'হয়তোবা আমি গভীর সমুদ্রের প্রয়োজনে নির্মিত জাহাজঘাটায় পরিত্যক্ত
বালক, অথবা এক খেটে খাওয়া দিনমজুর এমন পথ বেয়ে চলেছি যার প্রান্ত ছুঁয়েছে
আকাশ।...' আর্তুর র্যাঁবোর খবং ওষষঁসরহধঃরড়হং কাব্যগ্রন্থে এরকম উচ্চারণের
মধ্য দিয়ে আমরা আবিষ্কার করে নিই যে, র্যাঁবো একদিকে নিজেকে যেমন ভাবতেন
নিম্নবর্গীয় বা অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ, অন্যদিকে তিনি সমস্ত যুক্তিতর্কের
উর্ধে উঠে যাত্রা করতে চেয়েছিলেন অসীমতার দিকে।
ঊনবিংশ শতকের শেষ বা ন'য়ের দশকে ফরাসি সাহিত্যের যে তিন নক্ষত্রের পতন ঘটে তাঁরা ছিলেন_ জাঁ আর্তুর র্যাঁবো, ভেরলেন ও স্তেফান মালার্মে। এই তিনজনের মধ্যে র্যাঁবো সর্বকনিষ্ঠ হলেও শুধু ভেরলেন বা মালার্মেই নয়, গত দুই শ' বছরের ফরাসি সাহিত্যে ধারণা করি এখনো পর্যন্ত র্যাঁবোই সবচে' উজ্জ্বল ও অনুদ্ধারিত নক্ষত্র। ১৮৫৪ থেকে ১৮৯১_ মাত্র এই সাঁইত্রিশ বছরের জীবনে যে অনন্য সাহিত্যকৃতি ফরাসি সাহিত্যে সংযোজন করে গেছেন, র্যাঁরোর মৃত্যুর প্রায় একশ' বছর পরে হলেও ফরাসি জাতি তথা কবিতাপ্রেমী বিশ্ব তা অনেকটা অনুধাবন করতে পেরেছে।
শুরু থেকেই র্যাঁবোর কবিকর্ম তাঁর আধ্যাত্মিক ও মানসিক প্রত্যয়ের দ্বারা বিশ্লিষ্ট হয়েছে। র্যাঁবোর রচনা বস্তুতপক্ষে তাঁর তুলনারহিত সতেজ ও তাজা ভাষার অনুশীলনে সৌকর্য লাভ করে। পিতামাতা পরিত্যক্ত শিশু ধর্মের বন্দিদৈন্যদশা এবং এই প্রকার বহুতর চিত্রকল্প তাঁর কবিতায় বিচ্ছুরিত হতে দেখা যায়। র্যাঁবো তাঁর সমকালে বঞ্চিত অবহেলিত হয়েছেন, অনুদ্ধারিত থেকেছেন। সামাজিক অবহেলা একজন মহৎ কবির রচনার পশ্চাৎপট অনুসন্ধানে কতখানি অসহযোগিতা প্রদান করে তার অন্যতম প্রমাণ দীর্ঘদিন র্যাঁবোর কবিতা হিমাগারে পড়ে থাকা। তিনি বস্তুতপক্ষে একজন পুরাণপুরুষ, সর্বদা অভূতপূর্ব আত্মিক অনুসন্ধানে ব্রতী। র্যাঁবো অলৌকিক ভূতগ্রস্ত, আত্মসমর্পণ করেন কেবলমাত্র নিজেকে পুনর্জাগরিত করতে, নিজের আত্মশক্তির মার্জিতকরণে, অতিপ্রাকৃত শক্তিসমূহের অধিকারকল্পে যার দ্বারা তাঁর উচ্চাশা পূরণ হয়। র্যাঁবোর কবিতা পড়তে পড়তে প্রতি ক্ষেত্রে পাঠক এমন একটা জগতে প্রবেশ করেন, যেখানে ভারসাম্যতার শাশ্বত নিয়মের ব্যতিক্রম চলছে। র্যাঁবো তার কবিতায় সৃষ্টির আদিমতম ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চান। কারণ, তাঁর বাসনা পৃথিবীকে নতুন করে উপস্থাপনা করা, যেমন করে সৃষ্টিকর্তা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর অস্তিত্বের উৎসে পৌঁছাবার।
পুড়িয়ে ফেলা, হারিয়ে যাওয়া, উদ্ধারিত, অনুদ্ধারিত মিলিয়ে র্যাঁবোর রচনার পরিমাণ তুলনামূলক কম নয়। তিনি লিখেছেন প্রচুর গদ্যফর্মের কবিতা, প্রচলিত ছন্দোবদ্ধ কবিতা, সনেট এবং বেশকিছু গদ্য। র্যাঁবোর উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে আছে_ খবং ওষষঁসরহধঃরড়হং, টহ ঈড়বঁৎ ঝড়ঁং টহব ঝড়ঁঃধহব, খবং উবংবৎঃং খ্থধসড়ঁৎ, ইবঃযংধরফধ, খধ চরংপরহব, টহব ঝধরংড়হ ঊহভবৎ.
র্যাঁবোকে বলা হয় এক বিস্ময়কর প্রতিভা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, তাঁর মৃত্যুর সময়ও তাঁর কাছের দু'চারজন বন্ধু বা পরিচিত জন ছাড়া তাঁর আত্মীয়-পরিজনসহ অনেকেই জানতেন না যে, তিনি কত বড়মাপের একজন কবি হয়ে জন্মেছিলেন, এবং তাঁর অনুদ্ধারিত সব কাব্যকৃতি বিশ্ববাসীকে একদিন এভাবে বিস্ময়াভিভূত করে দেবে। এমনকি র্যাঁবোর মৃত্যুর সময় তাঁর বোন ইসাবেলে যিনি র্যাঁবোর শয্যাপাশে ছিলেন, তিনিও জানতেন না যে, তাঁর ভাই ছিলেন একজন কবি। পরদিন ইসাবেলে পত্রিকায় এ খবর জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে যান। সত্যিকার অর্থে র্যাঁবোর কবিতা পাঠ শুরু হয় গত ৫০/৬০ বছর আগে থেকে। অর্থাৎ গত বিশ শতকের মধ্য সময় হতে পাশ্চাত্যে র্যাঁবো ব্যাপকভাবে পঠিত হতে শুরু করেন এবং তারপর সারাবিশ্বে।
র্যাঁবোর কাব্যবোধ এতটা গভীর, তীক্ষ্ন ও দূর অন্বেষী ছিল যে প্রায় একশ' বছর আগে যে ধারা তথা ফর্মকে তিনি কবিতায় ব্যবহার করেন, কিংবা তাঁর কবিতা চিন্তার যেসব এলাকায় যেভাবে বিচরণ করেছে; আজকের এই নতুন শতকের একজন কবিও তাঁকে অনুসরণ করে আনন্দিত বোধ করতে পারে। আরো স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, র্যাঁবো তাঁর সেই স্বল্পায়ু জীবনে যে কবিতাভুবন রচনা করে গেছেন, আজকের প্রজন্ম সেই একই ভুবনের বাসিন্দা আর সেই ভুবনের আকাশের গোল চাঁদটাকে ছিঁড়ে সফলতা তা তো নিঃসন্দেহে সেই 'অলৌকিক আনন্দে' অবগাহনের সমান।
র্যাঁবো ছিলেন প্রচন্ড একরোখা, প্রখর ধীশক্তিসম্পন্ন, জাগতিক সবকিছুকে অস্বীকার করার ভেতর দিয়ে নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে দেখতে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। তাই তাঁর কবিতায় কখনো অন্য কোনো ফরাসি কবি, বা সাহিত্যিকের ছায়া একদমই দেখতে পাওয়া যায় না। বরং র্যাবোর সানি্নধ্যে যারা এসেছিলেন, তারাই প্রভাবিত হয়েছিলেন র্যাঁবোর প্রভাবে।
অবশ্য উনিশ শতকের মধ্য সত্তরের দশকে সম্ভবত মার্কিন কবি এডগার পো'র রচনার সঙ্গে পরিচিত হন এবং আরো কিছু পরে পোল ভেরলেনের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছিলেন। ভেরলেন র্যাঁবোর কবিতার প্রতি ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং একটি সংকলনে র্যাঁবোর কবিতা মুদ্রণ করেন। তখন ভেরলেনের বয়স ২৭ এবং ঘরে তার নববধূ, ভেরলেন র্যাঁবোর উচ্ছৃঙ্খল জীবনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েন যে তাঁর স্ত্রী তাঁকে তালাক দিতে উদ্যত হয়। ভেরলেনও মনে মনে র্যাঁবোর এ জীবন মেনে নিতে পারেননি, এবং র্যাঁবোর সঙ্গে তিনি যেখানেই গেছেন, প্রায়ই স্ত্রীর কথা চিন্তা করে বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। এ জন্য র্যাঁবো তাঁকে বিদ্রূপ করতেও ছাড়তেন না। এভাবে দীর্ঘদিন ভেরলেনকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভ্রমণ পিয়াসী র্যাঁবো বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখান থেকে র্যাঁবো ফিরে এসে রচনা করেন 'ইলুমিয়াসিওঁ' কাব্যগ্রন্থটি। আবার সখ্য হয় ভেরলেনের সঙ্গে এবং আরো কয়েকবার দুই কবির মধ্যে মনোমালিন্য হলে ভেরলেন একবার ব্রাসেলসে র্যাঁবোর কব্জিতে গুলি করে বসে। আর তাতে দুই বছরের কারাদন্ড ভোগ করেন ভেরলেন। এবং বেরিয়ে এরে র্যাঁবো যখন বুঝতে পারেন তাঁর কবিবন্ধু এ ঘটনায় ভীষণভাবেই অনুতপ্ত, তখন আবার ভেরলেনের দিকে সখ্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এই দুই বছরে র্যাঁবো আরদেনেসে তাঁর মায়ের কাছে ফিরে যান এবং ১৮৭৩ সালে রচনা করেন তাঁর মহত্তম গ্রন্থ 'উন্য সেজোঁ আঁ আঁফের'। এই বইটিতেই উঠে আসে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের অস্থিরতা।
র্যাঁবো সবসময়ই ইউরোপীয় জীবনধারার বিরোধিতা করেছেন, খ্রিস্টধর্মের বিরোধিতা করেছেন। র্যাঁবো বলেছেন, 'আমি সেই শ্রেণীর মানুষ, যারা অত্যাচারে গান করে, আমি আইন কিছুই বুঝতে পারি না, আমার নৈতিক কোনো চেতনা নেই, আমি একজন বর্বর।' র্যাঁবো বারবার ইউরোপ ছেড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করতে চেয়েছেন। এজন্য তিনি মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যে শিখে ফেলেন ইংরেজি, জার্মান, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, রাশিয়ান, এ্যারাবিক এবং গ্রিক ভাষা। এর চেয়ে অবিশ্বাস্য আর কী হতে পারে! কিন্তু বাস্তবতা তাই! আর ছাত্রাবস্থায় শিখেছিলেন লাতিন।
সাঁইত্রিশ বছরের জীবন পেলেও মাত্র ১৬ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে তাঁর সমস্ত লেখালেখি শেষ করেন। এরপর তিনি আর লিখবেন না বলে মনস্থির করেন। এবং বাকি জীবনে তিনি আর একটি পঙ্ক্তিও রচনা করেননি। তাঁর বিখ্যাত টহব ঝধরংড়হ ঊহ ঊহভবৎ লেখা শেষ করে তিনি তাঁর মায়ের কাছে ফিরে আসেন এবং তাঁর সমস্ত প্রকাশিত গ্রন্থসহ যাবতীয় অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিও আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন।
পৃথিবীখ্যাত এই অনন্য প্রতিভাধর কবির এই মানসিক অ-আচারে সবাই বিস্মিত হবেন হয়তো, কিন্তু তারও চেয়ে আশ্চর্য মনে হয় যখন তিনি তাঁর লেখালেখি বিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, 'আমি আর এই বিষয়টি নিয়ে কিছুই করি না।' তাঁর একটি বইয়ের লেমের সংস্করণ হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, 'এখানে কি অর্থের অপচয় হয়েছে! বই কেনাও আসলে মূর্খের কাজ।'
নতুন কর্মজীবন শুরু করেন র্যাঁবো। একবার জাভায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে ছয় বছরের জন্য ডাচ সৈন্যদলে যোগ দেন এবং ১৮৭৮ সালে সাইপ্রাসে এক পাথর কাটার কারখানায় কাজ করতে গিয়ে টাইফয়েডে আক্রান্ত হন এবং আবার তিনি ফ্রান্সে পরিবারের কাছে ফিরে যান। সুস্থ হয়ে হারারে তাঁর নিজের একটা ব্যবসা গড়ে তুলতে চান, চাল চিনি সিল্ক তুলাজাত দ্রব্যসহ অস্ত্রশস্ত্র, যা তিনি নিজের ক্যারাভ্যানে পাচার করতেন স্থানীয় রাজরাজড়াদের সঙ্গে গোপন সংযোগে।
মারাত্মকভাবে অর্থলিপ্সু হয়ে ওঠেন র্যাঁবো। তাঁর আকাঙ্ক্ষা, এমন পরিমাণ অর্থ তিনি চলমান অবস্থা থেকে অর্জন করবেন যে, যাতে তিনি একটি ফরাসি মেয়েকে বিবাহ করতে পারেন এবং একটি পুত্র সন্তানের পিতা হতে পারেন। এবং তাঁর পুত্রকে তিনি এমন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, যে হবে একজন প্রকৌশলী, বিজ্ঞানের সহায়তায় যে হয়ে উঠবে ক্ষমতা ও বিপুল বিত্তের অধিকারী।
র্যাবো বারো বছর প্রাচ্যে কাটানোর পর এক শীতে অনুভব করলেন, তার স্ফীত ও প্রলম্বিত ধমনির অসুখ হয়েছে। তিনি এতটাই অহঙ্কারী ছিলেন যে, তিনি কোনো ডাক্তারের কাছে যাবেন না বলে স্থির করেন। তার পা ফুলে গেল এবং কেটে ফেলা হলো। একসময় খুব শান্ত স্থির কণ্ঠে বিড়বিড় করে তার নিকটাত্মীয়দের কাছে কিছু বলতে বলতে চিরবিদায় নিলেন। তার আত্মীয় সূত্রে জানা যায়, র্যাঁবো বিড়বিড় করে যা বলেছিল তা সবই ছিল তার স্বপ্নের কথা।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, র্যাবোর রচনা যেমন দুর্বোধ্য ও জটিল, তেমনই তাঁর সামান্য রচনা সম্ভার যেন ফরাসি সাহিত্যের এক মহার্ঘ জানালা, যেখানে চোখ মেলে দেখা যায় বিস্তৃত আকাশ।
শেষ করি কমলেশ চক্রবর্তী অনূদিত র্যাঁবোর বিখ্যাত কবিতা 'নরকের রাত্রি'র কয়েক পঙ্ক্তিতে :
এবং অভিশাপ চিরকালীন! একজন মানুষ যে নিজেকে অঙ্গহানি করতে চায় সে সত্য সত্যই অভিশপ্ত, তাই কি নয় সে? আমার মনে হয় আমি নরকে আছি, এবং সেই হেতু আমি আমিই। এটা হচ্ছে জবরদস্তির ফলাফল। আমার খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বনের আমি ক্রীতদাস। জনকজননী, তোমরা আমার দুর্দশার কারণ এবং তোমাদেরও নিজেদের।
ঋণ:
১. জাঁ আর্তুর র্যাঁবোর কাব্যসংকলন/ অনুবাদ : কমলেশ চক্রবর্তী
২. ইন্টারনেট
ঊনবিংশ শতকের শেষ বা ন'য়ের দশকে ফরাসি সাহিত্যের যে তিন নক্ষত্রের পতন ঘটে তাঁরা ছিলেন_ জাঁ আর্তুর র্যাঁবো, ভেরলেন ও স্তেফান মালার্মে। এই তিনজনের মধ্যে র্যাঁবো সর্বকনিষ্ঠ হলেও শুধু ভেরলেন বা মালার্মেই নয়, গত দুই শ' বছরের ফরাসি সাহিত্যে ধারণা করি এখনো পর্যন্ত র্যাঁবোই সবচে' উজ্জ্বল ও অনুদ্ধারিত নক্ষত্র। ১৮৫৪ থেকে ১৮৯১_ মাত্র এই সাঁইত্রিশ বছরের জীবনে যে অনন্য সাহিত্যকৃতি ফরাসি সাহিত্যে সংযোজন করে গেছেন, র্যাঁরোর মৃত্যুর প্রায় একশ' বছর পরে হলেও ফরাসি জাতি তথা কবিতাপ্রেমী বিশ্ব তা অনেকটা অনুধাবন করতে পেরেছে।
শুরু থেকেই র্যাঁবোর কবিকর্ম তাঁর আধ্যাত্মিক ও মানসিক প্রত্যয়ের দ্বারা বিশ্লিষ্ট হয়েছে। র্যাঁবোর রচনা বস্তুতপক্ষে তাঁর তুলনারহিত সতেজ ও তাজা ভাষার অনুশীলনে সৌকর্য লাভ করে। পিতামাতা পরিত্যক্ত শিশু ধর্মের বন্দিদৈন্যদশা এবং এই প্রকার বহুতর চিত্রকল্প তাঁর কবিতায় বিচ্ছুরিত হতে দেখা যায়। র্যাঁবো তাঁর সমকালে বঞ্চিত অবহেলিত হয়েছেন, অনুদ্ধারিত থেকেছেন। সামাজিক অবহেলা একজন মহৎ কবির রচনার পশ্চাৎপট অনুসন্ধানে কতখানি অসহযোগিতা প্রদান করে তার অন্যতম প্রমাণ দীর্ঘদিন র্যাঁবোর কবিতা হিমাগারে পড়ে থাকা। তিনি বস্তুতপক্ষে একজন পুরাণপুরুষ, সর্বদা অভূতপূর্ব আত্মিক অনুসন্ধানে ব্রতী। র্যাঁবো অলৌকিক ভূতগ্রস্ত, আত্মসমর্পণ করেন কেবলমাত্র নিজেকে পুনর্জাগরিত করতে, নিজের আত্মশক্তির মার্জিতকরণে, অতিপ্রাকৃত শক্তিসমূহের অধিকারকল্পে যার দ্বারা তাঁর উচ্চাশা পূরণ হয়। র্যাঁবোর কবিতা পড়তে পড়তে প্রতি ক্ষেত্রে পাঠক এমন একটা জগতে প্রবেশ করেন, যেখানে ভারসাম্যতার শাশ্বত নিয়মের ব্যতিক্রম চলছে। র্যাঁবো তার কবিতায় সৃষ্টির আদিমতম ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চান। কারণ, তাঁর বাসনা পৃথিবীকে নতুন করে উপস্থাপনা করা, যেমন করে সৃষ্টিকর্তা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর অস্তিত্বের উৎসে পৌঁছাবার।
পুড়িয়ে ফেলা, হারিয়ে যাওয়া, উদ্ধারিত, অনুদ্ধারিত মিলিয়ে র্যাঁবোর রচনার পরিমাণ তুলনামূলক কম নয়। তিনি লিখেছেন প্রচুর গদ্যফর্মের কবিতা, প্রচলিত ছন্দোবদ্ধ কবিতা, সনেট এবং বেশকিছু গদ্য। র্যাঁবোর উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে আছে_ খবং ওষষঁসরহধঃরড়হং, টহ ঈড়বঁৎ ঝড়ঁং টহব ঝড়ঁঃধহব, খবং উবংবৎঃং খ্থধসড়ঁৎ, ইবঃযংধরফধ, খধ চরংপরহব, টহব ঝধরংড়হ ঊহভবৎ.
র্যাঁবোকে বলা হয় এক বিস্ময়কর প্রতিভা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, তাঁর মৃত্যুর সময়ও তাঁর কাছের দু'চারজন বন্ধু বা পরিচিত জন ছাড়া তাঁর আত্মীয়-পরিজনসহ অনেকেই জানতেন না যে, তিনি কত বড়মাপের একজন কবি হয়ে জন্মেছিলেন, এবং তাঁর অনুদ্ধারিত সব কাব্যকৃতি বিশ্ববাসীকে একদিন এভাবে বিস্ময়াভিভূত করে দেবে। এমনকি র্যাঁবোর মৃত্যুর সময় তাঁর বোন ইসাবেলে যিনি র্যাঁবোর শয্যাপাশে ছিলেন, তিনিও জানতেন না যে, তাঁর ভাই ছিলেন একজন কবি। পরদিন ইসাবেলে পত্রিকায় এ খবর জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে যান। সত্যিকার অর্থে র্যাঁবোর কবিতা পাঠ শুরু হয় গত ৫০/৬০ বছর আগে থেকে। অর্থাৎ গত বিশ শতকের মধ্য সময় হতে পাশ্চাত্যে র্যাঁবো ব্যাপকভাবে পঠিত হতে শুরু করেন এবং তারপর সারাবিশ্বে।
র্যাঁবোর কাব্যবোধ এতটা গভীর, তীক্ষ্ন ও দূর অন্বেষী ছিল যে প্রায় একশ' বছর আগে যে ধারা তথা ফর্মকে তিনি কবিতায় ব্যবহার করেন, কিংবা তাঁর কবিতা চিন্তার যেসব এলাকায় যেভাবে বিচরণ করেছে; আজকের এই নতুন শতকের একজন কবিও তাঁকে অনুসরণ করে আনন্দিত বোধ করতে পারে। আরো স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, র্যাঁবো তাঁর সেই স্বল্পায়ু জীবনে যে কবিতাভুবন রচনা করে গেছেন, আজকের প্রজন্ম সেই একই ভুবনের বাসিন্দা আর সেই ভুবনের আকাশের গোল চাঁদটাকে ছিঁড়ে সফলতা তা তো নিঃসন্দেহে সেই 'অলৌকিক আনন্দে' অবগাহনের সমান।
র্যাঁবো ছিলেন প্রচন্ড একরোখা, প্রখর ধীশক্তিসম্পন্ন, জাগতিক সবকিছুকে অস্বীকার করার ভেতর দিয়ে নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে দেখতে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। তাই তাঁর কবিতায় কখনো অন্য কোনো ফরাসি কবি, বা সাহিত্যিকের ছায়া একদমই দেখতে পাওয়া যায় না। বরং র্যাবোর সানি্নধ্যে যারা এসেছিলেন, তারাই প্রভাবিত হয়েছিলেন র্যাঁবোর প্রভাবে।
অবশ্য উনিশ শতকের মধ্য সত্তরের দশকে সম্ভবত মার্কিন কবি এডগার পো'র রচনার সঙ্গে পরিচিত হন এবং আরো কিছু পরে পোল ভেরলেনের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছিলেন। ভেরলেন র্যাঁবোর কবিতার প্রতি ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং একটি সংকলনে র্যাঁবোর কবিতা মুদ্রণ করেন। তখন ভেরলেনের বয়স ২৭ এবং ঘরে তার নববধূ, ভেরলেন র্যাঁবোর উচ্ছৃঙ্খল জীবনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েন যে তাঁর স্ত্রী তাঁকে তালাক দিতে উদ্যত হয়। ভেরলেনও মনে মনে র্যাঁবোর এ জীবন মেনে নিতে পারেননি, এবং র্যাঁবোর সঙ্গে তিনি যেখানেই গেছেন, প্রায়ই স্ত্রীর কথা চিন্তা করে বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। এ জন্য র্যাঁবো তাঁকে বিদ্রূপ করতেও ছাড়তেন না। এভাবে দীর্ঘদিন ভেরলেনকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভ্রমণ পিয়াসী র্যাঁবো বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখান থেকে র্যাঁবো ফিরে এসে রচনা করেন 'ইলুমিয়াসিওঁ' কাব্যগ্রন্থটি। আবার সখ্য হয় ভেরলেনের সঙ্গে এবং আরো কয়েকবার দুই কবির মধ্যে মনোমালিন্য হলে ভেরলেন একবার ব্রাসেলসে র্যাঁবোর কব্জিতে গুলি করে বসে। আর তাতে দুই বছরের কারাদন্ড ভোগ করেন ভেরলেন। এবং বেরিয়ে এরে র্যাঁবো যখন বুঝতে পারেন তাঁর কবিবন্ধু এ ঘটনায় ভীষণভাবেই অনুতপ্ত, তখন আবার ভেরলেনের দিকে সখ্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এই দুই বছরে র্যাঁবো আরদেনেসে তাঁর মায়ের কাছে ফিরে যান এবং ১৮৭৩ সালে রচনা করেন তাঁর মহত্তম গ্রন্থ 'উন্য সেজোঁ আঁ আঁফের'। এই বইটিতেই উঠে আসে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের অস্থিরতা।
র্যাঁবো সবসময়ই ইউরোপীয় জীবনধারার বিরোধিতা করেছেন, খ্রিস্টধর্মের বিরোধিতা করেছেন। র্যাঁবো বলেছেন, 'আমি সেই শ্রেণীর মানুষ, যারা অত্যাচারে গান করে, আমি আইন কিছুই বুঝতে পারি না, আমার নৈতিক কোনো চেতনা নেই, আমি একজন বর্বর।' র্যাঁবো বারবার ইউরোপ ছেড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করতে চেয়েছেন। এজন্য তিনি মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যে শিখে ফেলেন ইংরেজি, জার্মান, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, রাশিয়ান, এ্যারাবিক এবং গ্রিক ভাষা। এর চেয়ে অবিশ্বাস্য আর কী হতে পারে! কিন্তু বাস্তবতা তাই! আর ছাত্রাবস্থায় শিখেছিলেন লাতিন।
সাঁইত্রিশ বছরের জীবন পেলেও মাত্র ১৬ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে তাঁর সমস্ত লেখালেখি শেষ করেন। এরপর তিনি আর লিখবেন না বলে মনস্থির করেন। এবং বাকি জীবনে তিনি আর একটি পঙ্ক্তিও রচনা করেননি। তাঁর বিখ্যাত টহব ঝধরংড়হ ঊহ ঊহভবৎ লেখা শেষ করে তিনি তাঁর মায়ের কাছে ফিরে আসেন এবং তাঁর সমস্ত প্রকাশিত গ্রন্থসহ যাবতীয় অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিও আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন।
পৃথিবীখ্যাত এই অনন্য প্রতিভাধর কবির এই মানসিক অ-আচারে সবাই বিস্মিত হবেন হয়তো, কিন্তু তারও চেয়ে আশ্চর্য মনে হয় যখন তিনি তাঁর লেখালেখি বিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, 'আমি আর এই বিষয়টি নিয়ে কিছুই করি না।' তাঁর একটি বইয়ের লেমের সংস্করণ হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, 'এখানে কি অর্থের অপচয় হয়েছে! বই কেনাও আসলে মূর্খের কাজ।'
নতুন কর্মজীবন শুরু করেন র্যাঁবো। একবার জাভায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে ছয় বছরের জন্য ডাচ সৈন্যদলে যোগ দেন এবং ১৮৭৮ সালে সাইপ্রাসে এক পাথর কাটার কারখানায় কাজ করতে গিয়ে টাইফয়েডে আক্রান্ত হন এবং আবার তিনি ফ্রান্সে পরিবারের কাছে ফিরে যান। সুস্থ হয়ে হারারে তাঁর নিজের একটা ব্যবসা গড়ে তুলতে চান, চাল চিনি সিল্ক তুলাজাত দ্রব্যসহ অস্ত্রশস্ত্র, যা তিনি নিজের ক্যারাভ্যানে পাচার করতেন স্থানীয় রাজরাজড়াদের সঙ্গে গোপন সংযোগে।
মারাত্মকভাবে অর্থলিপ্সু হয়ে ওঠেন র্যাঁবো। তাঁর আকাঙ্ক্ষা, এমন পরিমাণ অর্থ তিনি চলমান অবস্থা থেকে অর্জন করবেন যে, যাতে তিনি একটি ফরাসি মেয়েকে বিবাহ করতে পারেন এবং একটি পুত্র সন্তানের পিতা হতে পারেন। এবং তাঁর পুত্রকে তিনি এমন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, যে হবে একজন প্রকৌশলী, বিজ্ঞানের সহায়তায় যে হয়ে উঠবে ক্ষমতা ও বিপুল বিত্তের অধিকারী।
র্যাবো বারো বছর প্রাচ্যে কাটানোর পর এক শীতে অনুভব করলেন, তার স্ফীত ও প্রলম্বিত ধমনির অসুখ হয়েছে। তিনি এতটাই অহঙ্কারী ছিলেন যে, তিনি কোনো ডাক্তারের কাছে যাবেন না বলে স্থির করেন। তার পা ফুলে গেল এবং কেটে ফেলা হলো। একসময় খুব শান্ত স্থির কণ্ঠে বিড়বিড় করে তার নিকটাত্মীয়দের কাছে কিছু বলতে বলতে চিরবিদায় নিলেন। তার আত্মীয় সূত্রে জানা যায়, র্যাঁবো বিড়বিড় করে যা বলেছিল তা সবই ছিল তার স্বপ্নের কথা।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, র্যাবোর রচনা যেমন দুর্বোধ্য ও জটিল, তেমনই তাঁর সামান্য রচনা সম্ভার যেন ফরাসি সাহিত্যের এক মহার্ঘ জানালা, যেখানে চোখ মেলে দেখা যায় বিস্তৃত আকাশ।
শেষ করি কমলেশ চক্রবর্তী অনূদিত র্যাঁবোর বিখ্যাত কবিতা 'নরকের রাত্রি'র কয়েক পঙ্ক্তিতে :
এবং অভিশাপ চিরকালীন! একজন মানুষ যে নিজেকে অঙ্গহানি করতে চায় সে সত্য সত্যই অভিশপ্ত, তাই কি নয় সে? আমার মনে হয় আমি নরকে আছি, এবং সেই হেতু আমি আমিই। এটা হচ্ছে জবরদস্তির ফলাফল। আমার খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বনের আমি ক্রীতদাস। জনকজননী, তোমরা আমার দুর্দশার কারণ এবং তোমাদেরও নিজেদের।
ঋণ:
১. জাঁ আর্তুর র্যাঁবোর কাব্যসংকলন/ অনুবাদ : কমলেশ চক্রবর্তী
২. ইন্টারনেট
বুঝি না, রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের
ReplyDeleteবৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বসনা রাখতেন ।
গাছ নেই নদী নেই অপুস্পক সময় বইছে
পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই
শুনুন রবীন্দ্রনাথ, আপনার সমস্ত কবিতা
আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি
নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না
আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিস্ফলা, ঠাকুর
Visit Here
সুন্দর লেখা!
ReplyDelete