত;
ফুল তুলছেন এক বৃদ্ধা পূজারিণী ।
তার হাতে রক্তকরবীর নকশা কাটা সাজি ।

মধু নয়, শূন্য বৃন্তে শুভ্রকষধারা ।
কলতলে রক্তকরবীর হু হু কান্না,
আমি কী করব? আমি কী করব?
রক্তকরবীর ডালে আমি তো ফুটিনি ।
আমি পৃথিবীর দুঃখী ফুল,
মানুষের হৃদয়ে ফুটেছি ।

গতকাল একদিন - নির্মলেন্দু গুণ


গতকাল বড়ো ছেলেবেলা ছিল
আমাদের চারিধারে,
দেয়ালের মতো অনুভূতিমাখা মোম
জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমারা দেখেছি
শিখার ভিতরে মুখ ।
গতকাল ছিল জীবনের কিছু
মরণের মতো সুখ ।

গতকাল বড়ো যৌবন ছিল
শরীরে শরীর ঢালা,
ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিল
উদাসীন গাছপালা ।

আমরা দু'জনে মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে
লুকিয়েছিলাম প্রেম,
গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল
বুঝিনি কী হারালাম !

গতকাল বড়ো এলোমেলো চুলে
বাতাস তুলেছে গ্রিবা,
চুমু খেয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার
উজ্জ্বল মধুরিমা ।

গতকাল বড়ো মুখোমুখি ছিল
সারাজীবনের চাওয়া,
চোখের নিমিষে চোখের ভিতরে
চোখের বাহিরে যাওয়া ।

0 comments:

Post a Comment