Featured Posts

Tuesday, June 30, 2015

কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি

এই বইয়ের নাম দিয়েছি ‘কবিতা ক্লাস’। এতে চমকাবার কিছু নেই। অনেকে মনে করেন যে, কবিতা একটি অপার্থিব দিব্য বস্তু, এবং তাকে আয়ত্ব করবার জন্যে, মুনিঋষিদের মতো, নির্জন পাহাড়ে-পর্বতে কিংবা বনে-জঙ্গলে গিয়ে তপস্যা করতে হয়। আমি তা মনে করি না। আমার বিশ্বাস, জাতে যদিও আলাদা, তবু কবিতা-ও সাংসারিক বিষয় ছাড়া আর-কিছুই নয়, আমাদের এই সাংসারিক জীবনের মধ্যেই তার বিস্তর উপাদান ছড়িয়ে পড়ে আছে, এবং ইস্কুল খুলে, ক্লাস নিয়ে, রুটিনমাফিক আমরা যেভাবে ইতিহাস কি ধারাপাত কি অঙ্ক শেখাই, ঠিক তেমনি করেই কবিতা লেখার কায়দাগুলো শিখিয়া দেওয়া যায়। ‘কায়দা’ না-বলে অনেকে বলবেন ‘কলাকৌশল’, তা বলুন, কথাটা তার ফলে আর-একটু সম্ভ্রান্ত শোনাবে ঠিকই, কিন্তু মূল বক্তব্যের কোন ইতরবিশেষ হবে না। বিশ্বাস করুন চাই না-করুন, কবিতা লেখা সত্যিই খুব কঠিন কাণ্ড নয়।
সেই তুলনায় পদ্য লেখা আরও সহজ। শুধু কায়দাগুলো রপ্ত করা চাই, ঘাঁতঘোঁত জেনে নেওয়া চাই। কবিতা আর পদ্যের তফাত কোথায়, এক্ষুনি সেই তর্কে ঢুকে ব্যাপারটালে ঘোরালো করে তুলতে চাই না। তার চাইতে বরং জিজ্ঞেস করি, আপনার বয়স যখন অল্প ছিল, তখন ছোটপিসি কি ন-মাসি কি সেজদির বিয়ের সময়ে কি আপনার একখানা উপহার লিখবার ইচ্ছে হয়নি? হয়তো হয়েছিল। হয়তো ভেবেছিলেন, “বাঃ কী মজা, বাঃ কী মজা, খাব লুচি মন্ডা গজা” ইত্যাদি সব উপাদেয় খাবারদাবারের কথা দিয়ে লাইন-কয় লিখে তারপর “বিভুপদে এ-মিনতি—“ জানবেন যে, নবদম্পতি যেন চিরকাল সুখে থাকে।
কিন্তু হায়, শেষ পর্যন্ত আর হয়তো লেখা হয়নি। হবে কী করে? ‘মজা’র সঙ্গে ‘গজা’র মিলটাই তখন মনে পড়েনি যে। আর তাই, কড়িকাঠের দিকে ঘণ্টাখানেক তাকিয়ে থেকে, এবং নতুন-কেনা মেড-ইন-ব্যাভেরিয়া পেনসিলের গোড়াটাকে চিবিয়ে ছাতু করে, শেষপর্যন্ত হয়তো ‘ধুত্তোর’ বলে আপনি উঠে পড়েছিলেন। মনে-মনে খুব সম্ভব বলেছিলেন, “ওসব উপহার-টুপহার লেখার চাইতে বরং মুদির দোকানের খাতা লেখা অনেক সহজ।”
মুদির দোকানের প্রসঙ্গে একটা পুরোনো কথা মনে পড়ল। বছর পঞ্চাশেক আগেকার ঘটনা। আমার বয়স তখন বছর-দশেক। সেইসময়ে আঁক কষতে-কষতে শেলেটের উপরে আমি একটা পদ্য লিখেছিলুম। তার আরম্ভটা এইরকম—

আজ বড়ো আনন্দ হইয়াছে।
দেখিয়াছি, রান্নাঘরে কই আছে।

অর্থাৎ আমি বলতে চেয়েছিলুম যে, মা যখন কইমাছ রান্না করছেন, তখন দুপুরের ভোজনপর্বটা বেশ জমাট হবে, সুতরাং আজ আমার বড়োই আনন্দের দিন। আনন্দ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হল না; এক জ্যাঠতুতো দাদা এসে চুলের মুঠি ধরে আমাকে শূন্যে তুলে ফেললেন, তারপর বাঁ হাতে আমাকে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখে ডান হাতে একটা চড় কষালেন, তারপর বললেন, “হতচ্ছাড়া, তোমাকে আঁক কষতে দেওয়া হয়েছে, আর তুমি কিনা বসে-বসে কাব্যি করছ? এই আমি বলে রাখলুম, পরে তোমাকে মুদির দোকানের খাতা লিখে পেট চালাতে হবে।”
বাজে কথা। যে-ছেলে আঁক কষতে ভয় পায়, তার পক্ষে মুদির দোকানের খাতা লেখা সম্ভব নয়। চাল-ডাল-গোলমরিচ-জিরে-হলুদ-পাঁচফোড়নের হিসেব রাখা কি চাট্টিখানি ব্যাপার? সে-কাজ সকলে পারে না। তার জন্যে সাফ মাথা চাই। সেই তুলনায় বরং কবিতা লেখা অনেক সহজ। কবিতা লেখবার জন্যে, আর যা-কিছুরই দরকার থাক, মাথাটাকে সাফ রাখবার কোনও দরকার নেই। বরং, সত্যি বলতে কী, মাথার মধ্যে একটু গোলমাল থাকলেই ভালো। কিন্তু না, মাথার প্রসঙ্গ এইখানেই ছেদ টানা যাক, কেন-না বিশুদ্ধ আগমার্কা কবিরা হয়তো এইটুকু শুনেই চোখ রাঙাতে শুরু করেছেন, বাকিটুকু শুনলে তাঁরা আমাকে আস্ত রাখবেন না। তার চাইতে বরং যে-কথা বলছিলুম, তা-ই বলি।
আমার বলবার কথাটা এই যে, অল্প একটু চেষ্টা করলে যে-কেউ কবিতা লিখতে পারে। আমার মাসতুতো ভাইয়ের ছোটছেলেটির কথাই ধরুন। গুণধর ছেলে। টুললিফাই করেছে, পরীক্ষার হলে বোমা ফাটিয়েছে, গার্ডকে ‘জান খেয়ে নেব’ বলে শাসিয়েছে, উপরন্তু চাঁদা তুলে, মাইক বাজিয়ে সরস্বতী পুজো করে বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে তুষ্ট করেছে, তবু—এতরকম কাণ্ড করেও—স্কুল-ফাইনালের পাঁচিলটা সে টপকাতে পারেনি, তিন বার পরীক্ষা দিয়েছিল। তিন বারই ফেল। এখন সে আমাদের হাটবাজার করে দেয়, হরিণঘাটার ডিপো থেকে দুধ আনে, পঞ্চাশ রকমের ফাইফরমাশ খাটে, এখানে-ওখানে ভুল-ইংরেজিতে চাকরির দরখাস্ত পাঠায়, এবং—
এবং কবিতা লেখে। তা সে-ও যদি কবি হতে পারে, তবে আপনি পারবেন না কেন?
আমার গিন্নির খুড়তুতো ভাই এক সওদাগরি আপিসের বড়োবাবু। আগে সে-ও কবিতা লিখত, কিন্তু আপিসে তাই নিয়ে হাসাহাসি হওয়ায় এবং বড়োসাহেব তাকে একদিন চোখ পাকিয়া “হোয়াট্‌’স দিস্‌ আয়া’ম্‌ হিয়ারিং অ্যাবাউট ইউ” বলায়, কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে সে এখন গোয়েন্দা-গল্পের ভক্ত হয়েছে। তার কাছে সেদিন একটা ইংরেজি বই দেখলুম। বইয়ের নামে বুচার্‌ বেকার্‌ মার্ডার মেকার্‌। অর্থ অতি পরিষ্কার। যে-কেউ খুন করতে পারে। নৃশংস কসাইও পারে, আবার নিরীহ রুটিওয়ালাও পারে। খুন করবার জন্যে যে একটা আলাদা রকমের লোক হওয়া চাই, তা নয়।
তুলনাটা হয়তো একটু অস্বস্তিকর হয়ে যাচ্ছে, তবু বলি কবিতার ব্যাপারেও তা-ই। কবিতা লিখবার জন্যে আলাদা রকমের মানুষ হবার দরকার নেই। রামা শ্যামা যদু মধু প্রত্যেকেই (ইচ্ছে করলে এবং কায়দাগুলোকে একটু খেটেখুটে রপ্ত করে নিলে) ছন্দ ঠিক রেখে, লাইনের পর লাইন মিলিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে।
তা জন্যে, বলাই বাহুল্য, কিছু জিনিস চাই, এবং কিছু জিনিস চাই না।
আগে বলি কী কী চাই না—
১) কবি হবার জন্যে লম্বা-লম্বা চুল রাখবার দরকার নেই। ওটা হিপি হবার শর্ত হতে পারে, কিন্তু কবি হবার শর্ত নয়। পরীক্ষা করে দেখে গেছে, চুল খুব ছোটো করে ছেঁটেও কিংবা মাথা একেবারে ন্যাড়া করে ফেলেও কবিতা লেখা যায়। চুলের সঙ্গে বিদ্যুতের সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে, কবিতার নেই।
২) সর্বক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মাটির দিকে তাকিয়েও কবিতা লেখা যায়। সবচাইতে ভালো হয়, যদি অন্য কোনও দিকে না তাকিয়ে শুধু খাতার দিকে চোখ রাখেন।
৩) কখন চাঁদ উঠবে, কিংবা মলয় সমীর বইবে, তার প্রতীক্ষায় থাকবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, অমাবস্যার রাত্রেও কবিতা লেখা যায়, এবং মলয় সমীরের বদলে ফ্যানের হাওয়ায় কবিতা লিখলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না।
৪) ঢোলা-হাতা পাঞ্জাবি পরবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, স্যানডো গেঞ্জি গায়ে দিয়েও, কিংবা একেবারে আদুর গায়েও, কবিতা লেখা সম্ভব।
এইবার বলি, কবিতা লিখতে হলে কী কী চাই।
বিশেষ-কিছু চাই না। দরকার শুধু—
১) কিছু কাগজ (লাইন-টানা হলেও চলে, না-হলেও চলে)।
২) একটি কলম (যে-কোনও শস্তা কলম হলেও চলবে) অথবা একটি পেনসিল এবং–
৩) কিছু সময়।
কিন্তু এতসব কথা আমি বলছি কেন? কবিতার কৌশলগুলিকে সর্বজনের হাতের মুঠোয় এনে না-দিয়ে কি আমার তৃপ্তি নেই? সত্যিই নেই। ইংরেজিতে ‘পোয়্‌ট্রি ফর দি কমন ম্যান’ বলে একটা কথা আছে। আমার ইচ্ছে, কমন ম্যানদেরও আমি পোয়্‌ট বানিয়ে ছাড়ব। পরশুরামের কথা মনে পড়ছে। তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল, পৃথিবীকে একেবারে নিঃক্ষত্রিয় করে ছাড়বেন। কিন্ত, না-পারবার হেতুটা যা-ই হোক, কাজটা তিনি পারতে-পারতেও পারেননি। বিশ্বসংসারকে যাঁরা নিষ্কবি করে ছাড়তে চান (অনেকেই চান), তাঁরাও সম্ভবত শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবেন না।
আমার প্রতিজ্ঞাটা অন্য রকমের। আমি ঠিক করেছি, বাংলা দেশে সব্বাইকে আমি কবি বানাব। দেখি পারি কি না।
কবিতা লিখবার জন্যে কী কী চাই, তা তো একটু আগেই বলেছি। চাই কাগজ, চাই কলম (কিংবা পেনসিল), চাই সময়। তা আশা করি কাগজ-কলম আপনারা জোগাড় করতে পেরেছেন। বাকি রইল সময়। তা-ও নিশ্চয়ই আপনাদের আছে। রেশনের দোকানে লাইন না-লাগিয়ে, এই যে আপনারা গুটিগুটি ‘কবিতার ক্লাস’-এ এসে হাজির হয়েছেন, এতেই বুঝতে পারছি যে, সময়ের বিশেষ অভাব আপনাদের নেই।
সুতরাং ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে শুরু করা যাক। অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু।
আগেই বলি, কবিতার মধ্যে তিনটি জিনিস থাকা চাই। কাব্যগুণ, ছন্দ, মিল।
বিনা ডিমে যেমন ওমলেট হয় না, তেমনই কাব্যগুণ না থাকলে কবিতা হয় না। তার প্রমাণ হিসেবে আসুন, আমার সেই মাসতুতো ভাইয়ের ছোটোছেলের লেখা চারটে লাইন শোনাই:

সূর্য ব্যাটা বুর্জোয়া যে,
দুর্যোধনের ভাই।
গর্জনে তার তুর্য বাজে,
তর্জনে ভয় পাই।

 বলা বাহুল্য, এটা কবিতা হয়নি। তার কারণ, ছন্দ আর মিলের দিকটা ঠিকঠাক আছে বটে, কিন্তু কাব্যগুণ এখানে আদপেই নেই। এবং কাব্যগুণ না-থাকায় দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা নেহাতই বাক্যের ব্যায়াম হয়ে উঠেছে।
এবারে মিলের কথায় আসা যাক। মিল না-রেখে যে কবিতা লেখা যায় না, তা অবশ্য নয়, তবু যে আমি মিলের উপর এত জোর দিচ্ছি তার কারণ:
১) প্রথমেই যদি আপনি মিল-ছাড়া কবিতা লিখতে শুরু করেন, তাহলে অনেকেই সন্দেহ করবে যে, মিল-এ সুবিধে হয়নি বলেই আপনি অ-মিলের লাইনে এসেছেন। সেটা খুব অপমানের ব্যাপার।
২) মিল জিনিসটাকে প্রথম অবস্থায় বেশ ভালো করে দখল করা চাই। তবেই সেটাকে ছেড়ে দিয়েও পরে ভালো কবিতা লেখা সম্ভব হবে। যেমন বড়ো-বড়ো লিখিয়েদের মধ্যে অনেকেই অনেকসময়ে ব্যাকরণের গণ্ডির বাইরে পা বাড়িয়ে চমৎকার লেখেন, এ-ও ঠিক তেমনই। ব্যাকরণ বস্তুটাকে প্রথমে বেশ ভালো করে মান্য করা চাই, তবেই পরে সেটাকে দরকারমতো অমান্য করা যায়। ঠিক তেমনি, পরে যাতে মিলের বেড়া ভাঙা সহজ হয়, তারই জন্যে প্রথম দিকে মিলটাকে বেশ আচ্ছা করে রপ্ত করতে হবে।
ছন্দ কিন্তু সবসময়ই চাই। আগেও চাই, পরেও চাই। আসলে আমার ক্লাসে আমি ছন্দের কথাই বলব। সেই বিচারে ‘কবিতার ক্লাস’ না-বলে একে ‘ছন্দের ক্লাস’ও বলা যেতে পারত। তাতে কিছু ক্ষতি ছিল না।

Saturday, June 13, 2015

দুঃখী রবীন্দ্রনাথ

ইংরাজী ১৮৬১ সালের ৭ইং মে তারিখে রবীন্দ্রনাথঠাকুরের জন্ম হয়। বাংলায় ঠিকুজী করতে গেলে তা দাঁড়ায় ১২৬৮ সালের পঁচিশে বৈশাখ, ভোর তিনটে নাগাত। আঁতুড়ঘর ঠাকুর পরিবারের জমিদারবাড়ী, মুলতঃ বাঙ্গালী অধ্যুষিত উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলের, ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের দালানকোঠা। দালান কোঠা হলেও সে সময় এলাকাটা তেমন “ভাল” ছিল না। পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরহিন্দু ব্রাম্ভণ ছিলেন, আদত পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়। ইংরেজরা কলকাতাকে “ক্যালকাটা”, যমুনাকে “জাম্‌না” করার মত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যানার্জি বানিয়েছিল। তবু ভাল। আমেরিকানদের পাল্লায় পড়লে এটাকে “ব্যান্ডোপেডায়ে” বানিয়ে ছাড়ত। ব্রাম্ভণদের লোকে “ঠাকুর মশায়” বলে সম্বোধন করতো। মশায়ের লেজ ছেড়ে সেই ঠাকুরটাই ক্রমশঃ স্থায়ীহয়ে গেল। ইংরেজরা আবার একে মডিফাই করে টেগোর বানিয়ে দেয়। তাও সই। জাপানীরা হলে আবার “তাগোরে” বানিয়ে ছাড়ত। রবীন্দ্রনাথের পিতামাতা ছিলেন যথাক্রমে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদা দেবী। মানুষটা ভাল এবং হীত কাজের জন্য তিনি “মহর্ষি” খেতাব পেয়েছিলেন। এই ঠাকুর পরিবারের আদত বসত ছিল আবার যশোর খুলনা অঞ্চলে। জমিদারীও। দেবেন্দ্রনাথ বাবুখুলনার বাগেরহাটের শাষক ও সুফি সাধক খান জাহান আলী দ্বারা প্রভাবান্বিত হন।অনেকের মতে তিনি ভাবশিষ্য ছিলেন। সেজন্য তাঁদেরকে “পিরালী ব্রাম্ভণ” বলা হতো।উদার মনের দেবেন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মের সংস্কারক ও ব্রাম্ভধর্মের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়ের মতবাদে আকৃষ্ট হোন ও তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে পড়েন। রাম মোহনের হাত ধরেই তিনি ব্রাম্ভ ধর্মে দীক্ষা নেন এবং এই ধর্মের প্রচার ও প্রসারে সম্পুর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন। মৃত্যুর আগ পর্য্যন্ত তিনি “আদি ব্রাম্ভ সমাজ”এর প্রধানপৃষ্ঠপোষক ছিলেন।রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ একজন কবি ও দার্শনিক ছিলেন। তাঁর আর একভাই সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রথম ভারতীয় আই,সি,এস - যিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের মেম্বার হিসাবে একান্ত সাদা চামড়া সর্বস্বলীগে যোগ দেবার পারদর্শিতা দেখাতে পেরেছিলেন। আর এক ভাই, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একজন প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার ও নাট্যকার ছিলেন। বোনদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী দেবী একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ সুসাহিত্যিক হয়েছিলেন।রবি যখন জন্মান, তখন বাবা দেবেন্দ্রনাথের বয়স ৪৫। বড় চার ভাইয়ের বয়সের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রনাথের ২১, সত্যেন্দ্রনাথের ১৯, হেমেন্দ্রনাথের ১৭ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ১৩ বছর।


রবীন্দ্রনাথ শুধু যে বয়ষে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তাই নয়, তফাৎটা এত বেশী ছিল যে,পিঠোপিঠি ভাইবোনদের সঙ্গে খেলাধুলা, গালগল্প, হাসিকান্না, মারপিট, ধাক্কাধাক্কি করে ছেলেবেলার যে মধুর দিনগুলি কাটে, যেটা প্রায় সবার ভাগ্যেই জোটে এবং যা আপাতদৃষ্টিতে অতি স্বাভাবিক, তা রবীন্দ্রনাথের ভাগ্যে জোটেনি।তারা যেন ভাইবোনের বদলে এক একটা গার্জেন, অভিভাবক। এই মরুভুমির মধ্যে একমাত্র মরূদ্যান ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী, কাদম্বরী দেবী। তিনিরবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে অল্প একটু বড় ছিলেন। প্রায় সমবয়সী বলে তিনি খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনে অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।সেইবৌদির অকস্মাৎ আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ রবীন্দ্রনাথের নিঃসংগ জীবনটা পুনরায় মরুময় করে তুলেছিল এবং তাঁর মানসিকতা ও ভবিষ্যত সাহিত্যকর্মের উপর গভীর দাগ ফেলেছিল।জীবনের প্রথম দশ বছরের বেশী নিঃসংগতা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের ঐ সময়টা বেশ খারাপ ভাবেও কাটে। প্রথমতঃ বাড়িতে প্রচুর লোকজন, অতিথিদের হরহামেশ আনাগোণা, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে দৈনিক লোকসংখ্যা ১০০ থেকে ২০০ জন হয়ে যেত। সংসার ও অতিথি সামলাতে মা হিমশিম খেয়ে যেতেন।সব সময় এত ব্যস্ত থাকতেন যে ছেলে মেয়েদের পিছনে কোন সময় দিতে পারতেন না। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথেরমায়ের আদরযত্ন পাবার তেমন সৌভাগ্য হয়নি। উপরন্তু বাবা অনেকটা সন্যাস গ্রহণের মতো কাজে অকাজে প্রায় সময় বাইরে বাইরে থাকতেন – উত্তর ভারত, ইংল্যান্ড বা অন্য কোথাও। অগত্যা রবিকে বাধ্য হয়ে চাকর বাকরদের হাতে মানুষ হতে হয়েছিল। গার্জেনদের কড়া নজর না থাকলে চাকর বাকরদের যা হয়। চাকররা এক একজন মাস্তান হয়ে শাসন করত। রামায়ণের সীতার মতো রবীন্দ্রনাথের চতুর্দিকে একটা গন্ডী কেটে দিয়ে বলত, “খবরদার, কেবল স্কুলে যাওয়া ছাড়া এই গন্ডীর বাইরে বেরিয়েছ কি আর রক্ষা নেই”। গোলমাল করলে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ভাইবোনদের হরেক কিসিমের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। ভয় দেখানোর জন্য তারা রক্ত খেকো রাক্ষস, কন্ঠকাটা ভুত, ভয়াবহ দস্যু, ডাকাত আরও কত কিছুর গল্প করত।অনেক সময় বাচ্ছাদের খাবার দাবার তারা নিজেরাই খেয়ে ফেলত। চাকরদের খুশি করার জন্য খাবারে রুচী নেই বলে রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় না খেয়ে থাকতেন।সব মিলিয়ে এই বদ্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের মন সদাই ছটফট করত। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথকে শারিরীক ও মানসিক দিক থেকে তৈরী করানোর জন্য বেশ আঁটসাট একটা নীতিমালা তৈরী হয় ও তার প্রয়োগ প্রণালীরও একটা তালিকা প্রস্তুত করা হয়। তাঁর গৃহশিক্ষা শুরু হয় দাদা হেমেন্দ্রনাথের কাছে। শারিরীক দিক ঠিক করতে সাঁতার, উঁচু এলাকায় হাঁটা, জুডো ও কুস্তি এবং মানসিক দিকের উন্নতির জন্য শরীরবিদ্যা, ছবি আঁকা, ইংরেজী, ভুগোল, ইতিহাস, অঙ্ক, সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যের উপর পড়াশুনো শুরু হয়। এগুলো হতো স্কুলে যাবার আগেও পরে।এত চাপের মধ্যে তখন থেকেই রুটিন মাফিক স্কুলের শিক্ষাপ্রণালীর ঊপর তাঁর বিতৃষ্ণা শুরু হতে থাকে।


পিরালী ব্রাম্ভণরা ছিল গোত্র হিসেবে বেশ ছোট এবং রক্ষণশীল। বাংলার অন্যান্য ব্রাম্ভণদের সঙ্গে সামাজিকভাবে ওঠাবসা অনেকটা সীমিত ছিল। কিন্তু বিয়ে সাদীর ব্যাপারটা ছিল একেবারে নো নো। অনেকটা বৃহত্তর খ্রীষ্টান সমাজের সঙ্গে “জেহোভাস উইটনেস” অনুসরণকারী খ্রীষ্টানদের মত। তাই পিরালী ব্রাম্ভণরা সাধারণতঃ বিয়ে শাদীগুলো তাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতেন। কিন্তু গোত্রটি ছোট হওয়ায় উপযুক্ত বয়সের পাত্র পাত্রী মেলানো প্রায়শই দূরুহ হয়ে পড়ত। তাইরবীন্দ্রনাথের যখন বিয়ে হয়, তাঁর বয়স ২২ বছর ৭ মাস হোলেও তাঁর স্ত্রী ফুলি ওরফে ভবতারিনী দেবীর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর ৯ মাস। ভবতারিনীর জন্ম ১৮৭৩ সালে খুলনার দক্ষিণ ডিহির ফুলতলি নামে এক গন্ডগ্রামে। ভবতারিনী দেবীর বাবা, বেণীমাধব রায়চৌধুরী ঠাকুরদেরজমিদারীতে সামান্য বেতনের চাকুরী করতেন। ভবতারিনী নামটা অনেকটা সেকেলে শোনায় বলে রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা নামটা পাল্টিয়ে মৃণলিনী দেবী নাম দেন। আর বিয়েটা কন্যার দুঃস্থ পিতার গ্রামের বাড়ীতে না হয়ে সংঘটিত হয়েছিলজোড়াসাঁকোর বিশাল ঠাকুর বাড়ীতে৯ ইং ডিসেম্বর, ১৮৮৩ সালে। কিন্তু বিয়ের দিন রবীন্দ্রনাথের পিতা, মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ও বড়বোন সৌদামিনি দেবী বিয়ে বাড়িতে ছিলেন না। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, সৌদামিনি দেবীর ঘরজামাই স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় এই বিয়ের দিনেইজোড়াসাঁকোয় নিজের শ্বশুরবাড়ীতে মারা যান।শহুরে জমিদার, সম্ভ্রান্ত ঠাকুর বাড়ীর উজ্জ্বলতম সদস্য, এক সৌম্যকান্তি, বিলেত ফেরত, ২২ বছরের এক আকর্ষণীয় যুবক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায় কপর্দকহীন, অজ পাড়াগাঁয়ের এক পরিবারের প্রায় নাবালিকা, প্রায় অশিক্ষিতা ১৩ বছরের ছোট এক কিশোরীকে কেন বিয়ে করতে হয়েছিল কে জানে? সেটা কি কেবল পিরালী ব্রাম্ভণদের সঙ্গে কলকাতার তথাকথিত “ভদ্র সমাজের” অমিলের ফসল? এই নিরাড়ম্বর আয়োজন ও খোদ বিয়েটা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বেশ আক্ষেপ ছিল বলে শোনা যায়। বিয়ের কার্ডের খামের এককোণে ছাপিয়েছিলেন মধুসূদন দত্তের কবিতার এক লাইন,”আশার ছলনে ভুলি, কি ফল লভিনু হায়”।


বিয়ের ব্যাপারে ভবতারিনী দেবীর শুধু নামটাই পালটানো হয়নি বা বিয়েটা মানানসই জায়গায় সম্পন্ন হবার ব্যবস্থা করেই শেষ হয়নি, ঠাকুরবাড়ীরবধু হিসেবে পরিগণিত হবার জন্য তাঁকে রীতিমত লেখাপড়াশেখাবার ব্যবস্থা হয়েছিল। এর প্রধান উদ্দ্যোক্তা ছিলেন আই,সি,এসসত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী,জ্ঞানদা নন্দিনী দেবী। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কাশ্মিরের পাহাড়ে অবস্থানরত অবস্থায় বৌমাকে যেন লরেটো স্কুলে ভর্তি করা হয়, মাইনে এবং পোশাক আশাকের খরচ বাবদ জমিদারী থেকে মাসিক ১৫ টাকা ভাতা বরাদ্দ করে ছেলেকে চিঠি পাঠালেন। রবীন্দ্রনাথ নিজের উদ্দোগেও স্ত্রীর ইংরেজী শিক্ষার জন্য একজন মেম সাহেব ও সংস্কৃত শিক্ষার জন্য পন্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নকে নিয়োগ করেছিলেন। পাঠশালা শেষ করা মৃণালীনি দেবী এই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশুনা করে তিনি একজন সংবেদনশীল মানুষ ও সংস্কৃতিমনা লেখিকা হয়ে উঠেছিলেন। মুল সংস্কৃত থেকে তিনি প্রায় সমগ্র রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করে এনেছিলেন। মহাভারতের শান্তি পর্বের অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ করার সুযোগ পাননি। বয়সের অধিক তারতম্য, সামাজিক নিদারুণ অসমতা এবং অন্যান্য অলিখিত গভীর ব্যবধানের জন্য মৃণালিণী দেবী রবীন্দ্রনাথের কেবল “ওয়াইফ”ই হতে পেরেছিলেন। কবি নিজের মনের কষ্টে তাঁকে কখনো প্রকৃত “স্ত্রী”র মর্য্যাদা দিয়ে মনের মধ্যে বসাতে পারেন নি। এর উপর বিয়ের মাত্র ৪ মাসের মাথায় কবির প্রেরণাদায়িনী বৌঠান কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করে বসেন। কবির তখন দিগবিদিকজ্ঞ্যানশূন্য অবস্থা।


বিয়ের পর মাত্র ৮ বছরের মধ্যে মৃণালিনী দেবী পর পর পাঁচ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি প্রথম সন্তান পেটে ধারণ করেন। এক সন্তানের পর শরীর ঠিক হয়ে ওঠার আগে বার বার সন্তান ধারণের জন্য মৃণালিনী দেবী শারিরীক ও মানসিক দিক থেকে পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন না। ১৯০১ সালে মাত্র ৫ জন ছাত্র নিয়ে রবীন্দ্রানাথ শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের সূচনা করেন। এই ৫ জনের ২ জন হল তাঁর নিজের দুই পুত্র, রথীন্দ্রনাথ ও শমীন্দ্রনাথ। বয়সে তারা নিতান্তই শিশু। জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বসবাসের পূর্বে ১৯০১ সালের ১৫ইং জুন ও ৫ইং আগষ্টকবি তাঁর দুই কিশোরী কন্যা, ১৪ বছরের মাধুরীলতা ও ১০ বছরের রেণুকাকে বিয়ে দিয়ে দেন। নিজের অল্পবয়সে বিবাহ ও তার ফলের কথা চিন্তা করে মৃণালিনী দেবী বিয়েতে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা রবীন্দ্রনাথের সে কথায় কান দেবার সময় ছিল না। শান্তিনিকেতন চালানোর প্রথম দিকে কবিকে নিরারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে পড়তে হয়। মৃণালিনী দেবী নিজের হাতের বালা খুলে দিয়েছিলেন এবং ঐ অসুস্থ শরীর নিয়ে তাঁকে শান্তনিকেতনের সব রান্না করতে হত। এভাবে তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভালোমত চিকিৎসা করানোর পয়সাও ছিল না। শেষে ১৯০২ সালে অসুস্থ মৃণালিনী দেবীকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আনা হয়। কিন্তু ডাক্তাররা নাকি প্রকৃত রোগ ধরতে ব্যর্থ হয়।  দিনে দিনে তাঁর শরীর খারাপের দিকে যেতে থাকে। তিনমাস ভোগান্তির পর শেষ পর্য্যন্ত ১৯০২ সালের ২৩ শে নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ২৯ বছর।  আর রবীন্দ্রনাথের তখন চলছিল ৪১ বছর ৬ মাস।পুত্র রথীন্দ্রনাথের অনুমান তার মা অ্যাপেন্ডাসাইটস-এ মারা গেছেন।কিন্তু অন্য খবর অনুযায়ী তিনি ষষ্ঠ্য সন্তান নিয়ে অন্তঃস্বত্তা ছিলেন এবং ঐ অবস্থায় এক বাড়ীতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যান। যাই হোক মৃণালিনী দেবীর তিল তিল করে মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি অবহেলা করার জন্য মনে মনে খুবই অনুতপ্ত হোনএবং স্ত্রীর অভাব দারুণভাবে অনুভব করতে থাকেন, অনেকটা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্য্যাদা না বোঝার মতো। তাই তিনি লিখেছেন, “আমি না হয় অন্ধ ছিলুম, তুমি কেন জোর করে কেড়ে নিলে না যা তোমার সত্যিকারের প্রাপ্য ছিল। সময় হলে কেন রাজার মত জানিয়ে দাওনি তোমার প্রবলতম সেই দাবী। ভেঙ্গে ফেললে না কেন ঘরের চাবি। আজ যে সেই মিথ্যার বোঝা আমার সার্থকতার পথ বন্ধ করে দিল”।


মৃনালিনী দেবীদের মোট পাঁচটি সন্তানের মধ্যে ছিল তিন কন্যা ও দুই পুত্র। এদের মধ্যে তিনজন রবীন্দ্রনাথের ৫৭ বছর পার হবার আগেই মারা যায়। বড়মেয়ে মাধুরীলতার ডাকনাম ছিল বেলা বাবেলী। বিয়ে হয়েছিল কবি বিহারীলাল চক্রবর্তির তৃতীয় পুত্র, পেশায় উকিল, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তির সঙ্গে। তিনি স্বামীর কলকাতার বাড়িতেমাত্র ৩১ বছর বয়সে যক্ষারোগে মারা যান ১৬ মে, ১৯১৮ ইং ।


পরেরটি ছিল পুত্রসন্তান- বড়ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রথীর জন্ম হয় ১৮৮৮ সালের ২৭ শে নভেম্বর এবং ২১ বছর বয়সে বিয়ে হয় ১৭ বছরের প্রতিমা দেবীর সঙ্গে , ১৯১০ সালের ২৭ শে জানু্যারীতে। প্রতিমা দেবী গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের ভাগ্নী, বোন বিনয়ীনি দেবীর কন্যা। তার আগে একটা বিয়ে হয়েছিলকিন্তু স্বামী নীলনাথ মুখ্যোপাধ্যায় মারা যাওয়ায় বিধবা হয়ে পড়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথ ও প্রতীমা দেবীর বিয়েটাই ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিবাহ।এঁদের কোন সন্তানাদি হচ্ছিল না। তাই নন্দিনী নামে এক কন্যাকে তাঁরা দত্তক নেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর একসময় তাঁরা আলাদা হয়ে যান। রথীন্দ্রনাথ ১৯৫১ সালের ১৪ ইং মে থেকে ১৯৫৩ সালের ২২ শে আগষ্ট পর্য্যন্ত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য ছিলেন। ১৯৬১ সালের ৩ রা জুন দেরাদুনে ৭২ বছর ৬ মাস বয়সে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। প্রতীমা দেবী আরো কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে প্রায় ৭৬ বছর বয়সে মারা যান।


রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় সন্তান ( দ্বিতীয় মেয়ে) , রেনুকা দেবী বা রাণী-র জন্ম হয় ১৮৯১ সালের ২৩ শে জানুয়ারী। বড়বোন মাধুরীলতার বিয়েরদেড় মাসের মধ্যেই ১৯০১ সালে রাণীর বিয়ে হয় সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্যের সাথে। তার বয়স ছিল তখন মাত্র১০ বছর ৬ মাস। তিনিও মাত্র ১২ বছর ৭ মাস বয়সে যক্ষারোগে মারা যান। রেনুকাও কোন সন্তান সন্ততি রেখে যেতে পারেন নি।


চতুর্থ সন্তান (ছোটমেয়ে)মীরা দেবী, ডাকনাম অতসী-র জন্ম হয় ১৮৯৪ সালের ১২ ইং জানুয়ারী। অতসীর যখন নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৯০৭ সালের ৬ ইং জুনে, তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর ৪ মাস। আরও তের বছর ঘর সংসার করার পর ১৯২০ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়। মীরা দেবী অনেক পরে ১৯৬৯ সালে যখন শান্তিনিকেতনে মারা যান, তখন তার বয়স প্রায় ৭৫ বছর। মীরা দেবীদের দুজন সন্তান ছিল। ছেলে নীতিন্দ্রনাথ ডাক নাম নীতু ও মেয়ে নন্দিতা, ডাকনাম বুড়ি। এই নীতুর জন্ম হয় ১৯১২ সালে। উচ্চশিখ্যার্থে জার্মাণীতে থাকা কালীন যক্ষারোগে ১৯৩২ সালের ৭ইং আগষ্ট,মাত্র ২০ বছর বয়সে মারা যান। তখনও তাঁর বিয়ে শাদী হয়নি। এদিকে রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৭১ বছর চলছে। মীরা দেবীদের একমাত্র কন্যা, নন্দিতা দেবী, বুড়ির জন্ম হয় ১৯১৬ সালে ও বিয়ে হয়কৃষ্ণ কৃপালনির সঙ্গে। তিনি কৃপালনি সাহেবের আগেই ১৯৬৭ সালে ৫১ বছর বয়েসে মৃত্যুবরণ করেন। নন্দিতাদেরও কোন সন্তানাদি হয়নি।


পঞ্চম সন্তান ( দ্বিতীয় পুত্র) সমীন্দ্রনাথ, ডাকনাম সমী-র জন্ম হয় ১৮৯৬ সালের ১২ ইং ডিসেম্বর।মীরা দেবীর বিয়ের মাত্র ছ’মাসের মধ্যেই, যখন তিনি বিহার প্রদেশের মুঙ্গেরে এক বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে যান, সেখানে হঠাৎকলেরায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ১০ বছর এগার মাসের মাথায় মারা পড়েন। তারিখটা ছিল ১৯০৭ সালের ২৩ শে নভেম্বর। পাঁচ বছর আগে ঠিক এই দিনটীতে তিনি মা মৃণালিনী দেবীকে হারিয়েছিলেন।


দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকা অবস্থায় তাঁর সবচেয়ে প্রিয়জনদের ইহজগত থেকে একে একে বিদায় নেবার পালা গুলো নিজের চোখে দেখে যেতে হয়েছে। তাঁর এত বড় বিরাট সংসারের রক্তের সম্পর্কের উত্তরাধীকারি বলতে আর কেউ বেঁচে নেই। বাকী থাকছে ঠাকুর বাড়ীর সঙ্গে আলগা সম্পর্কের, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতীমা দেবীর দত্তক নেওয়া সেই মেয়েটি, যার নাম নন্দিনী ঠাকুর। নন্দিনীর জন্ম হয়েছিল ১৯২২ সালে এবং তাঁর বিয়ে হয় ১৯৩৯সালের ৩০শে জানুয়ারী, গুজরাট থেকে আগত শান্তিনিকেতন হাসপাতালের ডেন্টিস্ট ডাঃ গিরিধারী লালার সঙ্গে। তাঁদের সন্তানের জন্ম হয় কলকাতায়, ১৯৫৩ সালে, নাম সুনন্দন লালা। সুনন্দন এখন “প্র্যাক্সএয়ার” নামে এক বিখ্যাত এক গ্যাস কোম্পানীতে কাজ করছেন ব্যাঙ্গালোরে। তাঁর স্ত্রী শমিতা রবীন্দ্রসঙ্গীত গান।  সুনন্দনদের দুই ছেলে। বড়টী বৌ নিয়ে এখন আমেরিকার আটলান্টায় থাকে। ছোটটী আইনজীবি, থাকে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে।  

Thursday, June 11, 2015

আধুনিক বাঙলা কবিতা // মাহবুব মুহম্মদ

এক বাঙলা কবিতায় আধুনিকতা বিষয়টি কী তা নিয়ে অনেকদিন থেকে আলোচনা চলছে। সঙ্গে চলছে এর অন্তর্নিহিত ভাব কিংবা নির্যাস বের করার নানান চেষ্টা। যে দীর্ঘ কাল-পরিক্রমা নিয়ে আধুনিকতাকে নির্ণয় করতে হয়, বলতে গেলে সাহিত্যে সেই আধুনিকতা হঠাৎ করেই হাজির হয় নি। আর সাহিত্যের ধারাবাহিক গতি-প্রকৃতি একে বিস্তৃতি ঘটিয়েছে কবিতায়ও। ফরাসি বিপ্লব থেকে যে ইউরোপীয় আধুনিকতার জন্ম; সাহিত্যের প্রবাহিত ধারাবাহিকতায় সেটি প্রভাব বিস্তার করেছে ধীরগতিতেই। এর সঙ্গে কাজ করেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ নানান পরিবর্তন। তবে বাঙলা সাহিত্যে আধুনিকতা নামক ধারণা’র হাওয়া লেগেছে অনেক পরে; ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। আর কবিতায় এসেছে আরও পরে, বলতে গেলে বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে। কিন্তু বাঙালির আধুনিকতার রুদ্ধ ধারাটি মুক্ত করার প্রথম মানস-প্রতিভা ধারণ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝিতেই। আর রবীন্দ্রনাথ এসে সে মুক্ত প্রতিভাকে দিয়েছিলেন তীব্র স্রোত। তবে মাইকেল কিংবা রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় সেই আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছিলেন ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের ক্ষুদ্র বলয় থেকে বেরিয়ে বাঙলা কবিতা তখনও আধুনিকতাকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করেনি। আর তাই মাইকেল থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কবিতা ছিল পরবর্তী তিরিশের দশক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শব্দগঠন, ভাষার শৈলী-বৈচিত্র্য, চিত্রকল্পের অনুভূতি প্রকাশের বিষয়ও ছিল আলাদা। বলতে গেলে মাইকেল থেকে রবীন্দ্র(রবীন্দ্রনাথের পুরো কাল নয়; ১৮৬১-১৯০০ খৃষ্টাব্দ) সময় পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্যের জন্য ছিল আধুনিকতার প্রস্তুতিকাল। এই সময়েই আধুনিকতা প্রস্তুত হচ্ছিল তিরিশের জন্য। তিরিশের দশকের কবিদের হাতেই বাঙলা কবিতা ইউরোপীয় আধুনিকতাকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে। এর পূর্বের কবিরা আধুনিকতাকে ধারণ করেছিলেন বিচ্ছিন্নভাবে। বিচিত্র প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমও ছিল প্রায় সম্পর্কশূন্য। কিন্তু তিরিশের দশকের কবিরাই প্রথম আধুনিকতাকে ব্যক্তির উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। কবিতায় গ্রহণ করেছিলেন সমগ্রতাকে। কোন এক নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তাদের ভাব-উপলব্ধি আবদ্ধ থাকেনি। সবকিছুকে ধারণ করেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিন্তু প্রকাশ করেছিলেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। আর প্রত্যহ-জীবনের নানান উপলব্ধিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করারই ছিল বিংশ শতকের আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে প্রকাশ-রীতির মধ্যেই যে আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছিল পরিপূর্ণরূপে তা নয়, বরং এর অন্তনিহিত ভাবও ছিল কবির একান্ত নিজস্ব বিষয়। উদাহরণ তিরিশের কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকেই দেই- আমি সব দেবতারে ছেড়ে/ আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি/বলি আমি এই হৃদয়েরে;/সে কেন জলের মত ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়।......পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ/ চায় না সে?-করেছে শপথ/ দেখিবে সে মানুষের মুখ?/ দেখিবে সে মানুষীর মুখ?/দেখিবে সে শিশুদের মুখ?/চোখে কালোশিরার অসুখ/কানে যেই বধিরতা আছে? (বোধ; জীবনানন্দ দাশ) ব্যক্তি যে নিজের মধ্যেও স্বতন্ত্র, সেই পৃথক নিজস্ব ভাবনা ও সত্ত্বাকে খোঁজে বেড়ানোই হলো আধুনিকতা। আর এই আধুনিকতায় দেবতা থেকে যেন ব্যক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। দুই প্রাচীন কিংবা মধ্যযুগের সাহিত্যে বেদনাবিদ্ধ উপলব্ধির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটলেও চিত্রকল্প অনুভূতির প্রকাশ এতোটা জোরালো ছিল না যতোটা আধুনিক কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। বলতে গেলে, উপলব্ধিকে নিজস্ব ভঙ্গিমায় প্রকাশ বা চিত্রকল্পের অনুভূতিই আধুনিক কবিতাকে আলাদা করেছে প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যের সীমারেখা থেকে। তবে মধ্য বা প্রাচীন সাহিত্যে চিত্রকল্পের অনুভূতি বা অভিজ্ঞতার জোরালো প্রকাশ যে একেবারেই ঘটে নি মোটাভাবে তা বলা যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই এটি প্রকাশ পেয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে; অনেকটা আধুনিকতার মতো। তবে শৈল্পিকতার স্বতঃস্ফুর্ততা আর একজন কবি মনের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনার প্রকাশ কিন্তু এক নয়। দুটি ভিন্ন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এর অভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ হিশেবে বৈষ্ণব পদাবলীর কথা বলা যেতে পারে। ধর্মকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগের এই পদাবলী রচিত হলেও ভাষার শৈলী-বৈচিত্র্য, অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশই এটাকে আধুনিকতায় নিয়ে গেছে। উদাহরণ দেই- সখি কেমনে ভুলিব হিয়া/ আমারই বধূআ আন বাড়ি যায়/ আমারই আঙিনা দিয়া। (বিদ্যাপতি) আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য যদি হয়ে থাকে শৈল্পিক ভাবনা আর চিত্রকল্প অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, তবে বৈষ্ণব পদাবলীর অনেক পদেই আধুনিকতার প্রভাব লক্ষণীয়। কিন্তু মধ্যযুগের সাহিত্য বলেই কি কেবল পদাবলীকে আধুনিক হওয়া থেকে অস্বীকার করছি আমরা? অবশ্যই না! প্রথমেই বলেছি, আধুনিকতা কখনও কোন কিছুকে বিচ্ছিন্নভাবে গ্রহণ করে না। সমগ্রকে নিয়েই তার অবস্থান। বৈষ্ণব পদাবলীতে একদিকে যেমন প্রকাশ পেয়েছে জীবন-উপলব্ধির একচ্ছত্র ভাবনা-চিত্রের স্বতঃস্ফূর্ততা, অন্যদিকে পেয়েছে এর ধর্মীয় তত্ত্বকথা। অর্থাৎ বৈষ্ণব পদাবলীতে শৈল্পিকতার স্বতঃস্ফূর্ততা ঘটলেও কবির মানস-প্রকৃতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে ছিল ধর্ম-চেতনা। ধর্মকে উদ্দেশ্য করেই বৈষ্ণব পদাবলী রচিত। তাই বৈষ্ণব পদাবলীর আঙ্গিকগত দিক আধুনিক হলেও এর বিষয়বস্তু ছিল সম্পূর্ণ ধর্মাশ্রিত। তিন আধুনিক কবিতা বলতে অনেকেই গদ্যছন্দকে বুঝে থাকেন। আবার অনেকে মনে করেন, আধুনিকতা নামক নির্মম ধারা কবিতাকে তার মৌলিক আদর্শ থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে গেছে। কিন্তু এ ধারণা অনেকাংশেই ঠিক নয়। আধুনিক কবিতা সময়ের ব্যবধানে আর সাহিত্যের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একটি নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করে নিলেও তার মৌলিকতার বিচ্যুতি হয়েছে; এমন ধারণা মনে করার কোন কারণ নেই। বিশেষ করে, কবিতার অনুভূতি বা চিন্তাস্পর্শের কোন মৌলিকতাই আধুনিক কবিতার কোন মৌলিক বিষয়কে ম্লান করেনি। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক যুগের কবিতাই যেমন একটি ধারা সৃষ্টি করে নেয়, সে দৃষ্টি আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই বাঙলা কবিতা-সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্র সময় পর্যন্ত যে-কবিতা ছিল প্রতিনিধিত্বমূলক; তিরিশের আধুনিক কবিদের হাতে এসে হয়ে গেল সেটি সম্পূর্ণ ব্যক্তি চিত্তের অনুভূতি প্রকাশ। যার ফলে আধুনিক কবিতা হয়ে উঠলো আধুনিক কবিদের ব্যক্তি উপলব্ধির লীলা-চৈতন্যের সহচর। তবে এটাও ঠিক যে আধুনিক কবিতা সকল মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না, একটি নির্জন একান্ত উপলব্ধি-প্রতীক হয়ে ওঠে আধুনিক কবিতা। চার ব্যক্তি হৃদয়ের ভাবের দ্যোতনা, চিন্তা বা অন্তর-অনুভূতির কথাগুলো যখন একটি নির্দিষ্ট শৈল্পিকতার মধ্যদিয়ে প্রকাশিত হয় তখনই তা হয়ে ওঠে আধুনিক কবিতা। তবে বিশেষ করে, কবিতা বা গদ্য সাহিত্যের বেলায় আধুনিকতা বিষয়টি তার পূর্ববর্তী রচনার ওপর কিছুটা হলেও নির্ভর করে। এক্ষেত্রে, সাহিত্যের যে দীর্ঘ ইতিহাস কালের স্রোতে প্রবাহিত, সে বহমান ধারায় কবিতা কতটুকু আধুনিক তার একটি তুলনামূলক প্রশ্ন রয়েই যায়। তাই সময়ের ব্যবধানে আধুনিকতার বিষয়টি তার সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে। একে রুখা যায় না। সম্ভবও নয়। তার আপন ধারায় মধ্যদিয়ে সে প্রবাহিত হয়। একমাত্র আধুনিক কবিতায় একজন কবি পারেন তার মনের চিরচেনা সাধারণ কথাগুলোকে এক উচ্চমার্গীয় শৈল্পিক প্রতিভার দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ ঘটাতে। আর 'শৈল্পিকতার স্বতঃস্ফূর্ত' প্রকাশই আধুনিক কবিতাকে মধ্য বা প্রাচীন যুগের কবিতা থেকে করেছে ভিন্ন। যার ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি তার ধারাবাহিক শিল্প-উপলব্ধি’র বিকাশ ঘটিয়েছে কবিতায়, বীজ বপন করেছে সংস্কৃতি মননের। তবে জ্ঞান,বুদ্ধি বা চিন্তার আশ্রয়ই কেবল শিল্পের প্রকাশ নয় বরং শিল্পের স্পর্শে এসেই জ্ঞানের স্ফুরণ আর বুদ্ধির তীক্ষ্ণ প্রকাশ ঘটেছে আধুনিক কবিতায়। এই উপলব্ধিবোধ থেকে হয়তো জীবনানন্দ দাশ বলেছেন-‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি।’ তাই কবি হৃদয়ের চিত্রকল্পের অভিজ্ঞতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশই ব্যক্তির কথাকে কবিতায় রূপান্তরিত করে। তবে কথা হলো- শিল্পের প্রকাশই কবিতা নয়; বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাব-অভিজ্ঞতা আর দৃশ্য কল্পনার এক অদৃশ্য ধারাবাহিক বন্ধন। এই বন্ধনের ক্ষমতা খুব অল্প সংখ্যক কবির মধ্যে বিরাজ করে যার ফলশ্রুতিতে তদের কবিতা হয়ে উঠে মহৎ। যদি এভাবে বলা যায়-একজন কবি যখন তাঁর পৃথিবীর সর্বময় অন্তর্নিহিত কথাকে -যা তিনি বুঝাতে চান তা- যখন একটি নির্দিষ্ট শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করেন তখনই তা কেবল কবিতা হয়ে ওঠে। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে- শিল্পের মূল্য যদি হয় ব্যক্তি-বিশেষের কাছে ভিন্ন, তবে শিল্প কি আপেক্ষিকতার পরিচয় দেয়? উত্তরে বলা যায়- আপেক্ষিকতার প্যাঁচে না জড়িয়ে শিল্পকে সর্বজনীনভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। তবে তার ব্যবহার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে ভিন্ন আবেদন আনতে পারে। সৃষ্টি করতে পারে আঙ্গিক বৈচিত্র্যের স্বতন্ত্র ধারাবাহিকতা। আর এ উপলব্ধিবোধ থেকে হয়তো কবিকে জ্ঞানস্রষ্টা না হলেও চলে, তবে তাকে শিল্পস্রষ্টা অবশ্যই হতে হয়। কেননা শিল্পের মধ্যে সবকে প্রকাশই হল একজন যথার্থ আধুনিক কবির কাজ।

কবিতায় চিত্রকল্প

ইমেজ বা চিত্রকল্প কবিতার অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ ও উপাদেয় উপাদান বটে, কিন্তু তা কোনো অর্থেই কবিতার বহিরঙের বিষয় নয়৷ ইমেজ হচ্ছে কবিতার অনত্মর্গত বিষয়ক, যা যুবতী নারীর বুকে বেড়ে ওঠা সত্মনযুগলের মতোই সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত৷ হেলাল আহমেদ

কবিতায় কবির উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতাকে কখনো সংহতি, কখনো ব্যপ্তি ও বৈচিত্র্য দানের প্রয়োজনেই চিত্রকল্পের জন্ম৷ এখানে মনে রাখা প্রয়োজন ‘চিত্রকল্প’ বিচ্ছিন্নভাবে কবিতা নয় বটে, কিন্তু কবিতার উপাদেয় উপকরণ৷ ইংরেজি ভাষার ‘ইমেজ’ এবং বাংলা ভাষার ‘বাক-প্রতিমা’ কথাটিও চিত্রকল্পের সমার্থক শব্দ৷ প্রকৃত অর্থে ‘চিত্রোপমা’ বলতে যা বোঝায় তা-ই হচ্ছে মূলত ইমেজ৷ এ ইমেজ হচ্ছে কবি আত্মার গূঢ় সঙ্কেতনির্ভর৷ ইমেজে থাকে ইন্দ্রীয়বেদ্য অনুভূতির প্রকাশ৷
তবে ইমেজ কেবল সাধারণ চিত্র বা ছবি নয়৷ ইমেজ হচ্ছে আমাদের ইন্দ্রীয় চেতনার দৃষ্টি, শ্রম্নতি, স্পর্শ, ঘ্রাণ, স্বাদ ইত্যাদির উদ্বোধক৷ ইমেজ এক ধরনের ‘চিত্রোপমা’ সম্ভবত এ কারণেই চিত্রোপমা প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘উপমাই কবিত্ব’৷ ইমেজ চিত্রোপমা বটে, কিন্তু ইমেজে অন্যান্য অলঙ্কারও পরস্পরিত হয়ে থাকে৷ স্মর্তব্য, রবীন্দ্রনাথের উপমার বিশেস্নষণ প্রসঙ্গে কবি সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর উক্তি : উপমা, উত্‍প্রেৰা, চিত্রকল্প এমনকি প্রতীকের সবগুলোই উপমার অভিজ্ঞানের মধ্যে ধরে নিতে হবে৷ শুধু ‘মতো’ থাকলেই উপমা হলো তা নয়, ভাব যেখানে ছবি হয়ে উঠেছে, চিনত্মা যেখানে স্পর্শসহ রূপ নিল, সেখানেই কোনো না কোনো, সূক্ষ্ম, চতুর, লুক্কায়িত উপায়ে উপমার ব্যবহার অনিবার্য৷ কবিতায় কবির শ্রবণগ্রাহ্য অভিজ্ঞতাকে ও বক্তব্যকে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপদানের প্রয়োজনে চিত্রোপমা বা ইমেজের ব্যবহার অপরিহার্য৷ ইমেজের ফলেই কবিতার শ্রম্নতিগ্রাহ্য অনুভূতি গুচ্ছ ভিজু্যয়াল সামগ্রীর উপাদেয় উপকরণ হয়ে ওঠে৷ সে কারণেই বাংলা কাব্যে ইমেজের ব্যবহার এমন পৌনঃপুনিক৷ কয়েকটি দৃষ্টানত্ম :
হায়রে যেমতি/স্বর্ণচূড় শস্যৰত কৃষিদল বলে,/পড়ে ৰেত্রে, পড়িয়াছে রাৰসনিকর/রবিকুল রবি শূর রাঘবের শরে৷ (মেঘনাদবধ কাব্য, প্রথম সর্গ; মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
বসিলা যুবতী/পদতলে, আহা মরি, সুবর্ণ দেউটি তুলসীর মূলে যেন জ্বলিল৷
(ওই, চতুর্থ সর্গ, ওই)
ঘুমের মতো মেয়েগুলি/চোখের কাছে দুলি দুলি/বেড়ায় শুধু নূপুর রণরণি (মাতাল: ছবি ও গান; রবীন্দ্রনাথ)
কুহেলী গেল, আকাশে আলো দিল যে পরকাশি/ধূর্জটির মুখের পানে পার্বতীর হাসি৷ (সাগরিকা : মহুয়া, ওই)
বক্র শীর্ণ পথখানি দূর গ্রাম হতে/শস্যৰেত পার হয়ে নামিয়াছে স্রোতে৷ তৃষ্ণার্ত জিহ্বার মতো৷ (সুখ: চিত্রা; ওই)
সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা/অাঁধারে মলিন হলো, যেন খাপে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার৷ (বলাকা : বলাকা; ওই)
হাওয়ার মুখে ছুটলো ভাঙা কুঁড়ের চাল/শিকল ছেঁড়া কয়েদী ডাকাতের মতো৷ (পৃথিবী: পত্রপুট, ওই)
অাঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে/অাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি;/পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা/অনাঘ্রাতা পূজার ফুল দুটি৷ (নিদ্রিতা: সোনার তরী; ওই)
ছায়াখানি রক্তপদতলে/চু্যত বসনের মতো রহিল পড়িয়া;/অরণ্য রহিল সত্মব্ধ, বিস্ময়ে মরিয়া\\ (বিজয়িনী : চিত্রা; ওই)
নিকপিক করে ৰীণ কাঁকাল/পেশোয়াজ কাঁপে ঢালমাটাল/গুরম্ন উরম্নভাবে তণু নাকাল,/টলমল অাঁখি জল বোঝাই৷ (নওরোজ : জিঞ্জির, নজরম্নল) নজরম্নলের আরেকটি চিত্রকল্পে পাচ্ছি : ‘কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে৷ আকাশের নীল গাঙে/ হাবুডুবু খায় তারা বুদ্বুদ্’৷
কি আশ্চর্য দীপাবলী জ্বেলেছো চারদিকে/বাহুমূলে চিবুকে গ্রীবায়/এমনকি ভ্রমরকৃষ্ণ খোঁপায় রেখেছো জ্বেলে/আলোর উত্‍সব৷/দু’চোখ নামালেই দেখি/বুকের দু’পাশে জ্বলে উজ্জ্বল আলোক সত্মম্ভ (ডুবে যাচ্ছি : প্রেমের কবিতা, আহসান হাবীব)
নীলপদ্ম যেমন করে দল মেলে/তেমনি করে তোমার চিঠির নীল খাম/ আমার হাতের মধ্যে খুলে গেল৷ (নীল খাম : ওই, ওই)
চৈতন্যের আলো পড়ে ঘুম-পাওয়া সত্তার পাপড়িত্বে/সূর্যের চুমোয় লাল পা-ুগাল৷ টেবিলের দু’টি/তরম্নণ কমলালেবু চেয়ে আছে দূরের আকাশে,/ চিকন সোনালি রম্নলি ম্রিয়মান শঙ্খ সাদা হাতে/যেন বেদনায় স্থির_ মনে হলো সেই দু’টি হাত৷ মায়াবী নদীর ভেজা সোনালি বালিতে আছে পড়ে৷ (তার শয্যার পাশে : প্রেমের কবিতা, শামসুর রাহমান)
দুর্লভ মনির মতো সত্মন/ ঘন হলো বাসনার তাপে, যেমন গ্রীষ্মের ফল/ গাঢ় হয় সূর্যের চুম্বনে৷ (সুন্দরের গাথা : প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে; ওই)
তোমার ভালোবাসায় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ যেমন নিঃঝুম দুপুরে৷ সুন্দরীর গায়ের কাছে বেড়াল : সমর্পিত, দ্বিধাহীন ও তৃপ্ত৷ (জাগরণ : যেহেতু জন্মান্ধ; আবু হেনা মোসত্মফা কামাল)
হলদ বলে না কথা, সে থাকে এ্যাম্বুশ করে চুপ/অতর্কিত ছুটে এসে পাতার শরীরে৷ নিজের স্বাৰর এঁকে যায়৷ (যুদ্ধ : কেউ কিছুই জানে না, অরম্নণাভ সরকার)
সন্ধ্যা স্নানসিক্ত তোমার চুল বেয়ে নেমে আসতো/পাতা বাহারের ঝোপের ওপর৷ (চোখের ভেতর অলিম্পন : বদ্ধমাতাল রোদে, জাহাঙ্গীর ফিরোজ)
একজনের দুই উরম্নর ফাঁকে মাংসল সঙ্গীন/অন্যের বিপরীত দেশে হরতন/ হরতনের বুকে সঙ্গীনের খোঁচা৷ সঙ্গীন থেকে বেরোল টোটা৷ টোটায় টোটায় পস্নাবিত হলো নদী/নদী হয়ে উঠলো নগ্ন নধর কানত্মি৷ ওম শানত্মি৷ ওম শানত্মি৷ ওম শানত্মি৷ (নগ্ন নধর কানত্মি আমরা তামাটে জাতি; মুহম্মদ নূরম্নল হুদা)
গহীন জঙ্গল থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা নাচের আদলে/ তোমার দেহের প্রতিটি ভাঁজ পাপড়ি মেলে দেয়৷ (রাত্রিবাস : বদ্ধ মাতাল রোদে, জাহাঙ্গীর ফিরোজ)
তুমি যে ল্যাবের ব্যাঙ/আলপিনে গাঁথা/ক্লোরোফরম মুখে নিয়ে বেদনা রহিত/অনিবার্য ঘুমে৷ (ধুলো : চিত্রল প্রতিবেদন, রনজু রাইম)
কবি রবীন্দ্রনাথ কবি জীবনানন্দ দাশের চিত্রকল্পসমৃদ্ধ কবিতা পাঠ করে তার ভেতর তাকিয়ে দেখার আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন৷ জীবনানন্দ দাশের কবিতা পূর্বাপর চিত্রকল্পসমৃদ্ধ৷ কয়েকটি দৃষ্টানত্ম:
হেমনত্মের মাঠে-মাঠে ঝরে/শুধু শিশিরের জল;/অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে৷ হিম হয়ে আসে/বাঁশপাতা_ মরা ঘাস_ আকাশের তারা;/বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা; (পেঁচা: ধূসর পা-ুলিপি) শ্যামার নরম গান শুনেছিল_ একদিন অমরায় গিয়ে/ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়/বাংলার নদী মাঠ ঘাসফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়৷ (বাংলার মুখ আমি : রূপসী বাংলা) চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,/মুখ তার শ্রাবসত্মীর কারম্নকার্য৷ (বনলতাসেন : বনলতা সেন) এই কথা বলেছিল তারে_/চাঁদ ডুবে চলে গেলে_ অদ্ভুত অাঁধারে/ যেন তার জানালার ধারে/উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিসত্মব্ধতা এসে৷ (আট বছর আগের একদিন : মহাপৃথিবী)
হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্টরোগী চেটে নেয় জল;/অথবা সে হাইড্র্যান্ট হয়তোবা গিয়েছিল ফেঁসে৷/এখন দুপুর রাত-নগরীতে দল বেঁধে নামে৷/ একটি মোটর কার, গাড়লের মতো গেল কেশে/অস্থির (পেট্রোল ঝেড়ে, (রাত্রি : সাতটি তারার তিমির)
ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলা,_/ডালিম ফুলের মত ঠোঁট যার, রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,/চুল যার শাঙনের মেঘ, আর অাঁখি গোধূলীর মতো গোলাপী রঙিন৷ (ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল : ঝরা পালক)
ইমেজ বা চিত্রকল্প কবিতার অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ ও উপাদেয় উপাদান বটে, কিন্তু তা কোনো অর্থেই কবিতার বহিরঙের বিষয় নয়৷ ইমেজ হচ্ছে কবিতার অনত্মর্গত বিষয়ক, যা যুবতী নারীর বুকে বেড়ে ওঠা সত্মনযুগলের মতোই সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত৷

চিত্রকল্পের জানালায়ঃ সূচনা পর্ব // কে এম রাকিব

ভূমিকা পর্বের ভূমিকা :

যদি বলা হয় বকধার্মিক, তাহলে ভাষা সচেতন ব্যক্তির মনে কি সেই একপায়ে দাঁড়ানো বকটির ছবিই ভেসে ওঠে না? -যার ধ্যানী সুলভ মূর্তি, ভাবখানা এমন দুনিয়ার কিছুতেই আগ্রহ নাই, কিন্তু মওকা পেলেই যে ২-১টি মাছ ছো মেরে নিয়ে যাবে জলাশয় থেকে? কিংবা গড্ডলিকা প্রবাহ বলা মাত্র কি মনে পড়ে না গড্ডলের (ভেড়ার) সেই নির্বোধ অনুকরণ প্রবাহের দৃশ্য?
আমরা সংবেদী অঙ্গের (sensory organ) ব্যবহার করে বাগধারা কিংবা যেকোন শব্দবন্ধের অর্থ আরো সম্যক ভাবে উপলব্ধি করি। কারন তা আমাদের কল্পনাকে উসকে দেয়। তাই বকধার্মিক বলতে শুধু ভন্ডই বুঝি না, কিংবা গড্ডলিকা প্রবাহ বলতে অনেকের বিবেচনাহীন জোয়ারে গা ভাসানোই বুঝি না, আরো বেশি কিছু অনুভব করি।

এই যে শব্দের চিত্রধর্মিতার মাধম্যে অন্যের সাথে যোগাযোগ এটা আধুনিক কবিদের এক বড় হাতিয়ার। তাই চিত্রকল্প আধুনিক কবিতার এক অনিবার্য উপাদান। এ যুগে চিত্রকল্প ছাড়া কবিতা কল্পনা করাও কঠিন। সব কবিই এ যুগে চিত্রকল্প ব্যবহার করে থাকেন, কেউ সচেতনভাবে, কেউবা অসচেতনভাবে। কারন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান বলছে, ভাষা যত আধুনিক হচ্ছে তত এর প্রতীকধর্মীতা ও চিত্রধর্মীতা বাড়ছে। তাই কবিতায় এর প্রভাব পড়বে বই কি! চিত্রকল্পের সাথে পরিচিত থাকাটা তাই জরুরী হয়ে পড়ে। ‘চিত্রকল্পের জানালায়’ লেখায় চিত্রকল্পের জানালা দিয়ে কবিতার আকাশে উঁকি দিতে চেষ্টা করা হবে। আশা করা যায়, ৪/৫ টি পর্বের মধ্যে আলোচনা শেষ করতে পারব। প্রথম পর্বে ভূমিকা থাকল। এর পর, কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যবহার, চিত্রকল্পের বিবর্তন, মূর্ত, বিমূর্ত ও উত্তরাধুনিক চিত্রকল্প, চিত্রকল্পের মানসিক অভিঘাত, চিত্রকল্প ব্যবহারের কৌশল ও নানা দিক প্রভৃতি আলোচনার ইচ্ছা থাকল। ক্রমবর্ধমান পড়াশোনার চাপ ও নিজের কিংবদন্তি-পর্যায়ের আলস্যের কথা মনে রেখেও শুরু করলাম! দেখা যাক।

চিত্রকল্পঃ There are pictures in poems and poems in pictures [Chinese Proverb]

চিত্রকল্প শব্দটি বাংলায় সাধারণত Image এর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাহিত্য সমালোচকদের কেউ কেউ image-এর অন্য বাংলা প্রতিশব্দ প্রস্তাব করেছেন, যেমনঃ সুশীলকুমার গুপ্ত ‘ভাবরূপচিত্র’ সত্যেন্দ্রনাথ রায় ‘মানস প্রতিবিম্ব’ অমলেন্দু বসু ‘বাকপ্রতিমার এছাড়া ‘বানী শিল্প’ ‘রূপকল্প’ ‘শব্দকল্প’ ইত্যাদি নামও পাওয়া গেছে। তবে চিত্রকল্প নামটিই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বেশি।

উইন্ডহ্যাম লুইস চিত্রকল্পকে কবিতার ‘Primary pigment‘ অর্থাৎ প্রাথমিক রঞ্জক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার চিত্রকল্পকে কবিতার প্রাণ বলে অভিহিত করেছেন স্টিফেন জে. ব্রাউনঃ This must surely be obvious as regards poetry: imagery is its very life.

কবিরা খুবই সংবেদনশীল হয়ে থাকেন। কবির সংবেদনের গভীরে লুকিয়ে থাকে অভিজ্ঞতার নির্যাস ও সৃষ্টিশীল আকাঙ্ক্ষা। এই অভিজ্ঞতা যখন অসাধারণ শব্দচিত্রের মাধ্যমে কবিতায় বহুমাত্রিক বোধ উৎপন্ন করতে সক্ষম হয় তখনই তাকে চিত্রকল্প বলে অভিহিত করা যায়।
চিত্রকল্প নিয়ে আলোচনার আগে এর ইতিহাস আগে দেখে নেয়া যেতে পারে।

চিত্রকল্পের ধারনাঃ
চিত্রকল্পের ধারনাটি এসেছে আধুনিক সময়ে। প্রাচীন আলংকারিক ভাষার চিত্রধর্মিতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, বর্নাঢ্য চিত্রকল্পের জন্মও দিয়েছেন। কিন্তু তারা চিত্রকল্পের চরিত্র নিয়ে ভেবেছেন বা ব্যাপক নিরীক্ষা করেছেন বলে মনে হয় না। চিত্র সৃষ্টির প্রবণতা বহু প্রাচীন। প্রাচীন কবি বক্তব্যের বিষয়টিকে অলংকারপূর্ণ মাহাত্ম্যে পরিবেশন করার জন্য শব্দচিত্র সৃষ্টি করেছেন। একটি প্রাচীন কবিতায় আছেঃ

স্তন যুগমশ্রুস্নাত সমীপতরবর্ত্তি হৃদয়শোকাগ্নে।
চরতি বিমুক্তাহারাং ব্রতমিব ভবতো রিপুস্ত্রীনাম।।
অর্থাৎ হৃদয়ে যে শোকের আগুন জলছে তার খুব নিকটবর্তী ও হারবিমুক্ত এবং অশ্রু স্নাত স্তন যুগল যেন নিজের শত্রু-স্ত্রীদের বৈধব্য ব্রত পালন করছে।

প্রাচীন কবিতায় কাহিনীর প্রয়োজনে প্রচুর শব্দ চিত্র আকতে হয়েছে কবিদের। কিন্তু চিত্রকল্পকে কেন্দ্র করে প্রথম কাব্য-আন্দোলনের সূত্রপাত হয় পাশ্চাত্যে ১৯০৮ সালে। বিশ শতকের শুরুরর দিকে ইল্যান্ডে এজরা পাউন্ডের নেতৃত্বে আন্দোলন ঘটে তাকে সমালোচকেরা ইমেজিসম বা চিত্রকল্পবাদ বলে থাকেন। টি. ই হিউম ছিলেন পাউন্ডের প্রধান সহযোগী। এছাড়া উইন্ডহাম লুইস, এমি লোয়েল, হ্যারিয়েট মনরো এর সহ অনেকে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।

ইমেজিস্ট কাব্য আন্দোলনের সাথে জড়িতরা কবিতার বিষয় ও আঙ্গিক সম্পর্কে নির্দিষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। সাহিত্যের একটি বিশ্বকোষ চিত্রকল্পের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এজরা পাউন্ডের বক্তব্য তুলে ধরেছেঃ
1. Direct treatment of the ‘thing’ whether subjective or objective
2. To use absolutely no word that does not contribute to the presentation
3. As regarding rhythm: to compose in the sequence of the musical phrase, not in the sequence of a metronome.
(ইশতেহার দিয়ে সাহিত্য বা কবিতা হয় কিনা,সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। আমাদের আলোচনা যেহেতু, ইমেজ বা চিত্রকল্প কেন্দ্রিক তাই ইমেজিস্ট মুভমেন্ট সম্পর্কে উল্লেখ করা)
১৯১৩ সালের মার্চে এফ. এম. ফ্লিন্ট এবং এজরা পাউন্ড মার্কিন পত্রিকা ‘পোয়েট্রি’র পাতায় উপর্যুক্ত আন্দোলনের মূলনীতি প্রকাশ করেন। তারা কবিতায় বস্তুগত বা ভাবগত যেকোন বিষয়ে শব্দের প্রত্যক্ষ ও শব্দের সঠিক ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন।

ইমেজিস্টদের প্রতিনিধিত্বমূলক দুটি কবিতা দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রায়শই উল্লেখ করা হয়ঃ
A touch of cold in the autumn night
I walked abroad,
And saw the ruddy moon lean over a hedge
like a red faced farmer.
I didn’t not stop to speak, but nodded;
and round about were the wishful stars
with white faces like town children.
[T. E. Hulme, Autumn]
শীতের আলতো ছোঁয়া হেমন্তের রাতে
বাইরে হাঁটছিলাম আমি
দেখলাম টুকটুকে চাঁদ
লালমুখো চাষীর মতো,
আমি তাকে থামতে বলিনি কথা বলতে
তবে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম শুভরাত্রি
শহরের শিশুদের মত শুভ্র মুখ
চারদিকে তৃষ্ণার্ত নক্ষত্র।
(হুমায়ুন কবির-এর অনুবাদ অনুসরণে সরকার আমিনের অনুবাদ)

ইমেজিস্ট আন্দোলনের সদস্য এডোয়ার্ড স্টোরার কবিতাঃ

Forsaken Lovers,
Burning to a chase white moon,
Upon storage pyres of loneliness and drought.
পরিত্যক্ত প্রেমিকেরা
সহজ শুভ্র চাঁদের নিচে
একাকিত্ব ও শুষ্কতার আধার চিতার ওপর জ্বলছে।
(হুমায়ুন কবির-এর অনুবাদ অনুসরণে পোস্ট দাতার অনুবাদ)

উপর্যুক্ত দুটি কবিতাই ইমেজিস্টদের মানসিকতাকে প্রকাশ করে। আরো প্রকাশ করে চিত্রকল্পের অনেক বৈশিষ্ট্য যেমনঃ কবিতায় শব্দে আঁকা চিত্রমাত্রই চিত্রকল্প নয়। ‘চিত্রশিল্প যেমন শুধু চোখকে তৃপ্ত করে না, উদ্বুদ্ধ করে কল্পনাকেও, জন্ম দেয় তৃতীয় মাত্রার- চিত্রকল্পও তেমনি তৃতীয় মাত্রার জনয়িতা’ তার মানে চিত্রকল্পের চিত্রাতীত নান্দনিকতা ও চিত্রাতীত বাস্তবতা থাকে। সেনসিবিলিটি, সময় চেতনা, চিন্তার নরম আলো থাকে উৎকৃষ্ট চিত্রকল্পের মধ্যে।

চিত্রকল্প ও প্রতীকঃ
চিত্রকল্প ও প্রতীকের মধ্য মিল থাকলেও এরা আলাদা। যে কোন শব্দই সংকেতের কাজ করে। প্রতীকের করে, আরো ফোকাসড হয়ে। কিন্তু প্রতীকের মধ্যে গতিশীলতা নাই, যা আবার চিত্রকল্পের প্রাণ। এছাড়া চিত্রকল্পের উদ্বুদ্ধকরণ শক্তি অনেক বেশি। চিত্রকল্পের সাংকেতিক ক্ষমতাও বেশি কেননা এর রয়েছে দৃশ্য নির্মাণের প্রশস্ত ভূমি।
চিত্রকল্প আলাদা কোন অলংকার নয়ঃ
অনেকে চিত্রকল্পকে আলাদা একটি অলংকার বিবেচনা করলেও চিত্রকল্প আলাদা কোন অলংকার নয়। বরং এটি একাধিক অলংকারের নির্যাস। চিত্রকল্পে থাকতে পারে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক ইত্যাদি অর্থালংকার থাকতে পারে থাকতে পারে যেকোন শব্দালংকারও। তবে কবিদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় একটি সাদৃশ্য মূলক অলংকার উপমা, কারন এই অলংকারের রয়েছে চিত্রময়তা ও অন্তর্গত ভাবকে মূর্ত করার অনুপম ক্ষমতা। তাই চিত্রকল্পকেও উপমার ব্যবহার বেশি।

চিত্রকল্পকে সবসময় দৃশ্যমান হতে হবে এমন কোন কথা নেইঃ
দৃশ্যমানতা চিত্রকল্পের সবচেয়ে বড় গুন হলেও চিত্রকল্পকে সবসময় প্রকটভাবে দৃশ্যমান হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। শুধু চোখ নয়, কান, জিভ ও স্পর্শ ইন্দ্রিয় ও অনুপ্রেরণা পারে জাগাতে। এমনকি মানুষের বিশ্বাস ও যাপন থেকেও অস্পষ্ট, বিমূর্ত অবয়ব কিন্তু যা বোধ ও চেতনাকে স্পর্শ করে যায় এমন চিত্রকল্প সৃষ্টি হতে পারে। এমন কি একই সাথে একাধিক সংবেদী অঙ্গকে ছুঁয়ে যেতে পারে কবির বোধ। (ইংরেজিতে একে বলে Synesthesia, বাংলায় কি বলে জানি না, জানলে জানান প্লিজ) যখন কেউ বলে, তোমার ‘গলাটা ভারী শোনায়’ কিংবা কারো ‘শীতলকণ্ঠ’ এর কথা বলে তখন কিন্তু একাধিক সংবেদী অঙ্গের অনুভূতিই আমরা পাই। এমিলি ডিকিনসনের’ ‘Light laughs the breeze in her castle of sunshine’ লাইনটি অথবা এডিথ সিটওয়েলের ‘dull blunt wooden stalactite / Of rain creaks, hardened by the light. পড়লে আমরা টের পাই সিনেস্থিসিয়ার ব্যবহার। জীবনানন্দ যখন চিলের ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ’ মুছে ফেলার কথা শোনান, কিংবা বলেন, ‘…নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার’ কিংবা ‘ধূসর চালের গন্ধে তরঙ্গেরা ঝরেছে দুবেলা’ তখনও একই ভাবে সিনেস্থিসিয়ার ব্যবহার উপলব্ধি হয়।

এটা ঠিক যে শুধুমাত্র চিত্রকল্প তৈরির উৎকর্ষই কবিতাকে উৎকৃষ্ট কবিতা বানায় না কিন্তু বেশির ভাগ আধুনিক কবিতায় চিত্রকল্পের নৈপুণ্য দেখা যায় কোন না কোন ভাবে। কবিতার অন্যান্য উপাদানের সাথে
চিত্রকল্পের ব্যবহার তাই গুরুত্ব বহন করে।

কবিতাকে মনে করি শিল্পের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। কবিতা কী? কবিতা কাকে বলে ? এখন আর এসব প্রশ্ন ভাবার অর্থ আছে বলে মনে হয় না। তবে কবিতায় নিজের কৌতূহলের কারনে কবিতার যাবতীয় উপাদান, কাজকারবার, পাঠকের মানসিক অভিঘাত, ছন্দ ও অলঙ্কারের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে পড়তে, জানতে, শিখতে, বুঝে নিতে আগ্রহী। ব্লগে এ আলোচনার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, যা বুঝতে চেয়েছি শুধু তা শেয়ার করা, বরং ধারনা গুলোকে যাচাই করে নেয়া, সহ ব্লগারদের থেকে নতুন কিছু জানা.

তথ্যসূত্রঃ
The world of imagery ,Stephen J. Brown
The poetic image, C. Day Lewis
বাংলাদেশের কবিতায় চিত্রকল্প, বাংলা একাডেমী প্রকাশিত।
The struggle of the modern, Stephen Spender
Discovering poetry, Elizabeth Drew
নির্বাচিত প্রবন্ধ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ।

[এই তথ্যসূত্র খুব একটা ভ্যালিড না, কারন লেখার সময় দু'একটা ক্ষেত্র ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্মৃতি থেকে টুকটাক তথ্য নেয়া হয়েছে, বিভিন্ন উৎস ঠিক ঠাক মনে থাকার কথা না। তবে বইগুলো প্রাসঙ্গিক এবং ভাল বই সেই হিসেবে নাম করা যায়]

ক্যানভাসে উন্মীলিত নিঃশব্দ কবিতার চিত্রকল্প

কবিতা ও ছবির মধ্যে একটা সমান্তরাল সম্পর্ক আছে। সম-অন্তরাল বা সমান দূরত্ব বজায় রেখেই দুজনের চলা। তাতে তাদের মিলে যাওয়ার বা এক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কখনও তৈরি হয় না। কিন্তু একের আলো বা একের অভিজ্ঞান প্রতিনিয়তই অন্যকে ছুঁয়ে যেতে চায়। এরকম তুলনাও দিয়েছেন অনেক প্রাজ্ঞজন। যে ছবি হল অনুচ্চার কবিতা, আর কবিতা হল উচ্চারিত ছবি। একের প্রতি অন্যের আকর্ষণ প্রবল। কিন্তু দুজনকেই নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যের পরিসর বজায় রেখে অন্যের সারাৎসার আত্মস্থ করতে হয়। কবিতা নিয়ে যখন কেউ ছবি করতে চান, তখন কবিতার সত্তাকে প্রসারিত করার দায় থাকে তাঁর। কবিরও দায় থাকে ছবির আপাত স্থির প্রতিমাকল্পকে উন্মীলিত করার।

সুমনা ঘোষের সপ্তম একক প্রদর্শনী চলছে অ্যাকাডেমিতে। প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত ২৫-টি ছবির মধ্যে বেশ কিছু ছবি তিনি করেছেন কবিতা অবলম্বন করে। কবিতার সচিত্রকরণ বা ইলাস্ট্রেশন তিনি করেন নি। কবিতার অন্তর্নিহিত বীজ থেকে পল্লবিত করে তুলতে চেষ্টা করেছেন ছবির নিজস্ব অবয়ব ও সম্পৃক্ত প্রাণ। কবিতার ছন্দিত সুষমা তাঁর ছবিতে উন্মীলিত করেছে কল্পরূপের বিভিন্ন আবহ। বাস্তবের ভিত্তি থেকেই জেগেছে সেই কল্পরূপ। আপাত-বাস্তবকে দ্রবীভূত করে সেই কল্পরূপ ব্যঞ্জিত করেছে জীবনের বা অনুভবের বিভিন্ন মাত্রা।

একজন অনামী কবিতা লেখকের একটি কবিতা-সংকলন থেকে কয়েকটি কবিতা বেছে নিয়েছেন শিল্পী। সংকলনটির নাম ‘রাত্রির শূন্যের প্রান্তে।’। আঁধার অনেক সময়ই সৃজনের গর্ভগৃহ। তার ভিতর যখন পার্থিব বা অপার্থিব আলোড়নে শূন্যতা সঞ্চারিত হয়, তখন সৃজনের মূল কেন্দ্রটিই সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। সেই সংকটকেই নানাভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন তিনি। সেই প্রয়াসে ঝলসে উঠেছে নানাবিধ আলো। আবার আঁধারে তা আবিলও হয়ে গেছে। আলো-আঁধারের দ্বান্দ্বিকতা থেকেই গড়ে উঠেছে তাঁর ছবি। কবিতা সংকলনটির নামের সাযুজ্যে এই চিত্রমালার শিরোনাম দিয়েছেন শিল্পী: ‘অন দ্য এজ অব নকটারনাল ভয়েড’।

সংকলনের একটি কবিতার শিরোনাম ‘গন্ধ’-এর অনুসরণে যে ছবিটি এঁকেছেন শিল্পী, তার নাম দিয়েছেন ‘গন্ধই চেনায়’। গন্ধ একটি বিমূর্ত অনুষঙ্গ। কবিতায় গন্ধের কথা বলা যায়। কিন্তু ছবিতে তাকে রূপায়িত করা যায় না। এটা ছবির একটা সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্র। তাই শিল্পীকে যা করতে হয়, তা হল এই বিমূর্ত বোধকে দৃশ্য-রূপে রূপান্তরিত করে নেওয়া। সুমনা তাঁর ছবিতে এটাই করেছেন। কবিতায় বলা হয়েছে গল্পই মানুষকে চেনায় প্রকৃতি থেকে ঈশ্বর পর্যন্ত সমস্ত অভিজ্ঞান। তার পরেও অমোঘ এক শূন্যতা পরিব্যাপ্ত করে তাঁর চেতনাকে। কবিতার ভাষায়—‘তবু মধ্যরাতে জেগে উঠে দেখি/ তিমিরের গর্ভের ভিতর এক বিপন্ন শূন্যতা দোল খাচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়।’ শিল্পী চিত্রপটকে দুই ভাগে বিভাজিত করেছেন। এক পাশে দিনের রৌদ্রাভা, অন্য পাশে রাতের তিমির। আলোতে অবস্থান করছে একটি পাখি। আঁধারে ভাসমান এক মানবী। মধ্যভাগে গন্ধলীন কুসুমিত এক বৃক্ষের তলায় নির্জনে দাঁড়িয়ে আছে একাকী মানুষ। বুকের কাছে তাঁর বিপন্ন শূন্যতা, আঁধারলীন বৃত্তের প্রতীকে রূপায়িত। দোলনেরও প্রতীক ধরা আছে মানুষটির হাতে। দৃশ্য-প্রতীক নির্মাণের স্বাধীনতা শিল্পীর একান্ত নিজস্ব। কবিতার বিমূর্ততাকে এভাবেই দৃশ্যপ্রতীকে রূপায়িত করে এর নিহিত ভাবকে প্রসারিত করেছেন শিল্পী।

আর একটি কবিতার প্রথম দুটি লাইনে বলা হয়েছে: ‘সপ্তপর্ণী বৃক্ষমূলে রেখে দাও বাসনা তোমার / হেমন্তে সুবাস এসে জাগাবে কামনা’। এখানে ‘বাসনা’-কে শিল্পী রূপায়িত করেছেন পাখির ডিমের প্রতীকে, ‘সপ্তপর্ণী বৃক্ষমূলে যার অবস্থান। আর ‘কামনা’ ব্যাঘ্ররূপী এক নারীতে রূপান্তরিত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে আঁধারের দিকে। যেখানে রয়েছে ভোর হওয়ার প্রতিশ্রুতি। মানবীর হাতে এক মানবের মুখ, যা তাঁকে ‘স্বপ্নিল’ করে রেখেছে ‘শান্তিনিকেতন’-এর অভীপ্সায়। এভাবেই বাকপ্রতিমাকে চিত্রপ্রতীকে রূপান্তরিত করে বিভিন্ন ছবিতে শিল্পী তাঁর নিজস্ব বোধের নানা স্তরকে ব্যঞ্জিত করেছেন। এই একই প্রদর্শনী এর পরে অনুষ্ঠিত হবে সোদপুরের জলসাঘর গ্যালারিতে।

কাব্যসংসারে কবির দায়, পাঠকের দায়িত্ব // ফকির ইলিয়াস

কবি তো শিক্ষক নন, যে ক্লাস করাবেন। তিনি লিখবেন তার ভাষায়। ভাষা শেখানোর দায়িত্ব তো কবি নিতে পারেন না। অনেক ভালো, মেধাবী, সৃজনশীল কবি আছেন। এরা নতুন। যারা খুবই ভালো লিখেন। কিন্তু সেগুলো কজন পড়েন? শুধু একটু বাহবা দিয়েই দায়িত্ব শেষ? না, তা বোধহয় নয়। শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ এগুলোকেও প্রথম প্রথম অনেকে কবিতা বলেননি। বলেছেন এগুলোতো গদ্য। এখন সে মানসিকতা অনেকের বদলেছে। আরো বদলাবে, সন্দেহ নেই। পথে হাঁটতে হলে পথ চিনতে হবে। কবিতার আলোই টেনে নিয়ে যাবে পথচারীকে। পাঠকের অবশ্যই অধিকার আছে, তিনি কী পড়বেন- কী পড়বেন না। মানুষের জীবন খুব ছোট। তাই পছন্দ করে পড়া অবশ্যই জরুরি। যারা অবিন্যস্ত লেখেন, এরা অটোম্যাটিকেলি বাদ পড়ে যাবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তা নিয়ে ভাবারও কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। কবিতা মানেই কয়েকটা শব্দের সংযুক্তিই নয়। কবিতা চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাসসহ বিনির্মাণের সমন্বয়।


একটি কাব্যসংসারের অংশীদার দুজন। কবি ও পাঠক কিংবা পাঠিকা। কবি বাগান সাজান। পাঠক তা ভোগ করেন। এই যে দান এবং গ্রহণের আনন্দ, তা-ই একটি কবিতাকে মহিমান্বিত করে তোলে বারবার। কালের পর কাল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ধরা যাক কবি জীবনানন্দ দাশের কথা। জীবনানন্দ দাশ তাঁর জীবদ্দশায় ততোটা আলোচিত হতে পারেননি, যা পরে হয়েছেন। তাঁর ‘কবিতার কথা’ আমি যে কোনো নবিস কবিতানুরাগীকে পড়তে বিনীত অনুরোধ করি।
আধুনিক কবিতা সমকালীনতার, প্রাঞ্জল বুনন। প্রকৃতি যেমন ছিল তেমনি আছে। একজন নতুন কবিকে নিজের চিত্রকল্প এঁকে যেতেই হয়। দায় কিন্তু পাঠকেরও আছে। ছন্দ সমিল কবিতা খুঁজে অতীতে ফেরার চেষ্টা না করে পাঠককে ভাবতে হবে, একবিংশ শতাব্দীতে লেখা হচ্ছে ‘দৃশ্য কবিতা’।
সিলিকন ভ্যালির আলোয় বসে যে কবি নির্মাণের নৃতত্ত্ব আঁকছেন, তার পঙ্ক্তিমালায় তিরিশের চিত্রকল্প, উপমা, অনুপ্রাস খুঁজে পাওয়া নাও যেতে পারে। এ কথা খুবই সত্য, যদি সবাই কবি হতে পারতেন, তবে সব ভাষাসাহিত্যের সকল অধ্যাপকরাই হতেন বড় বড় কবি। তারাই হতেন সব কবিতার নিয়ন্ত্রক। কিন্তু তা কোনোকালেই হয়নি।
আমার দেখে হাসি পায়, যারা শুদ্ধ করে বাংলা লিখতে পারেন না তারাও কবিতা লিখেন। কাগজে পাঠান। খাতির থাকলে ছাপাও হয়। আমার কথা হচ্ছে যারা এই শূন্য দশকেও প্রকৃত কবিতাগুলো লিখছেন, তারা তো বাংলা শব্দই ব্যবহার করছেন। তাহলে পাঠক-পাঠিকারা না বুঝার কৈফিয়ত তুলবেন কেন? ব্যর্থতাটা কার? দুর্বোধ্য বলে কবিতায় কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।
যিনি পড়ছেন, তার পঠন-পাঠনের গভীরতা কতোটুকু আছে, তাও বিবেচনায় রাখা জর"রি। এক সময় জীবনানন্দ দুর্বোধ্য ছিলেন। এখন বহুল নন্দিত। হয়তো অবহেলা ছিল, তাঁর প্রতি। সমকালীন পাঠক তা খণ্ডন করে এগিয়ে গেছেন আরেক ধাপ।


দুই.


একটি কবিতাকে কে কিভাবে বিশ্লেষণ করেন, তাও বিবেচ্য বিষয়। কবি যে মনন নিয়ে লিখেছেন, পাঠক সে চোখ দিয়ে নাও দেখতে পারেন। এই কবিতাটি পড়া যাক ........।
‘নারীর ভিতরে ডুবে পুরুষটির মৃত্যু হয়েছিল। বালির উপর ছড়িয়ে আছে/
তার চশমা, বই ও ব্রিফকেস। সে নেই কিন্তু একটা পড়ে-থাকা শূন্য কাঁচের/
বোতলে তার আবছা প্রতিবিম্ব আটকে আছে। সেই প্রতিবিম্ব এখনো হাসছে,/
হাত নাড়ছে, কথা বলছে, মাঝে-মধ্যে রুমালে মুছে নিচ্ছে চুম্বনসিক্ত ঠোঁট।/
আর, অসংখ্য ডুবুরি সেই বোতলের ভিতরে ঢুকে খুঁজে চলেছে তাঁর মৃতদেহ’
(মদ/রণজিৎ দাশ/শ্রেষ্ঠ কবিতা)
কবিতাটির চিত্রকল্প কি খুব কঠিন? কারো কাছে তা লাগতেই পারে। তারপরও এটি একটি সার্থক কবিতা। আসুন, আরেকটি কবিতা পড়ি ।
‘তোমরা চলে যাচ্ছ, ট্রাকে মালামাল উঠে গেছে সব, এক জীবনে মানুষের কতবার যে
বাড়ি বদল জরুরি হতে পারে মানুষও বুঝি তা জানে না
একদিন এভাবেই ট্রাকে মাল বোঝাই করে রেলিং ঘেরা এই বাড়ির
একতলায় তোমরা নোঙর ফেলেছিলে, অতিথি পাখি ও গৃহস্থ বিড়াল একদিন
ভোরবেলা চার সদস্যের একটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার দেখে আহ্লাদে উল্লাস করেছিল
তোমরা ত্যাগ করে যাচ্ছ একটি অভ্যস্ত পরিমণ্ডল, তার বিয়োগ ব্যথায়
তুমি কাঁদলে তোমার মা কাঁদল, ট্রাকের সিটে গিয়ে বসলে সবাই, তুমি,
তোমার মা, ছোট ভাই, কুমারী আত্মীয়া, বাবাকে তো আগেই রেখে এসেছ অনিবার্য মাটির বিছানে
গাড়ি স্টার্ট নিতেই তাড়াতাড়ি হাত নাড়লে তোমরা সবাই, শেষবার তাকালে,
বাড়িওয়ালা অনুভূতিহীন, তখনই টাঙিয়ে দিচ্ছেন ভাড়াটে ধরার ‘টু লেট’ বাহানা,
ঘরে জল ঢেলে ধুয়েমুছে দেওয়া হচ্ছে তোমাদের সুদীর্ঘ ছোঁয়া
সব মায়া কাটিয়ে বাধ্য হয়ে তোমরা শহরান্তরে যাচ্ছ,
পেছনে কাজলা বিড়ালটি দৌড়াচ্ছে.. দৌড়াচ্ছে.....দৌ...ড়া....চ্ছে’
(বিড়ালটি/মুজিব মেহদী)
কতো মর্মস্পর্শী এই কবিতাটির বুনন।


তিন.


বাংলাদেশে/কলকাতায় একটা কবিতার বই ছাপা হয় (সবার নয় অবশ্য) ৫০০/১০০০।
এমনকি পাশ্চাত্যেও কাব্যগ্রন্থের কাটতি কম কেন? এ সময়ের আলোচিত মার্কিনি কবি ইউসেফ কমুনিয়াকার ‘টকিং ডার্টি টু দ্য গডস’ পড়নু। দেখবেন কবিতার বিবর্তন কিভাবে ঘটিয়েছেন তিনি। সময়কে ধারণ করতেই হবে।
আমি নিশ্চিত, ১০০ বছর পর আরো বদলাবে কবিতার বুনন। তা কেউ আটকাতে পারবে না। পারা সম্ভবও নয়।
না, কবিতা ব্রহ্মবাদ নয়। সবাই স্পর্শ করুক, তা সব কবিই চান। কিন্তু স্পর্শ করার মননও তো থাকতে হবে।
কবি তো শিক্ষক নন, যে ক্লাস করাবেন। তিনি লিখবেন তার ভাষায়। ভাষা শেখানোর দায়িত্ব তো কবি নিতে পারেন না। অনেক ভালো, মেধাবী, সৃজনশীল কবি আছেন। এরা নতুন। যারা খুবই ভালো লিখেন। কিন্তু সেগুলো কজন পড়েন?
শুধু একটু বাহবা দিয়েই দায়িত্ব শেষ? না, তা বোধহয় নয়। শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা' এগুলোকেও প্রথম প্রথম অনেকে কবিতা বলেননি। বলেছেন এগুলোতো গদ্য। এখন সে মানসিকতা অনেকের বদলেছে। আরো বদলাবে, সন্দেহ নেই।
পথে হাঁটতে হলে পথ চিনতে হবে। কবিতার আলোই টেনে নিয়ে যাবে পথচারীকে। পাঠকের অবশ্যই অধিকার আছে, তিনি কী পড়বেন- কী পড়বেন না। মানুষের জীবন খুব ছোট। তাই পছন্দ করে পড়া অবশ্যই জরুরি।
যারা অবিন্যস্ত লেখেন, এরা অটোম্যাটিকেলি বাদ পড়ে যাবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তা নিয়ে ভাবারও কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। কবিতা মানেই কয়েকটা শব্দের সংযুক্তিই নয়। কবিতা চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাসসহ বিনির্মাণের সমন্বয়।
না, কবি নিজে পড়ার জন্য লিখেন না। লিখেন সবার জন্য। তবে বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তিনি নিতে পারেন না। বেছে বেছে পড়লে পাঠকের মনন সময়ই সমৃদ্ধ করে। আবারো বলি, যারা আধুনিক, উত্তরাধুনিক, মৌলাধুনিক কবিতার রসাস্বাদন করতে চান তারা কলকাতার শক্তি, সুনীল, জয় থেকে আজকের বিকাশ সরকার, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ, মোহাম্মদ রফিক থেকে আজকের আবু হাসান শাহরিয়ার পর্যন্ত পড়ে দেখতে পারেন।
চলমান বাংলা সাহিত্যে অনেক ভালো কাজ হচ্ছে কবিতায়। পড়তে হবেঃ পড়তে হবেঃ এবং পড়তে হবে। পড়ার কোনো বিকল্প নেই। পঠন-পাঠনই বাড়িয়ে দিতে পারে কাব্যসংসারের প্রগাঢ় প্রেম।
 

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় চিত্রকল্প

জীবনের উপলব্ধি ইন্দ্রিয়জ। কবি-শিল্পীরা তাঁদের সাহিত্যকর্মে ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতা প্রকাশে নানামুখী তত্ত্বের অবতারণা ঘটিয়েছেন। শিল্পকর্ম বিনির্মাণে গড়ে তুলেছেন নানা ফর্ম। এ তত্ত্বের আধুনিক ধারাটি হচ্ছে ‘চিত্রকল্প’। সাহিত্যকে বলা হচ্ছে, ‘সামগ্রিক জ্ঞান, অনুভূতি ও চৈতন্য যা হয়ে ওঠে পঞ্চেন্দ্রিয়ের কাছে অর্থময়, আবেগবাহী ও ব্যঞ্জনাধর্মী’-এ অর্থে, পাঠকের ইন্দ্রিয়কে নাড়া দিতে গিয়ে শিল্পস্রষ্টাকে তার কল্পনাশক্তির ওপর জোর দিতে হয়। কবির মৌলিক শক্তিও ‘কল্পনাশক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত। যে কবির কল্পনাশক্তি যত প্রখর, সে কবির কবিতাও তত বেশি শক্তিশালী। কবি জীবনানন্দ দাশও ‘কল্পনাশক্তি’র ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, ‘মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা বুদ্ধি নয়, হৃদয় নয়-কল্পনা। কবিতা এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এ জন্যই যে কল্পনা তার পিছনে সবচেয়ে প্রধানভাবে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে কাজ করে যায়।’ কবিতায় কল্পনাশক্তির প্রয়োগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ‘চিত্রকল্প’ অভিধাটি। কবিতার চিত্রকল্প দৃশ্যগত ও ইন্দ্রিয়গম্য হিসেবে পাঠকের উপলব্ধিতে আসে। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় এ দুই ধরনের চিত্রকল্পেরই সন্ধান মেলে। চিত্রকল্পের ধারণাটি প্রাচীন হলেও বাংলা সাহিত্যে ত্রিশ কালপর্বে খ্যাত পঞ্চকবির হাতে চিত্রকল্পের সার্থক উপস্থিতি লক্ষণীয়। এরই ধারাবাহিকতায় পঞ্চাশের শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ কবিদের অন্তর্মূল ধরে নাড়া দিয়েছিল কবিতার শরীরে সংহতি-ভাবনা। ফলে এই সময়পর্বের কবিরা কবিতা শরীরে প্রতিমা স্থাপনের কৌশল গ্রহণ করেন। চিত্রকল্প নির্মাণের জন্য ব্যক্তিগত উপলব্ধির প্রয়োগ ঘটান কবিতার শরীরে। যে কারণে এই সময়পর্বের কবিতায় চিত্রকল্পের নকশায় একটি সুচিন্তিত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শব্দের প্রতীকী তাৎপর্য ও নাটকীয়তায় কবিতায় চিত্রকল্পগুলো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এ ধারায় সৈয়দ শামসুল হককে অগ্রবর্তী হিসেবে শনাক্ত করা যায়। সৈয়দ হকের কবিতার বিষয়-প্রকরণ যেমন বহুমাত্রিক অনুভাবনা জারিত তেমনি আবহমান বাঙালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যঋদ্ধ। কবিতায় প্রেম, স্মৃতিকাতরতা, অবচেতন মনের আশা-আকাক্সক্ষা প্রকাশে তিনি সমসাময়িক কবিদের চেয়ে ব্যতিক্রম মনোভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। কবিতায় সমকালীন মৌল প্রবণতাগুলো তুলে ধরতে কবিতাকে চিত্রকল্পের অবয়বে বিনির্মাণ করেছেন।
‘এখনও পরায় মনে পরাগের মতো রাত নেমে এলে বাংলার প্রান্তরে
সেই দূর কবেকার মেয়েদের দীর্ঘ কালো চুল
পাখির চিৎকার শুনে এখনও তো করে উঠি ভুলÑ
বুঝি সেই! সেই তারা! এখনও মেলার দিনে ডাকে যেন কেউ
আমারই এ ভুলে যাওয়া ডাকনাম ধরে।’
‘তবু বেঁচে থাকা অপরূপ’ কবিতায় কবিকে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত মনে হলেও ভাবনাটি একটি সুস্পষ্ট গ্রাম্য দৃশ্যের ভেতর পাঠককে টেনে নিতে সক্ষম। তিনি ঘন ও জটিল জীবনের রূপায়ণ তুলে ধরেছেন এ কবিতায়।
‘আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় কেন,
ক্যান এত তপ্ত কথা, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছন নিয়া ক্যান অন্য ধান খ্যাত রোয়?
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিরাম ধ্যান।
.... মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবশ্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।’
গল্পের পটভূমে রচিত ‘পরানের গহীন ভিতর’ কবিতাটি আবেগনির্ভর হলেও সুসংহত। এ কবিতায় জীবনের ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা ও বাসনার তীব্রতা লক্ষণীয়, যা পোড় খাওয়া সম্পর্কের ইতিবৃত্তকে ইন্দ্রিয়গম্য করে তোলে। সহজ ও সুনির্মিত দৃশ্যকল্পের কারণে কবিতাটি পাঠ মাত্রই পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত হয় এবং চৈতন্যলোকে ঠাঁই করে নেয়। কিংবাÑ ‘আমার কি আছে? গ্যাছে সুক/য্যান- কেউ নিয়া গ্যাছে গাভীনের বাঁটে যতটুক দুধ আছে নিষ্ঠুর দোহন দিয়া।’ সৈয়দ শামসুল হক অন্তস্থ স্বরে প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠে কবিতায় চিত্রকল্প এঁকেছেন। এ কবিতার মধ্য দিয়ে গোটা বাংলাদেশই চিত্রিত হয়ে ওঠে পাঠক হৃদয়ে। যেখানে নকল আভিজাত্যের কোনো প্রলেপ নেই।
ইংরেজী সাহিত্যে চড়বঃরপ রসধমব বা চিত্রকল্প নিয়ে নানা মত পরিলক্ষিত হলেও এজরা পাউন্ডের ‘অহ রসধমব রং ঃযধঃ যিরপয ঢ়ৎবংবহঃং ধহ রহঃবষষবপঃঁধষ ধহফ বসড়ঃরড়হধষ পড়সঢ়ষবী রহ ধহ রহংঃধহঃ ড়ভ ঃরসব’ উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। বলা যায়, সময় এবং পরিসরের খণ্ড ধারণা থেকে অভিজ্ঞতার মুক্তিই যথার্থ চিত্রকল্পের স্বরূপ। সৈয়দ শামসুল হকও সময়ের প্রেক্ষিত জীবনের আবেগঘন ভগ্নাংশগুলো তুলে ধরেছেন কবিতায়Ñ
‘বাংলার নদীতে সেই বিদ্যাপতি মহাজন বিখ্যাত ভাদরে
জলের তুমুল চুমো একদিন মনে মনে
কামরাঙা সে কার অধরে!
আমিই সে আমি বুঝি ভাদর বাদলে ভেজা মেয়েটির মুখ
করতলে তুলে নিই, রাখি ঠোঁটÑওতেই যা হয়েছিলো সুখÑ
এখনো ভুলিনি সেই দস্যিপনা প্লাবিত সবুজে!’
‘বাংলার নদীতে সেই’ কবিতাটিতে ‘জলের তুমুল চুমো’ কিংবা ‘ভাদর বাদলে ভেজা মেয়েটির মুখ’ চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবি চিরচেনা আবহমান বাংলার প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছেন। কবি সৈয়দ হক প্রকৃতি সত্তার অংশ হিসেবে প্রকৃতির অন্তর্গত ছল, রস ও জরার কাব্যিক রূপান্তর করেছেন যা চিত্ররূপের সঘন অবয়বে পাঠক হৃদয়ে ভেসে ওঠে। ব্যক্তিগত আবেগ ও চিন্তার সুষম বিন্যাস তার কবিতায় বহুমাত্রিক বোধ উৎপন্ন করে।
‘আমাদের এক নয়, অনেক জীবন।
মাঝে মাঝে মনে হয় সংখ্যা নয়, সংখ্যার বিভ্রমÑ
তবে একটিই জীবন! বিপরীত বিরুদ্ধ কি নয় তারা?’
‘হে অমর আগুনপাখি’ শিরোনামের দীর্ঘ কবিতায় তিনি জীবনকে সংখ্যাতত্ত্বে ফেলে নানাভাবে বিশ্লেষণ করে জীবনের মানে খুঁজেছেন। কখনো প্রকৃতির দ্বারস্থ হয়েছেন। লন্ডনের পাতাল ট্রেনের হইসেলের মধ্যে ঘোরলাগা দৃশ্যপটে কবি প্রিয় মাতৃভাষার অপেক্ষা করেছেন। আবার, এ কবিতায়Ñ
‘কত কাল কাটিয়েছি কত স্বৈরশাসকের বুটের তলায়,
চাবুকের প্রহারে প্রহারে আমি কুঁকড়ে গেছি, পউষের শীতেও কি আমি
রৌদ্রের প্রার্থনা নিয়ে দাঁড়াইনি জানাজার মতো মাঠ ব্যাপ্ত হাহাকারে?’
কবিতায় ‘স্বৈরশাসকের বুটের তলায়’ উল্লেখ করে তিনি স্বাধীন ভূ-খ-ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের চিত্রকল্প এঁকেছেন। একাধিক স্বৈরশাসকের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া কবি জীবনের ব্যক্তিক জীবনের ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধির কথা ব্যক্ত করেছেন। সময়ের বৈচিত্র্য ও কালের ব্যাপ্তিতে যাপিত জীবনে তিনি জেনেছেন অনেক কিছু। বাঙালী জাতির মঙ্গলভাষ্য রচনা করতে চেয়েছেন ‘কারবালা’ ও ‘কুরুক্ষেত্র’ ইত্যাদি মিথিক শব্দসমবায়ে। কবিতাটির শেষে ‘আগুনপাখি’ নিজেই পুরাণে পরিণত হয়। মানব জাতির অগ্রযাত্রায় ভষ্ম থেকে জন্ম নেয়া এই আগুনপাখিকে তিনি জাতির মুক্তি-দূত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যা কবির দেশপ্রেমের এক অমল দৃষ্টান্ত। দীর্ঘ এ কবিতা পাঠে পাঠক তার নিজের জীবনের বর্তমান, ভবিষ্যৎ, রাষ্ট্র-সমাজ, প্রকৃতি-পরিবেশ সম্পর্কিত চিন্তার আবর্তে ক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে। এ কবিতাটিতে কখনো দৃশ্যকল্প আবার কখনো ইন্দ্রিয়জ চিত্রকল্পে সঘন বলা যায়।
‘সাহিত্য হল সমাজ-অন্তর্গত মানুষের চেতনালোকের চিত্রকল্পের অন্তর্গূঢ় শৈল্পিক প্রতিফলন’Ñ এই আলোকে শিল্প সৃষ্টির মূলাধারে প্রতিদিনের খ- খ- ঘটনা, কর্মকা-, ক্লেশভোগ, সহিষ্ণুতা, অভিজ্ঞতা নানাভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। যা একজন কবি বিমূর্তাভায় কবিতায় প্রকাশ করেন। চিত্রকল্প যাকে পরিপূর্ণতা দেয়। কবি তাঁর অভিজ্ঞতা জারিত অনুচিন্তনের সঙ্গে সমকালীন পটভূমি প্রকৃতি জগৎ, ব্যক্তিক যন্ত্রণা বা মনোবেদনা, অবক্ষয়, বিকৃতি, স্বপ্ন ও অবচেতন স্তরের গহনে ডুব দিয়ে বিচিত্র বিষয় আহরণ করে গড়ে তুলেছেন কবিতার বাক্সময় বিশ্ব। যার হাতে সমকাল, ইতিহাস আর আধুনিকতা, পরস্পর হাত ধরাধরি করে কবিতার ক্ষেত্রকে করেছে উর্বর। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ভিত্তিভূমে দাঁড়িয়ে কাহ্নুপা, বিদ্যাপতি, বড়–চন্ডিদাস হয়ে মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ দাশের সহযাত্রী হয়ে বাংলা কবিতাকে মাধুর্যম-িত করে তুলেছেন সৈয়দ শামসুল হক। নিপুণ চিত্রকর্মে বাংলার মুখ এঁকেছেন আর নিবিড় মমতায় লালন করেছেন হাজার বছরের বাংলার ঐতিহ্য। সৈয়দ শামসুল হক চিত্রকল্পের উৎস হিসেবে নানামাত্রিক জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা, উপমা, অলংকার, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি শিল্পভাবনার দারস্থ হয়েছেন। ভাষা প্রয়োগ দক্ষতায় এসব শিল্পশ্লিষ্ট উপকরণ দিয়ে ইন্দ্রিয়গম্য চিত্রকল্প বিনির্মাণ করেছেন।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় চিত্রকল্প // মো হা ম্ম দ নূ রু ল হ ক

জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র বিভা। ঔজ্জ্বল্য ও লাবণ্যে অনন্য। শব্দগঠন, প্রয়োগ এবং বাক্যগঠনে স্বতন্ত্র। অনন্য কবিতার শরীর সৃজনে। তার ‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোত্স্নার প্রান্তরে’ দেখে কবি নিজেও প্রস্তর যুগ থেকে আধুনিক যুগের দিকে যাত্রা করেছিলেন। অথচ এ চিত্রকল্পের ভেতরই শাশ্বত হয়ে উঠেছিল ‘নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোত্স্নাকে ছুঁয়ে’ যাওয়া অশেষ যুগের বাস্তবতা। ‘ঘোড়া’ কবিতার চিত্রকল্পগুলো কালচেতনায় উদ্ভাসিত বলে কবি সমকালের হয়েও মহাকালের বাণীবাহক হয়ে উঠেছিলেন। আর ‘আকাশলীনা’ কবিতায় স্বার্থপর প্রেমিকের আকর্ষণ থেকে কোনো এক ‘সুরঞ্জনা’কে ফেরানোর তাগিদে যে সময়ের ছবি আঁকলেন, তা-ও ‘নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে’র।
‘আকাশলীনা’ কবিতায় যে কবিকে পাই, সে কবি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বাধীন রুচির প্রতি প্রতিবন্ধক—যা আধুনিকসম্পন্ন মানুষের দীক্ষিত মন গ্রহণ করতে চায় না। কিন্তু ভিন্নার্থে চিন্তা করলে বিষয়টি ভিন্ন রকমের তাত্পর্যও বহন করে। ‘সুরঞ্জনা’ যদি সাধারণ কোনো এক সরলার ভূমিকায় কল্পনা করা যায়—যার সারল্যভরা মনে কোনো প্রবঞ্চনা ধরা পড়ে না, সে সরলার যে কোনো ভুল পথে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে মুক্ত করার ব্রত নিজে গ্রহণ করেছেন। ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’ আপাতজীবিকাজটিল জীবনের অভিজ্ঞান। এ কবিতারও চতুর্থ পঙিক্ততে ‘হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল—রাঙ্গা’ হয়ে ওঠার পর পরই একটি স্পেসসহ পঞ্চম পঙিক্ততে ‘চুপ-চুপে ডুবে যায়—জ্যোত্স্নায়’ ভিন্ন রকম স্বাদ এনে দেয়।
কল্পনাবিলাসিতার জন্য কল্পনাবিলাসীদের বারণ করতে পারেন না। তবু যারা ‘টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে/বিনষ্ট হতেছে সাংহাই’ তারা নিশ্চয় মেনে নেবেন, জীবনানন্দ দাশকে কোনোভাবেই রাজনীতিবিমুখ কবি বলা যায় না। জীবনানন্দ দাশ নির্জনতাপ্রিয় কবি সত্য; কিন্তু বিশ্বচরাচরের বিভিন্ন ঘটনা ও দুর্ঘটনা তাকে ভাবিত করেনি—এ কথা সত্য নয়। অন্তর্মুখীন হওয়ার কারণে উচ্চকণ্ঠে চেঁচামেচিতে তার অনীহা ছিল ‘রূপার ডিমের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা’র মতো। দূর থেকে দেখেছেন যা কিছু পৃথিবীতে অকল্যাণ ডেকে আনে। যুদ্ধের ভয়াবহতা দূর থেকে অনুভব করেছেন, প্রতিকারের কোনো ব্যর্থতম চেষ্টা করেননি; কিন্তু রাজনীতিবিদ, সমাজবিদদের প্রেরণা জুগিয়েছেন তীব্র প্রতিবাদের। সময়ের অগ্রগামী ছিলেন বলে তাত্ক্ষণিক তার কাব্যভাষা সমকালের যুগমানস উপলব্ধি করতে পারেনি। এ ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’ একটি খণ্ড কবিতা হয়েও হয়ে উঠেছে সমকালের যুগসন্ধিক্ষণের যোগসূত্র।
আবেগের তারল্যে ভেসে গেলে এ কবিতটিও ‘বনলতা সেন’-এর মতো পাঠকপ্রিয় হতে পারত। কিন্তু ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি যে অর্থে ইতিহাস-আশ্রিত ভৌগোলিক সীমা ও অসীমের সঞ্চয়, সে অর্থে ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’কে অভিব্যঞ্জিত করা যায় না। দু’টি কবিতার প্রেক্ষাপট ভিন্ন, অনুভব ভিন্ন। ভিন্ন দু’টি কবিতার অবয়ব ও কালচেতনাও। তাছাড়া অ্যাডগার অ্যালান পো’র ঞড় ঐবষবহ কিংবা ইয়েটস-এর উত্বধস-যবধাু খধহফ কবিতার সঙ্গে ‘বনলতা সেন’ কবিতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকায় ‘বনলতা সেন’ কবিতায় কেবল স্থানিক পরিচয় কিংবা নায়িকার বঙ্গীয়করণের পরও বাঙালি পাঠক হিসেবে মনে খুঁত থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কিন্তু ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’ কবিতায় এ ঋণপরিগ্রহণের যোগসূত্র না থাকার পরও কিছুটা জটিল আবর্তনের স্মারক হওয়ায় আবেগী পাঠক-সমালোচক মনে বিস্ময়বোধ জাগাতে পারেনি। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় উল্লিখিত কবিতা দু’টির যতই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হোক না কেন, চিত্রকল্প নির্মাণে ‘বনলতা সেন’ স্বতন্ত্র। উল্লিখিত কবিতা দু’টিতে এমন চিত্রকল্প ঝলসে উঠতে দেখা যায় না। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন’-এর মতো উপমা-আশ্রিত এমন অমোঘ চিত্রকল্প উল্লিখিত কবিতা দু’টিতে কোথায়? কোথায় এমন ভারমুক্ত আশ্রয়? ‘পাখির নীড়ের’ সঙ্গে তুলনীয় আশ্রয় কেবল নাতিশীতোষ্ণ বাংলায়ই সম্ভব। আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ডে কল্পনারও অতীত। তাই ‘বনলতা সেন’ কবিতার সঙ্গে যতই অ্যাডগার অ্যালান পো’র ঞড় ঐবষবহ কিংবা ইয়েটসের উত্বধস-যবধাু খধহফ কবিতার মিল থাকুক, ‘বনলতা সেন’ স্বতন্ত্র শিল্পই।
জীবনানন্দ স্বভাবের সপক্ষে একটি জটিল সারল্যের কবিতা ‘বোধ’। সহজ-সরল বাক্যবন্ধের সম্মিলনে রচিত এ কবিতা। আপাত সরল বাক্যাবলির মাধ্যমেই জটিল চিন্তা ঘনীভূত হয়ে উঠেছে; ধীরে ধীরে। ক্রমেই জটিলতম চিন্তার দুর্গম অঞ্চলে পরিণতি পেয়েছে। ব্যক্তিবিশেষের স্ববিরোধ শিল্পের অঞ্চলে এক অনির্বচনীয় ঢেউয়ের নাম ‘বোধ’। ‘আলো-অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয়-কোন এক বোধ কাজ করে’, কিন্তু সে বোধ কী? সে প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
অথচ দুর্বোধ্য সে অনুভূতিপুঞ্জকেই যেন গভীর মমতায় প্রকাশ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। না পেরেই কি একা হয়ে গেলেন? ‘সকল লোকের মাঝে বসে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?/আমার চোখে শুধু ধাঁধা? আমার পথেই শুধু বাধা?’ উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এ বৈশিষ্ট্যই জীবনানন্দ দাশকে রোমান্টিক এবং সমকালীন আধুনিক কবিদের থেকেও ভিন্ন ও বিশিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট করেছে। এটিই তার মহত্তম আধুনিক কবিসত্তার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, ঘৃণা, অবহেলা—সবই একজন মানুষের মনে কী করে একীভূত হয়ে এক অব্যক্ত বেদনারাশির জন্ম দেয়, তা-ই যেন এ কবিতার মূল বিষয়ে পরিণত।
এটি আধুনিকতাবাদের নৈরাশ্য ও নিঃসঙ্গচেতনা কিংবা বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং অলৌকিকতায় আস্থাহীনতার বৈশিষ্ট্যকে নিশ্চিতির রূপ দেয়। আপন চিত্তের চাঞ্চল্যের কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ কবি। বিস্ময় প্রকাশের ভাষা তার, ‘সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়!’ তারপরই বিস্ময়াভিভূত আপন হৃদয়ের কাছেই প্রশ্ন জমা রাখেন, ‘অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?’ অসুখী মানুষ, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে সহ্য করেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার আকুতিই প্রকাশ করে। সাঁর্ত্রে কথিত অস্তিত্ববাদী চেতনার এ আরেক বিরল দৃষ্টান্ত। ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’র সঙ্গে ‘বোধ’ কবিতার অন্তর্গত মিলের চেয়ে অমিলই যেন বেশি। যে অর্থে ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’ রাজনীতি সচেতন কবিতা, সে অর্থে ‘বোধ’ নয়। প্রথমটিতে ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির যোগাযোগকে পূর্ণ করে তোলা হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে ব্যক্তির একাকিত্ব, হাহাকারকে চাড়িয়ে দিয়েছেন মানবমনে।
‘অবসরের গান’ কবিতার শুরুতেই ইন্দ্রিয়ঘন উপমা-আশ্রিত চিত্রকল্পে বিস্ময় জাগে। ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/অলস গেঁয়োর মত এই খানে কার্তিকের ক্ষেতে;/মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার,—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ’ পুরো তিন পঙিক্তজুড়েই একটি চিত্রকল্প উজ্জ্বল হয়ে আছে। স্বাদের অবাস্তব রূপের সঙ্গে বাস্তব জগতের সম্মিলন। অলীক উপলব্ধির সংশ্লেষ ঘটানোর অভিনব কৌশলও। যার নাম হয়তো প্রকারান্তরে পরাবাস্তবও হতে পারে। কিন্তু এখানে পরাবাস্তবতা খুঁজে পেতে গেলে বাস্তবতারও সংশ্লেষ ঘটাতে হয়। কার্তিকের মাঠে মাঠে ফসলের উত্সব। কৃষকের মনে আনন্দের হিল্লোল। এতসব আনন্দের ভেতর অলস সময় কাটানোর মতো অফুরন্ত সময় পাড়াগাঁর মানুষের থাকে না। নতুনকে আহ্বান করা ও বরণ করার ভেতরই উচ্ছ্বাসপূর্ণ হয় না। পরবর্তীকালের জন্য সঞ্চয়ও মানুষের চিন্তাবর্গের অনেকটা অঞ্চলজুড়ে জায়গা করে রাখে। তাই ‘পুরোনো পেঁচারা সব কোটরের থেকে’ যখন বের হয়ে আসে অন্ধকারে তখন ‘ইঁদুরেরা চলে গেছে’। খাদ্যচক্রের প্রসঙ্গনির্ভর এ চিত্রকল্পের প্রাণিজগতের অনিবার্য সত্য চিত্রায়িত। আবার এ দৃশ্য ইয়েটসকে মনে করিয়ে দেয়।
ইয়েটসেও কেবল ইঁদুর আর পেঁচার আনাগোনা। কিন্তু ইয়েটসের কবিতায় যে অর্থে প্যাস্টোরাল কবিতার গন্ধ খুঁজে পান সমালোচকরা, সে অর্থে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় কোনো গ্রাম্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। অথচ দু’জনই গ্রামের দৃশ্য এঁকেছেন। অবসরপ্রিয় মানুষের চোখ দেখে ‘আকাশের মেঠোপথে থেমে ভেসে চলে চাঁদ’। কারণ ‘সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে’। শীতের শেষে বসন্ত, বসন্ত শেষ না হতেই গ্রীষ্মের আলস্য মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। অনেকটা ‘গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে’ ধরনের বার্তাও শোনা যায়।
‘মৃত্যুর আগে’ কবিতায় চিত্রকল্পের বিপুল সমাহারে বিস্ময় জাগে। ‘আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়’ বলে সময়নির্ভর চিত্রকল্পের আশ্রয়ে কবিতার শুরু। যেখানে চাঁদ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কেবল, সেখানে জোনাকিরা অন্ধকার দূর করে দেয়। এমন শীতে ‘মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার’ শুনেও পুরনো পেঁচার ঘ্রাণের সন্ধান করে সুলুকসন্ধানী মন। অপরূপ শীতের রাতে অশত্থের ডালে ডালে বক ডেকে ওঠে। ‘বুনো হাঁস শিকারীর গুলির আঘাত’ এড়িয়ে দূরে চলে গেলে ‘সন্ধ্যার কাকের মত আকাঙ্ক্ষা’ নিয়ে নিত্যদৃশ্যে অভ্যস্ত হয় সংসারী মানুষ। সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হলুদ হয়ে এলে ‘মিনারের মত মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে’ চিত্রকল্পে জীবনানন্দ দাশের স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায় হলেও এর ভেতরই মৃত্যুর করুণ দৃশ্যও উঁকি দেয়। তাই ‘সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মত এসে জাগে/ধূসর মৃত্যুর মুখ’ তখন মৃত্যুর আগে আরও একবার বেঁচে থাকার আকুতি জানানোর আকাঙ্ক্ষাও জাগে।
‘আটবছর আগের একদিন’ একটি জটিল কবিতা। কী অর্থে জটিল—বোধের দিক থেকে, না কি প্রকাশের দিক থেকে? যাপিত জীবনের প্রতি ব্যক্তির বিবমিষা জন্মে, তাই কোনো কার্যকারণ সম্পর্কে পারম্পর্য রক্ষা না করেই স্বেচ্ছামৃত্যুকে শ্রেয় জ্ঞান করে কবিতার নায়ক। আধুনিক জীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈরাশ্যই তাকে জীবনের সমস্ত প্রাচুর্য উপেক্ষা করে আত্মহননের দিকে প্ররোচিত করে—যে রকম ঘুম একজন মানুষের কাম্য হতে পারে না, সে ঘুমই তার জোটে। তার মনে হয়, জেগে থাকাই যেন গাঢ় বেদনা ভরা। সে বেদনার ভার তাকে আর সহ্য করতে হবে না। শেষোক্তি শোনায় ‘চাঁদ ডুবে চলে গেলে-অদ্ভুত আঁধারে/যেন তার জানালার ধারে/উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।’ শেষ পঙিক্তর উপমা-আশ্রিত চিত্রকল্পে ফুটে ওঠে একটি বিশেষ বিষণ্ন সময়ের ভয়াবহ চিত্র। যাপিত জীবনের ক্লেদজ অভিজ্ঞতার ভিড়ে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষের কাছে লাশ কাটা ঘরের স্পন্দনহীন হিম ঘুমই শ্রেয় মনে হয়। আবার ‘রাত্রি’ কবিতায় ‘হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল’ বলে যে বিশেষ মুহূর্ত ও মানসিক অবস্থার বিবরণ পেশ করা হয়েছে, তার শেষ টেনেছেন ‘নগরীর মহত্ রাত্রিকে তার মনে হয়/লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।/তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব—অতিবৈতনিক/বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবত’ দিয়ে। নগরের ক্লেদজ ও মমতাহীন যাপিত জীবনের নির্মম বহুরৈখিকতায় ঋদ্ধ এ চিত্র।
তবে এখানেও কবি উপমা নির্মাণের ক্ষেত্রে নাগরিক জীবন আর পশুর স্বভাবগত পার্থক্য ঘুচিয়ে দেন। তার মূলেও উপমাশ্লিষ্ট চিত্রকল্প। জীবনানন্দ দাশে রূপকধর্মী চিত্রকল্প তেমন স্পষ্ট নয়। প্রতীকধর্মীও নয়। সর্বত্রই উপমাশ্রয়ী চিত্রকল্পের প্রাচুর্য। ‘হায় চিল’ থেকে শুরু করে ‘রূপসী বাংলা’র কবিতাগুচ্ছ। ‘হায় চিল’ কবিতার ‘তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে’ পঙিক্তও মানবমনের জটিল ঘূর্ণাবর্তের তীরে দাঁড়িয়ে উচ্চারিত সত্যের নাম।
‘ক্যাম্পে’ নামক সে জটিল চিন্তাশ্রয়ী কবিতা, সেখানেও উপমাশ্রয়ী চিত্রকল্প। ‘মৃত পশুদের মত আমাদের মাংস লয়ে আমরাও পড়ে থাকি’ পঙিক্তও উপমাকে আশ্রয় করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চিত্রকল্প। ‘শ্যামলী’ কবিতায় সমকালের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে চিরকালীন দিগ্বলয় স্পষ্ট। জীবনানন্দ দাশের কাব্যবিশ্বে উপমা, উেপ্রক্ষার প্রাচুর্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে চিত্রকল্পের অমোঘ স্বাক্ষরও। এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, ‘নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাত’-এ পরিপূর্ণ জীবনানন্দ দাশের কাব্যবিশ্ব।

কবিতার চিত্রকল্প, কালিক চেতনার ধারা // ফকির ইলিয়াস

বর্তমান কবিতাগুলো কি আসলেই খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে? নাকি ঝাপসা চিত্রকল্প এবং উপমার সমুদ্রে খেই হারিয়ে ফেলছেন পাঠক? ঝাপসা কিংবা কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের সুর্যোদয় যারা অবলোকন করেন তারা কি শুধুই স্বপ্নবিলাসী? এমন অনেকগুলো প্রশ্ন আজকাল প্রায়ই শোনা যায়| আবার কেউ কেউ আধুনিক অনেক গদ্য কবিতায় তাদের ছন্দের ব্যারোমিটার বসিয়ে দুরবীন দিয়ে দেখার চেষ্টাও করেন| কখনো তারা সফল হন| কখনো তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়| আবার কেউ কেউ নিজেকে ছান্দসিক কবি ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভে আটখানা হন| স্বপ্নবিলাস— তা যাই হোক না কেন, কবিতা যে এগিয়ে যাচ্ছে তাই হচ্ছে বর্তমানের প্রকৃত বাস্তবতা| কোন্ কবিতা কালোর প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে তা অতীতে যেমন বলা যায়নি, বর্তমানেও বলা যাবে না| উদাহারণ স্বরূপ জীবনানন্দকে আবারো প্রণাম করি| শতাব্দীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত তার বিচরণ আমাদেরকে আশান্বিত করেছে বৈকি! তার আধুনিক চেতনা এবং নান্দনিক প্রত্যয় কালের বাহক হয়েই থেকে যাচ্ছে— যাবে বহুবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত| তা এ মুহুর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে| কবিতা লেখাকে অনেক কবি মৌলতাত্বিক এবং সমসাময়িক আর্টিস্টিক বলে মনে করেন| তাদের এমন ধারণার পেছনে যুক্তিও আছে প্রচুর| কারণ অনুভবের অনুসৃতি এবং প্রার্থনার চেতনা তো হৃদয় থেকেই উৎসারিত হয়| একজন মানুষ চোখ খোলা রেখে অনেক কিছু দেখতে পায়| আবার চোখ বন্ধ করেও অনেক কিছু দেখতে পায়| একথা আমরা সবাই জানি এবং বুঝি| কিন্তু হৃদয়ের চোখের আয়নায় দাঁড়াতে পারি কজন? কবিতার কল্পচিত্র সব সময়ই বিশ্বজনীন এবং সার্বজনীন|

এ প্রসঙ্গে আমি কয়েকজন মার্কিন কবির সমসাময়িক কবিতার বাংলা তর্জমার কিছু খন্ডচিত্র তুলে ধরতে চাই| এরা যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃত কবি| যারা কবিতার ব্যঞ্জনা এবং ঘূর্ণায়নের মাধ্যমে শৈল্পিক আবহকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন| ‘সোনালি মানুষ’ কবিতায় কবি ডানা লোভন সোনালি মানুষটিকে এভাবেই নির্মাণ করেন— ‘এবং এসিড এসে ধৌত করে দেয় তাকে,/ হ্যাঁ, আমি ছোট্ট মানুষটিকে নির্মাণ করছিলাম|’ একটি কবিতা তখনই প্রকৃত সার্থকতা পায়, যখন একটি একান্ত ব্যক্তিগত অনুভুতি সার্বজনীনতা লাভ করে| একটি হৃদয়ের আকাঙ্খা হয়ে ওঠে বহূ হৃদয়ের প্রভাষণ| কবি ক্যাথরিন লিডিরার তার ‘বেঁচে থাকার একটি নতুন পথ’ কবিতাটির মুখবন্ধ শুরু করেছেন এভাবে— ‘আমি ক্লান্ত এভাবে ক্ষমা করতে করতে/ একটি রাত, একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ ফোরাম যেমন/ একটি মধ্যতর্জনী’।
একটি কবিতায় বহুমাত্রিক অনুযোগ কিংবা অনুপ্রাস কবিতাটিকে সমৃদ্ধ করে নি:সন্দেহে| যেকথা অনেকে বলতে কিংবা লিখতে পারেন না,- তা কবি পারেন| সেক্ষেত্রে কবি তার উত্তর প্রজন্মের জন্য নির্মাণ করেন একটি বিশুদ্ধ নিবাস| কবি জন ইয়াউ-এর তেমনি কিছু কথা আমাদের কানে বাজে, বুকে লাগে| তার ‘রাশিয়ান চিঠি-৩’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি— ‘প্রিয় মেঘের চিত্রকর/ কি প্রমাণ থাকবে সেখানে/ যখন দোকানী/ আমাদের ধুলিচিহ্ন ঝেড়ে ফেলে দেবে ছোট্ট নালীতে’| একইভাবে কবি ডানা লোভন-এর আহ্বান জাগিয়ে তোলে তার সহযাত্রী অনুজদেরকে| ‘কাজ’ কবিতায় তার বাণীগূলো এরকম— ‘এই সেই আমেরিকা—/ তুমি পাত্রের মধ্যে পানি রাখো| এই সেই তোমার শতাব্দী—/ যে চুলোয় তুমি আগুন জ্বালো/ তুমি অনুভব করো, এই শহর, তোমার চারদিকের ধুসর, যেভাবে তুমি কালো চা রাখো কাপের মাঝে|’
যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক অন্যতম প্রধান কবি মি. জিরাল্ড স্টার্ন-এর স্বগতোক্তি থেকে কালিক কবিতা নির্মাণে চিত্রকল্পের ব্যবহার সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারে| স্টার্ন বলেন, আমার কবিতায় আমি আমার সময়কেই ধরে রাখতে চেয়েছি| বর্তমানই ছিল আমার কাছে মূল বিবেচ্য বিষয়| জীবনের রঙ অনেকটাই তো ফ্যাকাশে| মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যে জন এগিয়ে আসতে পারে সেই হয় ভাগ্যবান জীবনের অধিকারী| কবিতায় সমসাময়িক বিষয় এবং চেতনার ব্যাপৃতি— বর্ণনা থাকা স্বাভাবিক| শত বছর আগে
একজন কবি কম্পিউটার, ই-মেইল, ইন্টারনেট সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না| বর্তমানের কবিরা এই গ্লো­বাল ভিলেজে বসবাস করে এসব বিষয়গুলোকে রপ্ত করছেন মনে প্রাণে| তাদের চিন্তা চেতনায় এখন সিলিকন ভ্যালি| আলোর ঝলক| একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তাই তো,মাইকেল ও’ নীল বলে যান— ‘আমি ক্রমশ: শব্দগূলোকে বন্দী করছি একটি দুর্দান্ত বাক্সের ভেতর/ ফুলগুলো যেন ফুটছে আমার হাত দিয়ে সবুজ গোপনগুলো স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে একটি কালো জমিনের বিপরীতে/ এভাবেই মধ্যরাতের আন্ত:জালে (ইন্টারনেটে) আমি খেলছি তোমার সাথে|’
আধুনিক চিত্রকল্পগুলো, আধুনিক মননের বুনন| এ বুনন তখনই আরো সমৃদ্ধ হয় যখন একটি কবিতার শিল্পায়ন ঘটে আন্তর্জাতিকতার নিরিখে| যারা পশ্চিমা সাহিত্যের বিবর্তনকে ধনবাদী আধুনিকায়ন বলে নাক সিটকান তাদের অবগতির জন্য বলতে হয়, যে প্রক্রিয়া পাশ্চাত্যে শুরু হয়েছে অর্ধশতাব্দী আগে, প্রাচ্যে এখন তার অনুকরণ চলছে| অতএব যদি চলমান সময়কে কবিতায় ধারণ করা না যায়, তবে হয়তো দু’ যুগ পরে আজকের কবি এবং কবিতা স্বকীয়তা নিয়ে আলোচনায় আসতে পারবেন না| বাংলা সাহিত্যের অনেক স্বনামধন্য কবি আছেন যারা বলেন, বর্তমানে কবিতার কিছুই হচ্ছে না| প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে— তারা কেন কিছু করছেন না| বা করার চেষ্টা করছেন না| একবিংশ শতাব্দীর শূরুতে দাঁড়িয়ে ক্ষণিক পিছন ফিরে তাকালে বেশ কিছু উত্থান চোখে পড়বে| বেশ কিছু আধুনিক কবি তাদের চিত্রকল্প নির্মাণের মাধ্যমে যে চিহ্নতত্ত্ব সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন তা নিয়ে হয়তো বিশদভাবে আলোচনা হবে সময়ে— ভবিষ্যতে| কবিতার চিত্রকল্প সব সময়ই গতিশীল| আর কবিরা সেই গতির শক্তি নিয়েই কালের দিকে ধাবমান|

দুই.
মনে পড়ছে একদিন টিএসসি তে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমি , কবি মোহন
রায়হান ও রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ । এ সময় আমার আরেক বন্ধু এগিয়ে আসেন । রুদ্র হাত বাড়িয়ে দেন। বলেন , ''আই এ্যাম রুদ্র মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ , দ্যা পোয়েট ।'''
মোহন ভাই হেসে ফেলেন। রুদ্র তার হাসি মুখে বলেন, ইয়েস, আই
এ্যাম দ্যা পোয়েট । তা বলবো না ?
হাঁ, একজন প্রকৃত কবির আত্মপ্রত্যয় এভাবেই সুদৃঢ় । কারণ তিনি জানেন ,তিনি কি করছেন।
এ প্রসংগে ময়মনসিংহের এক প্রখ্যাত বাউল মরমী কবি উকিল মুন্সীর
কথা আমার সব সময় মনে পড়ে। তাঁর একটা নন্দিত গান আছে,
'' আমি আগে না জানিয়া সখীরে কইরে পিরীতি /
আমার দু:খে দু:খে জনম গেলো , সুখ হইলো না এক রতি।''
এই গানটি এখনো মুখে মুখে ফিরে । কেন ফিরে? কারন মানুষ এখনো
বাউল উকিল মুন্সীর আত্মায়, প্রতিকৃতিতে নিজেকে খুঁজে পায়।
একজন কবির সার্থকতা সেখানেই।
কবিতার ভাষার প্রকাশভংগী বদলায় কালে কালে। বদলায় কবির বলার
ধরন। কিন্তু চন্দ্র , সূর্য, গ্রহ , নক্ষত্র , সমুদ্র , পর্বত সহ প্রকৃতির সিংহ ভাগ
যেমন ছিল , তেমনি থেকে যায়। কবিতা বার বার আসে কালের আবর্তনে।
কবির নতুন ধ্যানে .. চিত্রনে । কবিতার চিত্রকল্প, কালিক চেতনার ধারা
ফকির ইলিয়াস

Tuesday, June 9, 2015

নির্মলেন্দু গুণ'র কবিতা-১

১৬-৬-৮৪ - নির্মলেন্দু গুণ


হয় নিদ্রা আসুক, না হয় এক্ষুনি অবসান হোক
এই অসহ রাত্রির । আমি আর সইতে পারছি না ।
আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে নির্ঘুমতা ।
এই রাত্রি এখন আমার সহ্যসীমার বাইরে ।
দুঃখে-ক্ষোভে, অভিমানে আমার বুকের ভিতর থেকে
বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস, যেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে
শূন্য হাতে উঠে আসা কোনো ব্যর্থ ডুবুরী ।

চোখের ভিতরে হুল ফুটিয়ে বলি, একটু ঘুমাও,
আর কতক্ষণ, আর কতদিন এভাবে চলবে?
লক্ষীসোনা, মণি আমার, একটু ঘুমাও ।
মনকে বলি, এখন তো ছোট্ট ছেলেটি তুমি নও,
যে তোমাকে শোনাবে কেউ ঘুমপাড়ানিয়া গান ।
এখন তোমার ঘুমের জন্য কোন গান নেই ।
ভালোবাসার সাঁকো বেয়ে তুমি পৌছে গেছো এক
চির-নির্ঘুম দেশে, যেখানে দাউদাউ অগ্নিকুণ্ডে
জ্বলন্ত পৃথিবী; যেখানে নিদ্রা এক অচেনা প্রসঙ্গ ।

একশ' থেকে উল্টোদিকে শূণ্য পর্যন্ত গুনে
সেই কখন শেষ করেছি, তবু ঘুম আসে না ।
চিৎকার করে বলি, একশ এতো কম কেন?


দুঃখ আমাকে জাগিয়ে রাখে ।
আনন্দের সাধ্য কী সে পাল্লা দেবে
দুঃখের সঙ্গে, দুঃখ খুব জাগরণ ভালোবাসে ।
হায় আমার দিনগুলি রাতের সঙ্গে, আর
রাতগুলি দিনের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে ।
একটি দিনকে অন্যদিন থেকে পৃথক করে যে-নিদ্রা,
সে-ই যদি অন্তর্হিত হয়, তবে কীভাবে আমি
অনুভব করি আমার সপ্রাণতা?
আমার কাঁধে চেপে বসেছে অখণ্ড সময়ের বোঝা ।
চিৎকার করে বলি, 'এ বোঝা আমার নামাও ।'

তুমি কি কিছু শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছো?
প্রত্যাশা করছো কেউ তোমাকে কিছু বলবে?
কেউ তোমাকে কিচ্ছু বলবেনা, লক্ষীসোনা ভাই,
আমি বলছি, তুমি ঘুমাও । আরও একটু ভাবো,
বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করো তোমার অস্তিত্ব;
'ভালোবাসা' শব্দিটিকে নাড়াচাড়া করে দেখো ।

হয়তো একটু হলেই রহস্যের সূত্র পেয়ে যাবে,
চোখের সামনেই খুলে যাবে অন্ধকারের তালা,
আর তুমি পেয়ে যাবে তোমার ঘুম-নগরীর চাবি ।
বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া নকল নিদ্রা নয়,
তাকে তুমি ভিতর থেকে জাগাও ।


আমার খোলা আকাশের মতো চোখে
উড়ে বেড়ায় হরেক রঙের পাখি ।
আমার মস্তিষ্কের গভীর গোপন কুঠুরিতে
আজস্র পরীর দল প্রলয় নৃত্যে মাতে ।
স্বপ্ন-প্রেম, কামনা-বাসনা, স্মৃতি-বিস্মৃতির
জটাজলে বন্দী আমার রাত্রির পৃথিবী ।

আমি সেই জট খুলতে খুলতে ক্লান্ত হই,
ক্লান্ত হই; কিন্তু আমার ঘুম আসে না ।
আমার আত্মার অন্তর্ভেদী আর্তনাদে
ঘরের দেয়ালগুলি কাঁপে ।

রাতজাগা টিকটিকি ও আরশোলার মতো
আমি দেয়ালে-দেয়ালে অস্থির ছুটে যাই ।
শেষবারের মতো রাতের উদ্দেশে
আমার শেষ-তর্জনী তুলে বলি;
'হয় অবসান হোক এই দুঃসহ রাত্রির,
না হয় নিদ্রা আসুক ।'

পতিগৃহে পুরোনো প্রেমিক - নির্মলেন্দু গুণ


পাঁজরে প্রবিষ্ট প্রেম জেগে ওঠে পরাজিত মুখে,
পতিগৃহে যেরকম পুরোনো প্রেমিক
স্বামী ও সংসারে মুখোমুখি ।
প্রত্যাখ্যানে কষ্ট পাই,--ভাবি, মিথ্যে হোক
সত্যে নাই পাওয়া । বুকের কার্নিশে এসে
মাঝে-মধ্যে বসো প্রিয়তমা,
এখানে আনন্দ পাবে, পাবে খোলা হাওয়া ।

সেই কবে তোমাকে বুনেছি শুক্রে, শুভ্র বীজে,
যখন নদীর পাড় ঢাকা ছিল গভীর সবুজে ।
সময় খেয়েছে মূলে, বীজের অঙ্কুরে অমাক্রোধ,
দাবাগ্নিতে পুড়ে গেছে ভালোবাসা জনিত প্রবোধ ।

অহল্যাও পেয়েছিল প্রাণ জীবকোষে, পাথর-প্রপাতে
একদিন । তোমার অতনু জুড়ে কোনোদিন হবে নাকি
সেরকম প্রাণের সঞ্চার ? কোনদিন জাগিবে না আর?
পুরোনো প্রেমিক আমি কতো পুরাতনে যাবো?
ক্ষমা করো ভালোবাসা, প্রিয় অপরাধ ।

যদি কভু মধ্যরাতে পরবাসে ঘুম ভেঙে যায়,
যদি আচ্ছন্ন স্বপ্নের ঘোরে উচ্চারণ করো এই মুখ,
যদি ডাকো যৌবনের প্রিয় নাম ধরে--;
রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাবো পতিগৃহে পুরোনো প্রেমিক ।
মুখোমুখি দাঁড়াবো তোমার, যদি ক্ষমা পাই ।

মানুষের হৃদয়ে ফুটেছি - নির্মলেন্দু গুণ


গতকাল ছিল কালো-লালে মেশা
একটি অদ্ভুত টুনটুনি ।
লাফাচ্ছিল ডাল থেকে ডালে,
পাতার আড়ালে, ফুল থেকে ফুলে ।

তার সোনামুখী ঠোঁট, যেন
কলমের ডগায় বসানো একরত্তি হীরে ।
প্রতিটি আঁচড়ে কেটে ভাগ করছিল
ফুল থেকে মধু, মধু থেকে ফুল;
আমার সমস্ত কলতল ভেসে যাচ্ছিল
রক্তকরবীর মধুস্রোতে ।

আজ সকাল থেকেই রক্তকরবীর ডালে
ফুলের আগুন-জ্বলা হাত;
ফুল তুলছেন এক বৃদ্ধা পূজারিণী ।
তার হাতে রক্তকরবীর নকশা কাটা সাজি ।

মধু নয়, শূন্য বৃন্তে শুভ্রকষধারা ।
কলতলে রক্তকরবীর হু হু কান্না,
আমি কী করব? আমি কী করব?
রক্তকরবীর ডালে আমি তো ফুটিনি ।
আমি পৃথিবীর দুঃখী ফুল,
মানুষের হৃদয়ে ফুটেছি ।

গতকাল একদিন - নির্মলেন্দু গুণ


গতকাল বড়ো ছেলেবেলা ছিল
আমাদের চারিধারে,
দেয়ালের মতো অনুভূতিমাখা মোম
জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমারা দেখেছি
শিখার ভিতরে মুখ ।
গতকাল ছিল জীবনের কিছু
মরণের মতো সুখ ।

গতকাল বড়ো যৌবন ছিল
শরীরে শরীর ঢালা,
ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিল
উদাসীন গাছপালা ।

আমরা দু'জনে মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে
লুকিয়েছিলাম প্রেম,
গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল
বুঝিনি কী হারালাম !

গতকাল বড়ো এলোমেলো চুলে
বাতাস তুলেছে গ্রিবা,
চুমু খেয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার
উজ্জ্বল মধুরিমা ।

গতকাল বড়ো মুখোমুখি ছিল
সারাজীবনের চাওয়া,
চোখের নিমিষে চোখের ভিতরে
চোখের বাহিরে যাওয়া ।

নির্মলেন্দু গুণ'র কবিতা

 আবার যখনই দেখা হবে - নির্মলেন্দু গুণ

আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই
বলে দেব স্ট্রেটকাটঃ 'ভালোবাসি'।
এরকম সত্য-ভাষণে যদি কেঁপে ওঠে,
অথবা ঠোঁটের কাছে উচ্চারিত শব্দ থেমে যায়,
আমি নখাগ্রে দেখাবো প্রেম, ভালোবাসা, বক্ষ চিরে
তোমার প্রতিমা। দেয়ালে টাঙ্গানো কোন প্রথাসিদ্ধ
দেবীচিত্র নয়, রক্তের ফ্রেমে বাঁধা হৃদয়ের কাচে
দেখবে নিজের মুখে ভালোবাসা ছায়া ফেলিয়াছে।

এরকম উন্মোচনে যদি তুমি আনুরাগে মুর্ছা যেতে চাও
মূর্ছা যাবে,জাগাবো না,নিজের শরীর দিয়ে কফিন বানাবো।

'ভালোবাসি' বলে দেব স্ট্রেটকাট, আবার যখনই দেখা হবে।

বউ - নির্মলেন্দু গুণ

কে কবে বলেছে হবে না? হবে,বউ থেকে হবে ।
একদি আমিও বলেছিঃ 'ওসবে হবে না ।'
বাজে কথা । আজ বলি,হবে,বউ থেকে হবে ।
বউ থেকে হয় মানুষের পুনর্জন্ম,মাটি,লোহা,
সোনার কবিতা, ---কী সে নয়?

গোলাপ,শেফালি,যুঁই,ভোরের আকাশে প্রজাপতি,
ভালোবাসা,ভাগ্য,ভাড়াবাড়ি ইতিপূর্বে এভাবে মিশেনি ।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল,দুইজন্ম এবার মিশেছে,দেখা যাক ।

হতচ্ছাড়া ব্যর্থ প্রেম,গাঁজা,মদ,নৈঃসঙ্গ আমার
ভালোবেসে হে তরুণ,তোমাকে দিলাম,তুমি নাও ।
যদি কোনদিন বড় কবি হও,আমার সাফল্য
কতদূর একদিন তুমি তা বুঝিবে ।

আমি কতো ভালোবাসা দু'পায়ে মাড়িয়ে অবশেষে,
কল্পনার মেঘলোক ছেড়ে পৌঁছেছি বাস্তব মেঘে ।
আজ রাত বৃষ্টি হবে মানুষের চিরকাম্য দাবির ভিতরে ।

তার শয্যাপাশে আমার হয়েছে স্থান, মুখোমুখি,
অনায়াসে আমি তা বলি না, বলে যারা জানে দূর থেকে ।
আমি কাছে থেকে জানি, বিনিময়ে আমাকে হয়েছে দিতে
জীবনের নানা মূল্যে কেনা বিশ্বখানি, তার হাতে তুলে ।
অনায়াসে আমিও পারিনি । ক্রমে ক্রমে, বিভিন্ন কিস্তিতে
আমি তা দিয়েছি, ফুলে ফুলে ভালোবেসে যেভাবে প্রেমিক ।

প্রথমে আত্মার দ্যুতি, তারপর তাকে ঘিরে মুগ্ধ আনাগোনা ।
স্বর্গের সাজানো বাগানে পদস্পর্শে জ্বলে গেছি দূরে, তারপর
পেয়েছি বিশ্রাম । আজ রাত সম্পর্কের ভিতরে এসেছি ।

সবাই মিলবে এসে মৌন-মিহি শিল্পে অতঃপর,


কবিতার নাম : কাব্যগ্রন্থঃ অচল পদাবলী, বউ

স্বপ্ন, নব-ভৌগোলিক শিখা - নির্মলেন্দু গুণ

এখন আমার বয়স কত হবে? একশ? নব্বই? আশি?
হায়রে আমার বেশি-বয়সের স্বপ্ন, আমার একশ হবে না ।
আমি ময়মনসিংহের কবি, নীরার একান্ত বাধ্য স্বামী,
আমার বয়স পঁয়ত্রিশ, আমি ঢাকায় এসেছি স্বরচিত
কবিতা পড়তে । আমার বড় ভাই পশ্চিম বাংলার,
আমি স্বদেশের মায়ায় জড়ানো কবি ।

আয়াতুল্লা খোমিনির মতো আমার মাথার চুলে ব্রহ্মজীবী
শুভ্র-কাশদল, ফাল্গুনের হাওয়ায় মাতাল শাল-গজারীর
সবুজ পাতার ঝিলিমিলি আমার দু'চোখে ।
আমার দু'হাতে ধর্ম, দাঙ্গা,
আর প্রলম্বিত সামরিক শাসনের কালো শৃঙ্খলের দাগ ।
পায়ে এঁটেল মাটির মায়া, বুকে প্রিয়-নিধনের ক্ষত ।
আমি মেঘের আড়ালে ইন্দ্রজিৎ, আমি জন্মযোদ্ধা ।
আমি যুদ্ধে-যুদ্ধে, বিপ্লবে-বিপ্লবে...,আমার পেছনে দগ্ধ
ইতিহাসের ট্রাজিক উল্লাস; তবু জানি আমার সম্মুখে আছে
পৃথিবী কাঁপানো স্বপ্ন, আছে নব-ভৌগোলিক শিখা ।

আমার বয়স যখন বাড়বে, তখন প্রতিটি সূর্যোদয়ে
সূর্যমুখীর মতন একটি-একটি ক'রে পাপড়ি মেলবে
আমার প্রতিটি কবিতার ভিতর-বেলার বর্ণ ।

আজ যে আঙুরগুলো আমি মাটির ভিতরে পুঁতে রেখে যাচ্ছি,
একদিন তার নেশায় মাতাল হবে ভবিষ্যতের বাংলা আমার ।
তখন আমার বয়স কত হবে?

কবিতার নাম : কাব্যগ্রন্থঃ তার আগে চাই সমাজতন্ত্র, স্বপ্ন-নব-ভৌগোলিখ শিখা


একটি খোলা কবিতা - নির্মলেন্দু গুণ

আসুন আমরা আগুন সম্পর্কে বৃথা বাক্য
ব্যয় না করে একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠি
জ্বালিয়ে দিয়ে বলিঃ 'এই হচ্ছে প্রকৃত আগুন ।
মীটসেফ খোলা রেখে, বিড়ালকে উপদেশ দিয়ে
অযথা সময় নষ্ট ক'রে লাভ নেই, আসুন
আমরা মীটসেফের দরোজাটা বন্ধ করে দেই ।'

পুঁজিবাদী শোষণের পথ খোলা রেখে
সম্ভব নয় প্রকৃত মুক্তির স্বপ্ন দেখানো ।
ফুঁটো চৌবাচ্চায় জল থাকবার কথা নয়,
সে বেরিয়ে যাবেই; ওটাই জলের ধর্ম ।
আমাদের ধর্ম ভিন্ন হলেও টাকার ধর্ম একই ।

বুদ্ধিমান কৃষক তাই আগাছা উপড়ে ফেলে সময়মত,
নইলে তার কষ্ট-কর্ষিত জমিতে কি ফলতো ফসল?
পরগাছার আক্রমণ থেকে ফলবান বৃক্ষকে
রক্ষা করতে হয় পরগাছার গোড়া কেটে দিয়ে ।
রক্তচোষা জোঁকের মুখে দিতে হয় থুথু, অথবা চুন,
প্রচন্ড আঘাত ছাড়া
পৃথিবীতে কবে কোন দেয়ার ভেঙেছে?
পরশ্রমভোগী ধনিক শ্রেণীর সর্বনাশ ছাড়া দরিদ্রের
পুষ্টিসাধনের সংকল্প হচ্ছে চমৎকার অলীক কল্পনা ।

সুফল লাভ কি সম্ভব সুকর্ম ব্যতিরেকে?
কিংবা শস্য ভূমিকর্ষণ ছাড়া?
হাতুড়ে বৈদ্য গাংরিন সারাতে চান
ক্ষতস্থানে পুরনো ঘি মালিশ করে,
শিক্ষিত ডাক্তার পরামর্শ দেন অপারেশনের ।
তাতে কিছু রক্তপাত হয় বটে,
হয়তো কেটে ফেলতে হয় কোন প্রিয় অঙ্গ--
কিন্তু ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য ওটা এমন কিছু নয় ।
এর কোনো সহজ বিকল্প নেই । এটাই নিয়ম ।

কথার ফুলঝুড়িতে চিড়ে ভিজানোর ব্যর্থ চেষ্টায়
সময় নষ্ট না করে আসুন আমরা জলের কথাই বলি ।

একটি খোলা কবিতা, কাব্যগ্রন্থঃ দূর হ দুঃশাসন

পৃথিবী - নির্মলেন্দু গুণ

তুমি ডেকেছিলে, আমি চলে এসেছিলাম একা ।
কোনো কিছু সঙ্গে নিইনি, সঙ্গে করে নিইনি পানীয়,
তিল-তিসি-তামা বা বিছানা বালিশ, তুমি বলেছিলে
সব পাওয়া যাবে, --এ শহর নেশার ও নারীর ।

তুমি ডেকেছিলে, জননীর কোমল বিছানা ছেড়ে
চলে এসেছিলাম, শুধু তোমার ডাকে ।
পেছন থেকে অদৃশ্য নিয়তি এসে পাপের পিচ্ছিল লেজ
টেনে ধরেছিল । সর্বশেষ স্পর্শের আনন্দে উন্মাতাল
মায়ের বিছানা জড়িয়ে ধরেছিল তার শিশুকে ।
দীর্ঘশ্বাসের শব্দে এলোমেলো হয়েছিল জন্মের প্রথম চুল,
সাজানো ভুবন ফেলে চলে এসেছিলাম একা;
শুধু তোমার ডাকে । -শুদু তোমার ডাকে ।

তুমি ডেকেছিলে, পরীর বাগান ছেড়ে চলে এসেছিলাম ।
তুমি ডেকেছিলে, কোমল কিচেন ছেড়ে চলে এসেছিলাম ।
তুমি ডেকেছিলে, শুঁড়িখানার মাতাল আনন্দ ছেড়ে
চলে এসেছিলাম একা, শুধু তোমার জন্যে ।
তুমি মাটির ফোঁটার একটি তিলক দিয়ে
আমাকে ভোলাতে চাও?

আমি খাদ্য চাই ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মতো, দ্রৌপদীর মতো
বস্ত্র চাই, চাই সর্বগ্রাসী প্রেম, চাই শূর্পণখার মতো নারী,
চাই আকন্ঠ নিমগ্ন নেশা, চাই দেশী মদ ।
আমার সমস্ত ক্ষুধা তোমাকে মিটাতে হবে, হে পৃথিবী,
তুমি বলেছিলে অভাব হবে না, এ-পৃথিবী নেশা ও নারীর,
আমি চলে এসেছিলাম একা, শুধু তোমার জন্যে ।

স্মরণ - নির্মলেন্দু গুণ

নাম ভুলে গেছি, দুর্বল মেধা
স্মরণে রেখেছি মুখ;
কাল রজনীতে চিনিব তোমায়
আপাতত স্মৃতিভুক ।

ডাকিব না প্রিয়, কেবলি দেখিব
দু'চোখে পরান ভরে;
পূজারী যেমন প্রতিমার মুখে
প্রদীপ তুলিয়া ধরে ।

তুমি ফিরে যাবে উড়ন্ত রথে
মাটিতে পড়িবে ছায়া,
মন্দির খুঁড়ে দেখিব তোমায়
মন্দ্রিত মহামায়া ।

ভুলে যাব সব সময়-নিপাতে
স্মরণে জাগিয়ে প্রেম,
আঁধারে তখন জ্বলিবে তোমার
চন্দনে মাখা হেম ।

প্রশ্নাবলী - নির্মলেন্দু গুণ

কী ক'রে এমন তীক্ষ্ণ বানালে আখিঁ,
কী ক'রে এমন সাজালে সুতনু শিখা?
যেদিকে ফেরাও সেদিকে পৃথিবী পোড়ে ।
সোনার কাঁকন যখন যেখানে রাখো,
সেখানে শিহরে, ঝংকার ওঠে সুরে ।

সুঠাম সবুজ মরাল বাঁশের গ্রীবা
কঠিন হাতের কোমল পরশে জাগে,
চুম্বন ছাড়া কখনো বাঁচে না সে যে ।
পুরুষ চোখের আড়ালে পালাবে যদি,
কী লাভ তাহলে উর্বশী হয়ে সেজে?

বৈধ প্রেমের বাঁধন বোঝো না যদি,
কী ক'রে এমন শিথিল কবরী বাঁধো?
চতুর চোখের কামনা মিশায়ে চুলে
রক্তপলার পাথর-বাঁধানো হার
ছিঁড়ে ফেলে দাও, স্বপ্নে জড়াও ভুলে ।

কী ক'রে এমন কামনা-বাসনা-হারা
তাড়িত সাপের ত্বরিৎ-ফণার মতো
আপন গোপন গহনে মিলাও ধীরে?
বিজলি-উজ্জ্বল তিমির-বিনাশী শিখা
যেদিকে ফেরাও সেদিকে পৃথিবী পোড়ে ।

হাসানের জন্যে এলিজি - নির্মলেন্দু গুণ

প্রেমিকারা নয়, নাম ধরে যারা ডাকে তারা ঝিঁঝি,
তাদের যৎসামান্য পরিচয় জানা থাকা ভালো;
বলতেই মৃত্তিকারা বক্ষ চিরে তোমাকে দেখালো--;
অভ্যন্তরে কী ব্যাকুল তুমি পড়ো ডুয়িনো এলিজি ।
কবরে কী করে লেখো? মাটি কি কাগজ? খাতা?
ভালোবেসে উস্কে দিই প্রাণের পিদিম, এই নাও,
অনন্ত নক্ষত্র তুমি, অন্ধকারে আমাকে সাজাও
ফের মাতৃগর্ভে, বলো দেবদূত প্রেমিকা কি মাতা?
এইসব ঝিঁঝি পোকা, এরা কি ঈশ্বর নাকি পাখি,
উদ্বাস্তু উন্মুল মোক্ষ, যৌবনের, কোন পাত্রে রাখি?

পাপে-পুণ্যে এ পৃথিবী, এই প্রাণ তারচে অধিকে ।
আমি আছি, তুমি নেই--,এইভাবে দু'জন দু'দিকে
অপসৃত; -তাই তো নশ্বর নারী কবির বিশ্বাসে,
ভালোবেসে যাকে ছুঁই, সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে...।